চন্দ্রাণী বসু
বুধবার, স্কুলের থার্ড পিরিয়ড। আমার পাশের ক্লাসটাই ‘ফাইভ-সি’-এর ঘর। অঙ্কের ক্লাস। আর ফাইভ-সি-তে এই পিরিয়ডে অঙ্ক ক্লাস নেন মন্দিরাদি। মন্দিরা মুখোপাধ্যায়। ভীষণ সিরিয়াস টিচার। বয়স পঞ্চান্ন। চেহারা এবং মেজাজ— দুইয়েই রাশভারী। বাচ্চারা টুঁ শব্দ করার সুযোগ পায় না ওঁর ক্লাসে। তবে সেইজন্যই আমাদের স্কুলের ভীষণ সুনাম আছে। অঙ্কে প্রতিবছর যে দশ-বারো জন মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকে একশোতে একশো পায়, তার সমস্ত অবদান সত্যিই মন্দিরা দিদির। মিথ আছে, এই স্কুলে পড়লে অঙ্কে কেউ কখনও নাকি ফেল করে না।
কিন্তু আজ থার্ড পিরিয়ডের শুরু থেকেই ওই ঘরে একটা বিশৃঙ্খলতার আওয়াজ আসছিল, যেটা খুবই বিস্ময়কর। আর মাঝসময়ের পর তো বাচ্চাদের চূড়ান্ত আওয়াজ। পাশে ক্লাস করতে অসুবিধা হচ্ছিল বলে বেরিয়ে দেখতে গিয়েই দেখি মন্দিরাদি ক্লাসে নেই। আর ক্লাসে টিচার না থাকলে বাচ্চারা যা যা করে, তাই হচ্ছে।
এ তো আরও বিস্ময়কর ঘটনা! মন্দিরাদি ক্লাসে নেই? হলটা কী! মন্দিরাদির কি শরীর খারাপ?
বাচ্চাদের এক ধমক দিলাম। ওরা কিছুটা চুপ করল।
আমাদের স্কুলটা ইউ প্যাটার্নের তিনতলা। মাঝখানটা মাঠ। নীচের তলায় মূলত তিনটে ল্যাব, স্টাফরুম, টিচার্স রুম, হেডমাস্টার রুম, লাইব্রেরি, রান্নাঘর, ডাইনিং, গেমস রুম— এইসব। ক্লাস সব দোতলা আর তিনতলায়। দোতলার বারান্দা থেকে ওপাশের টিচার্সরুমটা দেখা যায়। বারান্দা থেকে একবার উঁকি মারলাম ওই দিকে। টিচার্স রুমের সামনে তো কিছুই অস্বাভাবিক চোখে পড়ল না।
কিন্তু মন্দিরাদি ক্লাস ছেড়ে গেল কোথায়? স্কুলে ফোন নিয়ে ক্লাসে আসা নিয়ম নয়। তাই সেটাও তো কাছে নেই।
বাকি সময়টুকু ক্লাস করালেও মনটা খচখচ করতেই লাগল আর অপেক্ষা রইল ঘন্টা পড়ার।
ক্লাস শেষের ঘন্টা পড়তেই তাড়াহুড়ো করে নেমে এলাম নীচে। সিঁড়ি দিয়ে যাঁরা একসঙ্গে নামলাম সবাই খেয়াল করেছে ব্যাপারটা। উদ্বেগ সবারই ছিল।
টিচার্স রুমে ঢুকে দেখলাম বড় এক কাপ চা নিয়ে মন্দিরাদি জানলার ধারে দাঁড়িয়ে মাঠের দিকে দেখছে। কিছু বাচ্চা খেলা করছে।
যাঁরা টিচার্স রুমে আগে থেকেই ছিলেন তাঁরাও চুপ। জিজ্ঞাসা করার সাহস পায়নি কেউ। শুধু শুনলাম ক্লাস চলাকালীন মাঝ সময়ে বের হয়ে এসে কিছুক্ষণ বসেছিলেন। তারপর খুব আস্তে আস্তে বলেছেন, ‘দুই আর দুইয়ে চার মিলিয়ে অঙ্ক শিখিয়ে গেলাম, জীবনের অঙ্ক বড্ড গোলমেলে ভাই, মিলছে না, হিসেব মিলছে না।’
তারপর একাই চা বানিয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ঠায় ওই জানালার পাশে।
সবার ধারণা ক্লাসেই কিছু একটা হয়েছে, কিন্তু মনে হল ওঁকে ওঁর মতই থাকতে দেওয়া উচিত। যদি কিছু বলার হয়, তো নিশ্চয় তিনিই বলবেন। পরের ক্লাস ছিল, ফলে সবাই যে যার মত ক্লাসে চলে এলেও মন বসল না কারুরই।
আমার বারবার জানলায় কাপ হাতে দাঁড়ানো মন্দিরাদির চেহারাটা মনে পড়ে যাচ্ছিল। তিনকুড়ি হতে আর পাঁচ বাকি কিন্তু দীর্ঘাঙ্গী মন্দিরাদির শরীর মেদহীন। চুলে পাক ধরলেও কখনওই রঙ লাগাননি। এখনও একটি মোটা বিনুনি কোমর ছাড়িয়ে যায়। মাঝে মাঝেই মাথার একধারে ফুল লাগান তিনি। সবসময় কিছু না কিছু কাজ করে চলেন, কিন্তু আজ বিষণ্ণ কর্মহীন দেখতে ভালো লাগছিল না।
আমার এখনকার ক্লাস ওই ফাইভ-সি তেই। আজ ওরাও কেমন একটু থমকে আছে। মাঝেমাঝেই গুজগুজ করে একটা কথা এদিক থেকে ওদিক আর ওদিক থেকে এদিক করছে। এত অস্পষ্ট সে ধ্বনি, আমার কান সজাগ করেও অর্থ উদ্ধার করতে পারছি না।
কোনওরকমে ভূগোলের একটা সহজ অধ্যায় পড়িয়ে ক্লাস শেষের অপেক্ষা করছিলাম। ঢং ঢং টিফিনের ঘন্টা পড়তেই ওরা ছুটল থালা নিয়ে আর আমি নীচে নামতে শুরু করলাম। কেমন একটা অস্বস্তি করছে, আদৌ কি মন্দিরাদি কিছু বলবে? নাকি কিছুই হয়নি!
