ওই মহামানব আসে

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ভারতবর্ষ বহু ধর্মের দেশ। বহু ভাষার দেশ। বহু সংস্কৃতির দেশ। ভারতের ভৌগােলিক সীমা বুঝিয়ে দেয় ভাষার বহুত্ব, সংস্কৃতির বহুত্ব। ভৌগােলিক সীমাকে পরােয়া করে না সম্প্রদায়কেন্দ্রিক ধর্ম। তাই একই ভৌগােলিক সীমায় হিন্দু, ইসলাম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী মানুষের বাস এই ভারতবর্ষে। প্রত্যেক ধর্মাবলম্বী মানুষের আলাদা আলাদা দেবদেবী, আবার কোনও ধর্মের দেবদেবী নিরাকার। যথন ভায়ে ভায়ে গণ্ডগােল হয় তখন ধর্মের কথা আসে না। যখন পাড়ায় পাড়ায় গণ্ডগােল হয় তখন ধর্মের কথা আসে না। যখন রাজনৈতিক দলাদলি হয় তখনও ধর্মের কথা আসে না। হ্যাঁ, তখনই ধর্মের কথা আসে যখন গণ্ডগােলটা একটি ধর্মের মানুষের সঙ্গে অন্য ধর্মের মানুষের হয়। আর তা যখন রাজনৈতিক স্তরে পৌঁছোয়, তখন আমরা মানুষকে ভুলে যাই, কেউ হিন্দু, কেউ বা ইসলাম, কেউ খ্রিস্টান, কেউ বৌদ্ধ, কেউ বা জৈন ধর্মাবলম্বী।  এই জন্যই তাে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বভারতী স্থাপন করেছিলেন শান্তিনিকেতনে।

আমরা জানি রবীন্দ্রনাথ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরােপ গিয়েছিলেন। এটা ছিল দ্বিতীয় ইউরােপ ভ্রমণ। সেখান থেকে ফিরে এসেই তিনি একটি সভা ডেকেছিলেন। সেই সভার সভাপতি আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল জানিয়েছিলেন কবির মর্মকথা। বিশ্বভারতী সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ভাবনাটা ছিল– ‘বিশ্বভারতীর আক্ষরিক অর্থের দ্বারা আমরা বুঝি যে, ‘ভারতী’ এতদিন অলক্ষিত হয়ে কাজ করছিলেন। আজ তিনি প্রকট হলেন। কিন্তু এর মধ্যে আর একটি ধ্বনিগত অর্থ আছে– বিশ্ব ভারতের কাছে এসে পৌছবে, সেই বিশ্বকে ভারতীয় করে নিয়ে আমাদের রক্তরাগে অনুরঞ্জিত করে, ভারতের মহাপ্রাণে অনুপ্রাণিত করে আবার সেই প্রাণকে বিশ্বের কাছে উপস্থিত করব।’

ভাবলে অবাক হয়ে যেতে হয় রবীন্দ্রনাথ এইরকম কথা বলতে কোন দর্শনে পৌছে গিয়েছিলেন। বিশ্ব ভারতের কাছে এসে পৌঁছবে, ভারত থেকে গােটা বিশ্ব প্রাণবায়ু নেবে। অনুরঞ্জিত বিশ্ব আবার প্রাণবায়ু সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেবে। তাই তাে রবীন্দ্রনাথ ধর্মীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে বিশ্বভারতী পরিচালনা করেছিলেন। হিন্দু সংহিতার বিরােধিতা করে বিশ্বভারতীতে সকল সম্প্রদায়ের মানুষের বিদ্যাচর্চার পথ সুগম করেছিলেন।


