অমিয় আদক
অনন্ত দুয়ারি। ক্লাস সিক্সে পড়ে। তার বাবার চাষের জমি নেই। কেবল বাস্তুভিটেই পুঁজি। পাঁজর খোলা অভাবের সংসার তপনের। অনন্তর বাবা তপন। তপন অপরের জমিতে ক্ষেত মজুরের কাজ করে। রোজ মজুরের কাজ জোটে না। অনন্তর মা-ও কিছু রোজগারের চেষ্টা করে। প্রতিবেশীদের বাঁশের ঝাড় থেকে কঞ্চি কেটে আনে। সেই কঞ্চির পাতি থেকে ঝুড়ি, চুপড়ি ইত্যাদি তৈরি করে। অনন্ত মাকে সাহায্য করার জন্য খেলার মাঠে যেতে পায় না। খেলাকে সে বিলাসিতা ভাবতেই বাধ্য। মাকে কিছু সাহায্য করে। তাতেই সে খুশি।
অনন্ত নিয়মিত স্কুলে যায়। ফি বছর ভালোভাবেই পাশ করে। ক্লাসে ফার্স্ট, সেকেন্ড হয়তো হয় না। লেখাপড়ায় বেশি সময় দিতে পারলে, হয়তো হতে পারতো। সে নিজের পড়া নিজেই করে। মা মাঝে মাঝে কিছু বলে দেয়। তাতেই তার সমস্যা মিটে যায়। তার বাইরে কিছু জানার থাকেই। সেগুলো সে স্কুলের স্যার ম্যাডামদের কাছেই জেনে নেওয়ার চেষ্টা করে।
মায়ের সঙ্গে কঞ্চি কাটা, সরু কঞ্চি থেকে পাতি তোলা। সেগুলো গুছিয়ে রাখা এবং বেঁধে রাখার কাজেও সময় দেয়। ছুটির দিনে সে হাটেও যায়। মায়ের তৈরি ঝুড়ি, চুপড়ি বিক্রির জন্য। সকালে ঝুড়ি, চুপড়ি, খই চালুনি ইত্যাদি নিয়ে যায়। সব জিনিস বিক্রি হয় না। পাশের পাড়ার ভূষণ মাইতির আড়তে রেখে আসে। হিসেব মতো বিক্রির টাকাকে আয় হিসাবেই ধরে। কারণ, কঞ্চির জন্য টাকা-পয়সা লাগে না। তাদের দু’বেলার খাবার, সাধারণ জামাকাপড় কোনোক্রমে জোটে।
অনন্ত নিজেও কিছু জিনিস তৈরির চেষ্টায় থাকে। সেগুলো মানুষ প্রয়োজনে কিনবে না, তা জেনেই তৈরি করে। কঞ্চির থেকে তৈরি সরু পাতি নেয় কয়েকটা। সেগুলো দিয়ে প্রথম সে একটা ময়ূর বানানোর চেষ্টা করে। প্রথম চেষ্টায় ঠিক ময়ূরের আদল দিতে পারে না। সেজন্য সামান্য মন খারাপ। আবার চেষ্টা করে। সে পেখম ছড়ানো ময়ূর বানায়। তার লম্বা গলা। মাথায় ঝুঁটি। লম্বা পা’দুটিও সুন্দর। সে নিজেই অবাক। এতো সুন্দর কাজ সে করেছে! ময়ূরটা মাকে দেখায়।
তার মা দেখেই বলে, ‘দারুণ সুন্দর বানিয়েছিস। অনু তুই তো জাতশিল্পী রে! এই হাতের কাজের দাম দেওয়ার লোক গাঁ-গঞ্জে মিলবে না। ঠিক আছে, পড়াশোনা বাইরে বাড়তি সময়ে এমন জিনিস তৈরি কর। এখন অন্য কাউকে দেখাস না। এরকম আরও প্রাণী, পাখি, যানবাহন ইত্যাদি তৈরির চেষ্টা কর। তুই পারবি। সে বিশ্বাস আমার আছে। আশা করি তোর কাজের দাম তুই পাবি।’