যে যার মত টিফিন বক্স খুলে সবাই খাওয়া শুরু করলেও টিচার্স রুমে কোথাও একটা সুর কেটে যাওয়া পরিবেশ। রোজকার মতো হুল্লোড় নেই। সুরম্যাদি গলা ছেড়ে রোজকার মত গান গাইছে না, অনিমা একা একাই খবরের কাগজটা নিয়ে শব্দছক করছে টেবিলের উপর ফেলে, প্রতিদিনের মত একে ওকে চিৎকার করে শব্দের মানে জানতে চাইছে না। অন্যের টিফিন বাক্সে উঁকিঝুঁকি বন্ধ, ভাগাভাগিও নেই।
মন্দিরাদিই মুখ খুললেন শেষে, ‘জানি আজ আমার আচরণে সবাই খুব অবাক হয়েছ। আমি ক্লাস ছেড়ে চলে আসার জন্য পূরবীদির কাছে আগেই ক্ষমা চেয়ে এসেছি যদিও, তবুও তোমাদের কৌতূহল নিবারণ করার দায়ও আমারই।
—‘কী হয়েছে মন্দিরাদি?’ অনিমা বলেই ফেলল।
—‘আহ! মেয়েটা তো বড় চঞ্চল! ছাত্ররা কী শিখবে? ধৈর্য ধরো।’
মন্দিরাদির ধমকে অনিমা আবার শব্দছকে মন দিল।
মন্দিরাদি বলতে শুরু করলেন, ‘ওই জানলা দিয়ে দেখো, মাঠভর্তি ছাত্রছাত্রী। ওদের লাভ ক্ষতি, সুদ আসল শেখাতে শেখাতেই জীবনের অর্ধেকের বেশি পার করে দিলাম। কিন্তু আজ আমি বড় দ্বিধায়, জীবনের অঙ্ক বদলে ফেললাম কি?’
—‘মন্দিরাদি শান্ত হন। কী হয়েছে খুলে বলুন।’ সুরম্যা ধীরে ধীরে বলল।
—‘আমার ছোটোবেলায় বাড়িতে আমার পরে তিনটে ছোটো ভাইবোন ছিল। আমাদের বুনিয়াদি স্কুলে তখন পাঁউরুটি দেওয়া হত। আমার পাঁউরুটি খেলে বমি হত। প্রতিদিন আমি পাঁউরুটি বাড়ি আনতাম আমার ভাই-বোনেদের জন্য।’
—‘হ্যাঁ হ্যাঁ। মনে আছে আমি তো আবার অর্ধেক খেয়ে অর্ধেক বোনের জন্য আনতাম।’ আমি বলে উঠলাম।
—‘জানো অমৃতা, আমার অনেক বন্ধুরাই
তা-ই করত। যাদের ভাই-বোনেরা তখনও স্কুলে ভর্তি হয়নি তাদের জন্য অর্ধেক বাড়ি নিয়ে যেত। কেউ সকালে খেয়ে আসেনি বললে, তাকে আমরা দিয়ে দিতাম। কিন্তু আজ…’
—‘আজ কী ?’