এখন প্রশ্ন, ধর্ম কী? ব্যুৎপত্তিগত অর্থের কথা বললে লিখতে হয় যা ধারণ করে। অর্থাৎ ধর্মীয় সর্বাঙ্গীন কল্যাণ করে যা, তাই ধর্ম। এর থেকে পরিষ্কার বােঝা যাচ্ছে অবাধ যাতায়াত রয়েছে সকলের কাছে অর্থাৎ যে ধারণ করে তার কাছে। আরও পরিষ্কার করে বললে বলা যাবে তা হল মনুষ্যত্ব। “পুষ্পকে আজ প্রাতঃকালে বলিতে হয়। নাই যে, ‘রজনী প্রভাত হইল– তুমি আজ প্রস্ফুটিত হইয়া ওঠ!’ ইহা দেখিয়া মনের মধ্যে এই আক্ষেপ জন্মে যে, আমার জীবন কেন বিশ্বব্যাপী আনন্দকিরণ পাতে এমনি সহজে, এমনি সম্পূর্ণভাবে বিকশিত হইয়া ওঠে না।” ‘মনুষ্যত্ব’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠিক এইরকম করেই মানুষের আত্মসৃজনের ব্যাখ্যা করেছেন। অনেকেই বলেছেন বেদের অনগমনই ধর্ম। একথা যদি সত্যি হয় তবে নিশ্চিতরূপেই ইসলাম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ বা জৈন এর কোনওটাই ধর্ম নয়। কিন্তু সবাই জানে এগুলি ধর্ম। এইসব ধর্মাবলম্বী মানুষের সংখ্যা পৃথিবীতে প্রচুর। আসলে পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষই ধর্মের সঙ্গে রিলিজিয়নকে একাকার করেছে। আমাদের ধর্ম রিলিজিয়ন নহে’। 

রবীন্দ্রনাথ ‘ধর্মপ্রচার’ প্রবন্ধে দীপ্ত কণ্ঠে একথা ঘােষণা করেছেন। রবীন্দ্রনাথের মতে ধর্ম মনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। স্বেচ্ছাচারিতার কোনও জায়গা নেই ধর্মের মধ্যে। ধর্ম আনন্দের সঙ্গে যুক্ত, অনুভুত। নিভৃত সাধনার মধ্যে দিয়ে ধর্ম সার্থকতা লাভ করে। আর রিলিজিয়নের। মধ্যে রয়েছে নির্দিষ্ট বিশ্বাস বা আস্থার সমষ্টি, যা কিনা বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে অসহিষ্ণুতার ইতিহাস গড়ে তােলে। আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না, পৃথিবীতে আজ মানুষে মানুষে যে বিরােধ, হানাহানি, যুদ্ধ তা শুধু রিলিজিয়নের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে। ধর্মের মহৎ উদ্দেশ্য না বােঝার কারণে। বৃহৎ অর্থে না দেখে ধর্মকে দেখা হয়েছে সংকীর্ণ অর্থে, রিলিজিয়নের সঙ্গে এক করে। রবীন্দ্রনাথ কখনওই সংকীর্ণ অর্থে ধর্মকে দেখেননি। তিনি বুঝেছিলেন, ধর্ম হল ঐহিক ও পারমার্থিক প্রাপ্তির মাধ্যম।

রবীন্দ্রনাথের মতে ধর্মের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্ব হল ঔপনিষদ ভিত্তিক। এই সাধনাতেই তিনি শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তৃতীয় পর্বে রয়েছে ব্রহ্মভাবনা উপলব্ধির বিষয়টা। এর ফলে তিনি লিখে দিলেন ‘শান্তিনিকেতন’ গ্রন্থ। চতুর্থ পর্বে রয়েছে মগ্নতা। এখানে তাঁর ধর্ম ভাবনায় যুক্ত হয়েছে বহির্বিশ্ব এই পর্বেই তিনি অনুভব করেছেন বাইরের কোনও কিছুর মধ্যেই মনের মানুষ নেই। সে আছে নিজ নিজ অন্তরে। অর্থাৎ মন্দির, মসজিদ বা গির্জা নয়— মনের মানুষের অবস্থান মনেই বলা যায়, এখান থেকেই তিনি ধর্মবােধে যাবার চুড়ান্ত পথ খুঁজে পেয়েছিলেন। ‘গীতাঞ্জলি’র গান তাে তিনি এই পর্বেই লিখেছিলেন। নােবেল পাবার সময় থেকেই রবীন্দ্রমননে বিশ্ববােধের সমন্বয় হয়েছিল। আর পঞ্চম পর্বে দেখা গেল মানব ধর্মের (দ্য রিলিজিয়ন অফ ম্যানে) কথা।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি যে হিবার্ট বক্তৃতা দিয়েছিলেন তার থেকেই এই ভাবনার সূচনা হয়েছিল বলে বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন। ষষ্ঠ ও শেষ পর্বের কথা হল মানব ধর্মের সাধনা। হিন্দু, ইসলাম, বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান নয়, মানুষের ধর্ম হল মানব ধর্ম, যা এককথায় শুভ, কল্যাণকর, মঙ্গলময়। এদিকে মানুষ অন্যদিকে মানুষের ধর্ম। একটি ছাড়া অন্যটির কোনও অতিত্ব নেই। তিনি এই পর্বের অনেক আগেই গ্রন্থে স্পষ্ট বলেছেন– “…মানুষের আর একটি প্রাণ আছে, সেটা শরীর- প্রাণের চেয়ে বড়াে…। এই প্রাণের ভিতরকার সৃজনীশক্তিই হচ্ছে তার ধর্ম।… মানুষের ধর্মটি হচ্ছে তার অন্তরতম সত্য।”

