বিদ্যাসাগরের নন্দনকানন ও তাঁর বাসঘর : একটি আবেদন

বিহার বাঙালি সমিতি কর্মাটাঁড়ে বিদ্যাসাগরের নন্দনকাননকে আবিষ্কার, উদ্ধার থেকে আজ পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখার জন্য যে-সমস্ত উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, তাকে কেবলমাত্র প্রশংসনীয় বললে কম বলা হয়। শুধু বাহবা নয়, সাবাসিও দিতে হয় ওই সমিতির পরিচালকদেরকে।

তবুও নন্দনকাননের ভিতরে ঢুকলে ক্লিষ্ট হতে হয়। সে ব্যথা পাঁচিল ঘেরা কাননের ভিতরে বন্ধ হয়ে পড়ে থাকা বিদ্যাসাগরের দাতব্য হোমিও চিকিৎসালয়ের জন্য নয়। পরবর্তীকালে ‘বিশ্বকোষ পরিষদ’ ও রমলা চক্রবর্তীর ‘পথের পাঁচালী’-র সৌজন্যে গড়ে ওঠা ভগবতী ভবনের জন্য নয়। এমনকি বিদ্যাসাগর স্মৃতিরক্ষা কমিটির গড়া স্কুলটির ঝাঁপ বন্ধ হয়ে যাওয়ার জন্যও নয়। এখন ভগবতী ভবনের সামনে বাঁধা থাকে গরু। স্কুল ঘরে ছাগল পোষে নন্দনকাননের এককালের রক্ষক কার্তিক মণ্ডলের উত্তরসূরিরা। এগুলো দুঃখ দেয়, কষ্ট জাগায়। কিন্তু মর্মঘাতী পীড়ন করে না। সে-পীড়া দেয় বিদ্যাসাগরের বাসঘরখানা।

কেবল বাইরের ছবি দিয়ে নন্দনকাননের মধ্যস্থলে অবস্থিত বিদ্যাসাগরের বাসঘরের আসল চেহারাটা কখনোই বোঝা সম্ভব নয়। চাক্ষুষ দেখার বিকল্প হিসাবে একটি স্কেচের সাহায্যেই শুধুমাত্র ওই বাসভবনটির ভিতরদেহলীর আন্দাজ পাওয়া যায়। প্রায় সাড়ে তিন কাঠা জমির উপরে রয়েছে ভবনটি।


এই ভবনটি বিদ্যাসাগর নিজে নির্মাণ করেছিলেন, নাকি যে ইংরেজ মহিলার কাছ থেকে কিনেছিলেন তাঁদেরই নির্মিত; তা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন কেউ কেউ। তবে বিদ্যাসাগর তাঁর ‘নন্দনকানন’ যাঁর কাছে বিক্রি করেছিলেন, যাঁর নাম ভবনটির দেয়ালে এখনো শ্বেতপাথরের ফলকে উৎকীর্ণ রয়েছে, সেই ‘স্বর্গীয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর চরণাশ্রিত সিংহদাস মল্লিক’ বা ওই পরিবারের কেউ সংস্কার না-করে থাকলে ভবনটির অভ্যন্তরীণ গঠন-কৌশলকে ইংরেজি-শৈলী হিসাবে মেনে নিতে বাধা থাকে না। ভবনের উত্তর ও দক্ষিণ দু’দিকে দুটি দরজা। সদর ও খিড়কি। সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করলেই পা রাখতে হয় একটি হলঘরে। অনুমান, ঘরখানি বৈঠকখানা। মানুষের মুন্ডুটিকে হলঘর (ঘরখানি অবশ্য গোল নয়, আয়তাকার) ভেবে নিয়ে তার বাহুটি ঘাড়ের সমান্তরালে দুদিকে উঁচু করে ধরলে যেমন হয়, তেমনই বগল থেকে কনুই পর্যন্ত বৈঠকখানার দুদিকে সমান মাপের দুটি ঘর। এই ঘর দুটিকে বেডরুম বা বাসঘর বলে অনুমান করা শক্ত নয়। এরপর বাহু দুটি উঁচু রেখেই কনুই থেকে মধ্যমাঙ্গুষ্ঠ অবধি হাত দু’খানি সামনের দিকে বাড়িয়ে ধরলে যেমন হয়, সেরকম আদলেই ভবনটি এগিয়ে গিয়েছে দক্ষিণ দিকের পাঁচিল পর্যন্ত। সেখানে দুদিকেই রয়েছে চারটি করে ঘর। কনুই থেকেই প্রবেশযুক্ত ঘর দেখা যায় দুদিকেই। বাম দিকের ঘরখানিতে নিজেরই পালঙ্কে এখন থাকেন মর্মরনির্মিত নিষ্প্রাণ আবক্ষ বিদ্যাসাগর। ডান দিকের ঘরটি হয়তো পোশাক-আশাক রাখার ঘর হিসেবে ব্যবহৃত হত।