মায়ের কথায় অন্তরে উদ্দীপনা। উদ্দীপনায় সে নতুন সৃষ্টির ভাবনায় পাগল। কী অবয়ব তৈরি করলে বেশ নজর কাড়া হবে— সেই ভাবনা চলতেই থাকে। অবসর সময়ে তার শিল্পীমন সৃষ্টিতে মাতে। কয়েক মাসেই বাঘ, হাতি, জিরাফ, জেব্রা, সিংহ, হরিণ, কাকাতুয়া, কুমীর ইত্যাদি তৈরি করে। কাঁচা কঞ্চিতে ঘুন ধরার সম্ভাবনা। তার মা পরামর্শ দেয় রঙ করার। মা রঙ কেনার পয়সাও দেয়। ছোট্ট তুলি দিয়ে বিভিন্ন তেল রঙে রঙিন করে। তার শিল্পকর্মগুলোকে মনের মতো রঙে সাজায়। সেগুলোকে তক্তপোষের নিচে রাখে। পলিথিন শিট চাপা দিয়ে রাখে। তেল রঙের উপর ধুলো, নোংরা পড়ে না।
পৌষ সংক্রান্তির মেলা। অনন্তদের পাশের গাঁয়ে, বেশ বড়ো মেলা বসে। গাঁয়ের নাম রাগপুর। রাগপুরের বদর পীরের জাত বা মেলা। বেশ পুরোনো মেলা। বহুদূর থেকেও মানুষ আসেন। বদর পীরের মেলায় প্রচুর মানুষের সমাগম। মেলা সাত দিনের। প্রথম তিন দিনের বিক্রিবাটাই বেশি। অনন্তর তৈরি ঘর সাজানোর শিল্পগুলো নিয়ে মেলায় বসে মায়ে-পোয়ে। সঙ্গে মায়ের তৈরি গেরস্থালির কাজের জিনিস। ভালো দামেই বিকোয় সেগুলো। দু’দিনেই তার তৈরি জিনিস বিকিয়ে যায়। প্রায় হাজার পাঁচেক টাকা ঘরে ঢোকে। অনন্তর মায়ের তৈরি জিনিসও প্রায় হাজার টাকায় বিকোয়। দু’রকম বিক্রির টাকা তার মা আলাদা করে রাখে।
দ্বিতীয় দিনে সন্ধ্যার পর, তারা মেলা থেকে বাড়ি ফেরার পথে, অনন্ত মাকে শুধোয়, ‘মা, দু’দিনে মোট কতো টাকার জিনিস বিক্রি হয়েছে?’
—কেন রে? তোর কি আলাদা টাকার দরকার?
—না মা, আমি সে কথা বলিনি। আমি টাকার পরিমাণটা জানতে চাইছি।
—তাহলে শোন্, আমার তৈরি জিনিস থেকে পেয়েছি এগারোশো টাকা। তোর জিনিসগুলোই অনেক দামি। ওই ক’টা জিনিসেই পাঁচ হাজারের বেশি। এবার বল্, টাকাগুলো কী করবো? দু’দিনের টাকা থেকে জিলিপি কেনায় খরচ করেছি একশো টাকা।
—আমি অতো হিসেব চাই না। তুমি টাকাটা গাঁয়ের কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কে জমা রেখো। এটা জানবে, টাকা ভালো কাজেই খরচ করবো। তখন আমায় নিষেধ করবে না।
দু’বছরে অনেক শিল্প অনন্তর হাতে জন্ম নেয়। তার কাজের অভিনবত্ব স্বীকৃতি পায়। অনন্তর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা টাকা, সুদও বাড়ে। কানে আসে, সহপাঠী বন্ধু পরিমলের মা ভীষণ অসুস্থ। সে সিদ্ধান্ত নেয়, পরিমলের মায়ের চিকিৎসার জন্য টাকা দেবেই। না দিয়ে উপায় নেই। কারণ, পরিমলের বাবা নেই। তার মা মারা গেলে, তার পাশে থাকার কেউ নেই। অনন্ত মাকে সঙ্গে নিয়ে টাকা তুলে আনে। তার মাথায় হাত রেখে মা বলেন, ‘তোর মনটা এমন বড়োই রাখিস্ অনু।’
অনন্ত যায় পরিমলের বাড়ি। টাকা দেয় পরিমলকে। পরিমল বলে, ‘আমি কখনও টাকা ফেরত দিতে পারলে নিবি তো?’ অনন্ত জানায়, ‘আমায় ফেরত না দিয়ে, টাকাটা অন্যের অসময়ে দিস্। তাহলেই হবে।’ উত্তর খুঁজে পায় না পরিমল। একটা অজানা আবেগে পরিমল অনন্তকে জড়িয়ে ধরে
কাঁদতে থাকে।