প্রশ্ন জাগতেই পারে, রবীন্দ্র মনে কে বা কারা এই ধর্মবােধের সুচনা করেছিলেন? উত্তরে বলা যায়, অবশ্যই বিদেশি মানবতাবাদ। কারণ তিনি কোনও কালেই মহর্ষি শ্রীরামকৃষ্ণ বা শ্রীঅরবিন্দর মতাে সাধক ছিলেন না। তাঁদের ধর্মবােধ রবীন্দ্রনাথকে নাড়া দেয়নি। তবে একথা ভুলে গেলে চলবে না, তাঁর ধর্ম ভাবনা জুড়ে ছিল হৃদয়-অনুভূতি, উপলব্ধি ইত্যাদি। এগুলি তাঁকে মানবক্ষুদ্রতাকে অতিক্রম করিয়েছিল। ফলস্বরূপ তিনি পেয়েছিলেন অখণ্ড চেতনা অনুসন্ধান করার এক অমােঘ শক্তি। তা ছাড়াও রাজা রামমােহন রায়ের মানবকেন্দ্রিক দর্শন রবীন্দ্রমানসে যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছিল। রামমােহনই তাে সর্বপ্রথম গতানুগতিক ধারণাতে নাড়া দিয়েছিলেন। মানুষকে নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছিলেন। ‘থেমে যাওয়া’ নয়, ‘এগিয়ে চলা’র মধ্যেই রয়েছে স্বতঃস্ফুর্ততা। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন– “যে নদী হারায়ে স্রোত চলিতে না পারে / সহস্র শৈবালদাম বাঁধে আসি তারে / যে জাতি জীবনহারা অচল অসাড় / পদে পদে বাঁধে তারে জীর্ণ লােকাচার।”

বলতে বাধা নেই, রবীন্দ্রপুর্বে রামমােহনই প্রথম রিলিজিয়নের সঙ্গে ধর্মের পার্থক্য সূচিত করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে আরও স্পষ্টতা দেন। শুধু রামমােহন কেন? রবীন্দ্রনাথের মনে ধর্মবােধ জাগাতে রামমােহন ছাড়াও বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র এবং তাঁর বাবা স্বয়ং মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রভাব স্পষ্ট। সত্যেন্দ্রনাথ রায় তাঁর ‘ধর্মচিন্তা: রবীন্দ্ররচনা সংকলন’ গ্রন্থের ভূমিকায় জানিয়েছেন, “রামমােহনের স্বাধীন বুদ্ধি, নব্যবঙ্গের তরুণদের প্রখর যুক্তি, উদ্ধত অবিশ্বাস, বিদ্যাসাগর-অক্ষয়কুমার দত্তের মুক্ত বুদ্ধি, দেবেন্দ্রনাথের আত্মপ্রত্যয়সিদ্ধ অনুভূতি, বঙ্কিমচন্দ্রের যুক্তিবাদ, দেশী ধ্রুববাদ, বিজ্ঞানমুখিতা– এই শতসমুদ্র ধারার পরিমণ্ডলে রবীন্দ্রনাথের ধর্মচিন্তার উন্মেষ।”

আমাদের সকলের মনে একটা ধারণা আছে পুজো-আচ্চা, বিধিনিষেধ ইত্যাদির মুলে আছে ধর্ম। পুরােহিত, মৌলবী প্রমুখ ধর্মীয় বিধিনিষেধ মেনেই সমাজ সংস্কারে ধর্মীয় কাজ সারেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যে ধর্মে বিশ্বাস করতেন সেটা কোনওভাবেই বিধি-নির্ভর নয়। সেটা অবশ্যই প্ৰীতি-নির্ভর। যােগবশিষ্ট রামায়ণে বলা হয়েছে, হৃদয়ের দুই মুখ। একটির অভিমুখ কল্যাণপথে অন্যঢ়ি অকল্যাণের দিকে। ‘রক্তকরবী’ নাটকেও রবীন্দ্রনাথ রাজা চরিত্রের মধ্যে দিয়ে মানুষের দুটি সত্তার কথা বলেছেন। তাঁর মতে, একই দেহে রাম ও রাবণের উপস্থিতি । যেখানে অকল্যাণ পিছনে ফেলে কল্যাণের পথে এগিয়ে যাওয়ার মধ্যেই রয়েছে ধর্মের অবস্থান। আর সেটি আসে প্রেমের পথে, প্রীতির পথে। তাই যেসব বিধি প্রীতিহীন তার সঙ্গে ধর্মের কোনও যােগ দেখতে পাননি রবীন্দ্রনাথ।