সদর দরজা দিয়ে ঢুকে বৈঠকখানার অন্দর দরজা দিয়ে দক্ষিণ দিকে বেরোনো যায়। বেরোলেই লম্বা-চওড়া বারান্দা। বারান্দার কোলে খিড়কির দরজাযুক্ত পাঁচিল দিয়ে ঘেরা উন্মুক্ত চবুতরা। বারান্দা বেয়ে যেতে হয় বাঁদিকের হাতল ঘরগুলিতে। প্রথমে খাবার ঘর। তার পুব কোলে পাশাপাশি আবার দুটি ঘর। একটি ভাঁড়ার, অন্যটি রন্ধনশালা। ডান হাতলের দক্ষিণ দিক থেকে প্রথমে রয়েছে ত্যাগযুক্ত-নিত্যকর্ম কক্ষ। এরপর স্নানঘর। তারই পাশে বারান্দার লাগোয়া আরেকটি কক্ষ। এই কক্ষটি সম্ভবত স্নান পরবর্তী সাজসজ্জার কাজে ব্যবহৃত হত।

বিদ্যাসাগরের এই বাসভবনটি ছাড়াও সমগ্র নন্দনকাননের বর্তমান কেয়ারটেকার জিতেন্দর মণ্ডল। কাননের ভিতরে বিদ্যাসাগর স্মৃতিরক্ষা কমিটি যে অতিথিশালা গড়ে তুলেছে, সেখানকার অতিথিদের আপ্যায়ন থেকে শুরু করে খাওয়া-দাওয়া, সুবিধা-অসুবিধা এবং অন্যান্য সমস্ত ব্যাপারের তত্ত্বাবধায়ক হিসাবে জিতেন্দর ও তার পরিবারের ভূমিকা অত্যন্ত ভালো। তবুও কিছু কথা থেকে যায়। জিতেন্দর গরিব মানুষ। কেয়ারটেকার হিসেবে তার বেতনও খুব বেশি নয়। অধিক বেতন দেওয়ার ক্ষমতাও নেই বিদ্যাসাগর স্মৃতিরক্ষা কমিটির। এই পরিস্থিতিতে সম্ভবত একরকম নিরুপায় হয়েই জিতেন্দরের স্ত্রী শ্রীমতী ঊষাকে ছাগলের চাষ করতে হয়। তাতে কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু সেইসব ছাগলের পাল রাত্রিবাস করে বিদ্যাসাগরের বাসভবনেরই দুটি ঘরে।

ছাগলের মূত্র ও নাদি ছড়িয়ে থাকে উক্ত দুটি ঘরে-চবুতরায়-বারান্দায়। অন্য একটি ঘরে থাকে জিতেন্দরের ছেলে। এগুলি বাঞ্ছনীয় নয়। সবই জানেন বিদ্যাসাগর স্মৃতিরক্ষা কমিটির সভাপতি দেবাশিস মিশ্র এবং সম্পাদক চন্দন মুখার্জি। কিন্তু তাঁরাও নিরুপায়। একমাত্র সরকারি আনুকূল্য এবং বিদ্যাসাগর-অনুরাগীদের সহায়তা ছাড়া নন্দনকাননের এই সার্বিক বিসদৃশ অবস্থা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। অথচ সব ঠিকঠাক ভাবে চললে এটা হয়ে উঠতে পারত একটি পর্যটন কেন্দ্র। হতে পারত বাঙালির তীর্থক্ষেত্র। অবশ্য বিদ্যাসাগর কেবল বাঙালির নন, কিন্তু সারাদেশের। তাই কেন্দ্রীয় সরকার ও ঝাড়খন্ড সরকারের কাছে আমাদের আবেদন, বিদ্যাসাগরের নন্দনকাননকে হেরিটেজ ঘোষণা করে অবিলম্বে অধিগ্রহণ করা হোক।