—‘আজ বড় দ্বন্দ্বে পড়েছি। অঙ্ক ভালো শেখাই বলে যে সুনাম আমি এত বছর ধরে অর্জন করেছি, বজায় রেখেছি, তাতে আজকের ঘটনা সফলতার পালক গোঁজে, নাকি আসলে ষোলো আনাই বৃথা? হিসেব কিছুতেই মেলাতে পারছি না। এ বড্ড কঠিন অঙ্কের সামনে আজ দাঁড়িয়ে আছি।’
কথা বলতে বলতেই মন্দিরাদি উঠে গেলেন দরজার সামনে। একটি ছেলেকে হাত নেড়ে ডেকে তাকে ফাইভ-সি ক্লাসের ছ’টা, সাতটা ছেলেমেয়ের নাম বলে টিচার্স রুমে পাঠিয়ে দিতে বললেন।
টিচার্স রুমে তখন পিন-ড্রপ-সাইলেন্স। তিনটি ছেলে, দু’টি মেয়ে মুখ কাঁচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মন্দিরাদি প্রশ্ন করলে একটি মেয়ে মৃদু গলায় উত্তর দিচ্ছে। বাকিরা চুপ।
—‘কত টাকা নিয়ে আজ এসছিলে স্কুলে?’
—‘ম্যাম পঁচিশ টাকা।’
—‘বাড়ি থেকে কি না বলে নিয়ে এসেছ?’
—‘না, দাদুর কাছ থেকে চেয়ে। ফেরত দিয়ে দেব বলেছি।’
—‘তোমরা ক’ জন বাড়ি থেকে এনেছ টাকা?’
—‘তিনজন, আমরা যারা ডিম খাই না। রীতা, অনিমেষ আর আমি।’
—‘আর ওরা ?’
—‘ওরাও ডিম খায় না। আমাদের দিয়ে দেয়।’
—‘দিয়ে দেয় ? নাকি তার বদলে টাকা নেয়?’
—‘টাকা নেয়।’
—‘কত টাকা ?’
—‘পাঁচ।’
—‘এই তোরা টাকা দিয়ে কী করিস ?’
—‘দিদিমণি পাঁচ টাকা নিয়ে ঘুঘনি আর ফুচকা খাই। ঘুঘনি কাকু আর ফুচকা কাকুকে জিজ্ঞাসা করুন।’
এতক্ষণ যারা চুপ করে দাঁড়িয়েছিল তাদের মধ্যে থেকে একজন বলে উঠল।
—‘আর তোরা ডিম কিনে নিয়ে কী করিস, বল সবাইকে।’
—‘আমরা তো ডিম খাই না। ওরাও খায় না, তাই…’
—‘তাই কী? বল?’
—‘দাদারা তো খাবার পায় না।’
—‘সেটা কি তোর দেখার দায়িত্ব ?’
—‘ওরা তো বলে, তোদের কী মজা, তোরা ডিম পাস, আমরা নাইনে উঠে আর পাই না, খাবারও পাই না। তাই আমরা তো খাই না, সেটাই…’
—‘কী করিস বল?’
—‘ওদের খেতে দিয়ে দিই।’
—‘খেতে দিস না, বল বিক্রি করিস।’
—‘হ্যাঁ।’
—‘কত টাকা দেয় দাদারা?’
—‘সাত টাকা, আট টাকা… যেদিন যা থাকে।’
—‘কে কে নেয়, নাম বল।’
—‘না, ম্যাডাম। নাম বলতে পারব না দাদাদের।’
—‘কেন?’
—‘ওরা আমাদের মারবে, আর মাঠে খেলায় নেবে না।’
—‘এই করে কত টাকা পাস?’
—‘চারটে ডিম জোগাড় হলে, বুধবার করে আট টাকা দশ টাকা পাই। যে টাকা বাড়ি থেকে আনি, সেটা ফিরিয়ে দিই বিকেলে।’
—‘আর এই টাকা দিয়ে কী করিস ?’
—‘আচার খাই। আর জমিয়ে রেখে স্টিকার কিনি, লাট্টু কিনি।’
নিস্তব্ধ টিচার্স রুমে কথাগুলো যেন সব দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে নিজেদের কানে ফিরে আসছে। ততক্ষণে পূরবীদি, মানে আমাদের স্কুলের বড়দি মন্দিরাদির পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। তিনিই হাত নেড়ে ছেলেমেয়েগুলোকে চলে যেতে বললেন।
এবার মন্দিরাদির সামনে এসে তিনি বসলেন। মন্দিরাদি বললেন, ‘লাভ ক্ষতির অঙ্ক তো আমিই শিখিয়েছি পূরবীদি?’
—‘বেশ করেছ শিখিয়েছ। জীবন ধারণের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজন তো অর্থ রোজগার।’
—‘হয়তো ঠিক। তাহলে তো আমার খুশি হওয়ার কথা। তাই না? ওদের কোথাও শাস্তি দেওয়ার মত কারণ খুঁজে পেলাম না, ভুল বলার মতোও তো জায়গা নেই। তবে কেন আমি মানতে পারছি না? আমার মনে হচ্ছে কেন, যে আমি আসলে অসফল?’
—‘মন্দিরা, তুমি অঙ্ক শিখেছ কিন্তু হিসেব মেলাতে পারোনি। আমিও পারিনি, আমরা বোধহয় কেউই পারিনি। আমাদের অঙ্ক খাতা আসলে অসম্পূর্ণ। শুধু লাভ নয়, অনেক ক্ষতিও লেখা আছে সবার জীবন খাতায়। ওদের খাতায় হয়তো লাভ লেখা থাকবে। শুধুই লাভ…।’