ধর্মীয় কোনও উত্তেজনাকে গুরুত্ব দেননি তিনি। তাঁর মনে হয়েছিল যে, কোনও ধরনের ধর্মীয় উত্তেজনা সমাজের মধ্যে উগ্রতা ছড়ায়। সমাজকে সংকুচিত করে। সমাজকে রূপান্তরিত করে অচলায়তনে। এই প্রসঙ্গে তিনি আকবরের আদর্শের কথা বলেন– “আকবর সকল ধর্মের বিরােধ ভঞ্জন করিয়া যে একটি প্রেমের ঐক্য স্থাপনের চেষ্টা করিয়াছিলেন তাহা ভাবাত্মক। তিনি নিজের হৃদয় মধ্যে একটি ঐক্যের আদর্শ লাভ করিয়াছিলেন, তিনি উদার হৃদয় লইয়া শ্রদ্ধার সহিত সকল ধর্মের অন্তরে প্রবেশ করিয়াছিলেন। তিনি একাগ্রতার সহিত, নিষ্ঠার সহিত, হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান-পারসি ধর্মজ্ঞদিগের ধর্মালােচনা শ্রবণ করিতেন ও তিনি হিন্দু রমণীকে অন্তঃপুরে, হিন্দু অমাত্যদিগকে মন্ত্রিসভায়, হিন্দু বীরগণকে সেনানায়কের প্রধান আসন দিয়েছিলেন। তিনি কোনও রাজনীতির দ্বারা নহে, প্রেমের দ্বারা সমস্ত ভারতবর্যকে, রাজা ও প্রজাকে এক করিতে চাহিয়াছিলেন।”

রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, মানুষ যে দেশে বাস করে সে দেশের কোনও ভৌগােলিক সীমা নেই। তার কারণ মনকে কখনওই ভৌগােলিক সীমা দ্বারা আটকানাে যায় না। মনের অবস্থান এখন এদেশে তাে পরক্ষণেই ভিন দেশে। তাই তিনি বলতে চেয়েছেন মানুষের দেশ, মানসিক সীমায় প্রসারিত।

রবীন্দ্রনাথ মনে করেছেন, কোনও ধর্মই তাই মানুষের মনকে একে অন্যের থেকে আলাদা করতে পারে না। সকল মনের মধ্যেই রয়েছে একটি ঐক্য। তিনি লিখেছেন– “সমস্ত মানুষকে নিয়ে আছে একটি বৃহৎ ও গভীর ঐক্য। সেই ইন্দ্রিয়বােধাতীত ঐক্য সাংখ্যিক সমষ্টিকে নিয়ে নয়, সমষ্টিকে অতিক্রম করে। সেই ইচ্ছে সমস্তের একে গূঢ় আত্মা, একধেবানুদ্রষ্টব্য ; কিন্তু বহুধাশক্তিযােগে তার প্রকাশ। সেই ঐক্য বা মানবব্রহ্মা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হােক বা না হােক, তিনি অবিভাজ্য, তাকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বতন্ত্র সত্তায় বিভক্ত করা যায় না। দেশকালের সীমায় সীমিত যে খণ্ড খণ্ড মানবসত্তা বা ব্যক্তি-সত্তা, বাইরের পরিচয়ে তাদের মধ্যে প্রভেদ যতই বিচিত্র বা গভীর হােক কেন, আত্মিক সততায় তারা এক; কারণ, তারা ঐ পরম একে আশ্রিত।”

বলার অপেক্ষা রাখে না, রবীন্দ্রনাথ সবসময়ই মানব ঐক্যের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। মানুষের সভ্যতা, সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি, ধর্মতত্ত্ব সবকিছুকে তিনি সত্যের আদর্শে বিচার করার কথা বলেছেন।

আমাদের একটাই দেশ। তা হল বিশ্ব। একটাই জাতি, তা হল মানুষ। একটাই ভাষা, তা হল মানব ভাষা। একটাই ধর্ম তা হল মানবধর্ম। এখানেই প্রশ্ন আসে, তবে পৃথিবীতে কেন ভাষার জন্য, ক্ষমতার জন্য, ধর্মের জন্য এই হানাহানি? এত রক্তপাত? একথা প্রথমেই আসে যে, ভারতের প্রধানত দুটি সমস্যা তা হল ভাষাগত এবং ধর্মগত। আমরা কখনওই ভাবতে পারছি না, মাতৃভাষা ছাড়াও অন্যান্য ভাষা আমার ভাষা। কখনওই ভাবতে পারছি না নিজের ধর্ম ছাড়া অন্য মানুষের ধর্ম (রিলিজিয়ন) আমাদের ধর্ম। আমাদের মূলে রয়েছে সমতার অভাব, সমস্যা সমাধানের প্রতি অনীহা। রবীন্দ্রনাথ মনে করেছেন, সকল মানুষের উপলব্ধি সমান নয়। মানুষের মনের বিকৃতিই কাজ করছে রক্তপাত হানাহানির মূলে। তিনি লিখেছেন– “আপনাকে তখন টাকায় দেখি, খ্যাতিতে দেখি, ভােগের আয়ােজনে দেখি। এই নিয়েই তাে মানুষের যত বিবাদ, যত কান্না, মানুষের মানবসত্তা সম্পর্কে এ ধরনের বিকৃত বােধই জাতিতে জাতিতে শত্রুতা, শ্রেণিতে শ্রেণিতে সংঘাত, শােষণ, অত্যাচার ইত্যাদি যাবতীয় জাগতিক সমস্যার মূলে।”

রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন মানবিকতা বােধ শুধুমাত্র ভৌগােলিক সীমায় সীমাবদ্ধ নয়। সকল শ্রেণির মানুষের মধ্যে তা প্রসারিত হওয়ার মধ্যেই রয়েছে বিশ্ব মানবিক ভাবনা। মানুষকে বড় করে দেখার মধ্যেই রয়েছে মানুষের সার্থকতা। তিনি ভাবের ঐশ্বর্য দিয়ে মানুষকে বিচার করেছেন। চিত্তের ঐশ্বর্যে মানুষকে চিহ্নিত করেছেন। যেখানেই মনুষ্যত্বের দীনতা সেখানেই তিনি বেদনা পেয়েছেন। আর দীনতা বলতে তিনি কখনওই বােঝাননি অর্থনৈতিক দীনতাকে। মনুষ্যত্বের দীনতাই মানুষকে ক্রমশ খর্বকরে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন–

“আপনাকে যে খর্ব করে সে যে কেবল নিজেকেই কমিয়ে রাখে তা নয়, মােটের উপর সমস্ত মানুষের মূল্য সে হ্রাস করে। কেননা, যেখানেই মানুষকে আমরা বড় দেখি সেখানেই আপনাকে বড় বলে চিনতে পারি– এই পরিচয় যত সত্য হয় নিজেকে বড় রাখবার চেষ্টা মানুষের পক্ষে তত সহজ হয়।”

যাঁরা পৃথিবীর বুকে অপাঙক্তেয়, যাঁরা সভ্য মানুষের কাছে নিরাশ্রয় তাঁদেরকে তিনি তাই আপন করে নিয়েছেন। নাম লিখিয়েছেন তাঁদের দলে। স্বদেশ বিদেশ আলাদা না করে তাঁদের দুঃখে তিনি দুঃখী হয়েছেন। তাঁদের সুখে হয়েছেন সুখী। বিভিন্ন কবিতায় বার বার ধ্বনিত হয়েছে সেই কথা– “হে চিরকালের মানুষ, হে সকল মানুষের মানুষ, পরিত্রাণ করাে ভেদচিহের তিলক-পরা সংকীর্ণতার ঔদ্ধত্য থেকে। হে মহান পুরুষ, ধন্য আমি, দেখেছি তােমাকে তামসের পরপার হতে আমি ব্রাত্য, আমি জাতিহারা।”

এখানে কোথায় রয়েছে হিন্দুর কথা? কোথায় রয়েছে মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান বা জৈনদের কথা। রয়েছে মানুষের কথা। এখানেই খোঁজ মেলে তাঁর বিশ্বমানবতাবােধ , বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববােধ, বিশ্ব মানব ঐক্যবােধের এবং মানব ধর্মের ধারণায় তাঁর দৃষ্টিতে একাকার হয়ে গেছে বেদ, উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারত, কোরাণ, বাইবেল, ত্রিপিটক। মৌলবাদকে কখনওই তিনি গুরুত্ব দেননি। ধর্মের নাম করে যেসব মানুষ সারা পৃথিবীতে হিংসার আগুন ছড়িয়েছে তাদেরকে তিনি ধিক্কার জানিয়েছেন। আনন্দ-জগতের সন্ধান পাবার লক্ষ্যে তিনি বারবার ব্যক্তি-স্বার্থের জগৎকে অতিক্রম করার কথা বলেছেন। আত্মার সঙ্গে অনাত্মার যােগ সাধন করার কথা ভেবেছেন। পাশাপাশি নিজের মধ্যে সত্যকে খুজতে বলেছেন। মনের মানুষের সন্ধান করেছে। বিশ্ব আমিকে পাবার জন্য ক্ষুদ্র আমির বিসর্জন চেয়েছেন। ‘ধর্মের সরল আদর্শ’ প্রবন্ধের কয়েকটি পঙক্তি এখানে যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক। তিনি লিখেছেন– “আমি একদা একখানি নৌকায় একাকী বাস করিতেছিলাম। একদিন সায়াহ্নে একটি মােমের বাতি জ্বালাইয়া পড়িতে পড়িতে অনেক রাত হইয়া গেল। শ্রান্ত হইয়া যেমনি বাতি নিবাইয়া দিলাম, অমনি এক মুহুর্তেই পূর্ণিমার চন্দ্রালােক চারিদিকের মুক্ত বাতায়ন দিয়া আমার বক্ষ পরিপূর্ণ করিয়া দিল।… এই অপরিমেয় জ্যোতিঃসম্পদ লাভ করিবার জন্য আমাকে আর কিছুই করিতে হয় নাই, কেবল সেই বাতিটি এক ফুঙ্কারে নিবাইয়া দিতে হইয়াছিল।”

এই আলােচনার সূচনায় ছিল বিশ্বভারতীর কথা। শেষও করব বিশ্বভারতী দিয়েই। আমরা সবাই জানি, ‘বিশ্বভারতী’ কোনও স্থান, ব্যক্তি, সম্প্রদায় বা ধর্ম, নাম নয়। এটা একটা আইডিয়া। রবীন্দ্রমননে এই আইডিয়া একদিনে আসেনি। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ ও তার থেকে অর্জিত অভিজ্ঞতা রবীন্দ্রনাথকে এই জায়গায় এনেছিল। রবীন্দ্রনাথ এই বিশ্বভারতীর নামক দীপটি প্রজ্জ্বলিত করার আগে দীর্ঘদিন ধরে সলতে পাকিয়েছিলেন। এর বীজ বপন করেছিলেন তিনি সেই চল্লিশ বছর বয়সে। ‘ব্রহ্মচর্যাশ্রম’ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার মধ্যে দিয়ে। এই বিদ্যালয়কে বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত করার নিরিখেই তাঁর বিদেশ যাত্রা। আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলি দেখেই তাঁর মনে সঞ্চারিত হয়েছিল ‘বিশ্বভারতী’ বােধ। ১৯১৬ সালে পুত্র রথীন্দ্রনাথকে একটি চিঠিতে আমেরিকা থেকে তিনি লিখেছিলেন– “শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়কে বিশ্বের সঙ্গে ভারতের যােগের সূত্র করে তুলতে হবে– ওইখানে সার্বজাতিক মনুষ্যত্বচর্চার কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে– স্বজাতিক সংকীর্ণতার যুগ শেষ হয়ে আসছে– ভবিষ্যতের জন্যে যে বিশ্বজাতি মহামিলনযজ্ঞের প্রতিষ্ঠা হচ্ছে তার প্রথম আয়ােজন ঐ বােলপুরের প্রান্তরেই হবে।”

সকল বাধা পেরিয়ে অবশেষে প্রতিষ্ঠিত হল ‘বিশ্বভারতী’। বিশ্ব মানুষ বুঝতে পারল বিশ্বমানবতাবােধ মানেই ‘বিশ্বভারতী’। ধর্ম এখানে সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকল না। সব ধর্ম এক হয়ে গেল। সে ধর্ম মানবধর্ম। তিনি লিখলেন ‘ঐ মহামানব আসে’।