অনির্বাণ দাস
নিউ টাউনের ফ্লাইওভারে, জার্মান কনসুলেটের দেওয়ালে, লা মারটিনীয়র ফর বয়েজের উল্টোদিকে, প্রেসিডেন্সি কলেজে, কলকাতা ইউনিভার্সিটির দেওয়ালে যেসব অসম্ভব সুন্দর শিল্পকর্ম দেখেন, যাকে আমরা ‘গ্রাফইত্তি’ বলে ডাকি, তা আসলে রাষ্ট্রের চোখে অপরাধ। অন্যের সম্পত্তিতে অনুমতি ছাড়া আঁকিবুকি কাটার অপরাধ। কঠিন অপরাধ? জেলযোগ্য অপরাধ? সেটা সবসময়ের মতই রাষ্ট্রের উপর নির্ভর করছে। এই ‘সহজ’ অপরাধে জেল তো কোন ছার, শিল্পীকে দেশ থেকে তাড়িয়ে পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে।
যদিও গুহাচিত্রের সময় থেকেই মানুষ বিভিন্ন মাধ্যমের উপর শিল্পকর্ম করে চলেছে, কিন্তু স্ট্রিট আর্টকে প্রতিবাদের হাতিয়ার করা শুরু হয় আধুনিক সময়ে। নিউ ইয়র্কের গ্যাং ওয়ার তুঙ্গে। ১৯২০ এবং ১৯৩০-এর দশক জুড়ে গ্রাফইত্তি ঝলসিয়ে ওঠে ফিলাডেলফিয়া এবং নিউ ইয়র্ক সিটিতে। তার চরম প্রকাশ ঘটে ১৯৬০-এ যখন অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছিল গোটা আমেরিকা। ক্যানভাস হয়ে উঠেছিল বিস্তীর্ণ শহুরে ইমারত, ক্যানভাস হয়ে উঠেছিল কলকারখানা, পরিত্যক্ত ফ্ল্যাট বাড়ির দেওয়াল, সাবওয়ে। যা প্রথম প্রথম আটকে ছিল টেক্সট গ্রাফইত্তি-র বেড়াজালে তাই ক্রমশ হয়ে উঠেছিল আর্ট মুরাল। অত্যন্ত প্রতিভাবান একদল নবীন শিল্পী যেন পৃথিবীকে উপহার দিচ্ছিলেন এক নতুন শিল্পমাধ্যম। ১৯৭০-এ এসে আরো পরিণত হলো স্ট্রিট আর্ট। বেনামে এবং ডাকনামে সাবওয়ে শিল্প ক্রমশ বেড়ে উঠতে লাগলো। স্ট্রিট আর্টিস্ট কমিউনিটি বড় হতে লাগলো। ঠিক এই সময় ফটোগ্রাফার মারথা কুপার স্ট্রিট আর্ট এবং তার কমিউনিটিকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে নথিবদ্ধ করতে শুরু করলেন। তাঁর বহু চর্চিত বই ‘সাবওয়ে আর্ট’ প্রকাশিত হলো ১৯৮০-র গোড়ার দিকে। ব্যস, দাবানলের মত ইউরোপ ও আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়লো। সেই বই গ্রাফইত্তি শিল্পীদের বাইবেল হয়ে উঠলো। শিল্পকর্মের পরিধি ও পরিমাণ ক্রমেই বাড়লো, বাড়লো নতুন নতুন শিল্পী দল এবং তাদের মৌলিক কাজ।
গ্রেফতারি, জিজ্ঞাসাবাদ, সরকারি রক্তচক্ষুকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে স্ট্রিট আর্ট ক্রমশ জায়গা করে নিল আর্ট গ্যালারিতে, মিউজিয়ামে। এরসল পেইন্টের গণ্ডিতে আটকে না থেকে শিল্পীরা গভীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করলেন মাধ্যম নিয়ে। মার্কার, তেলরঙের ব্যবহার তো ছিলই, এমনকি অগ্নি নির্বাপক বোতলের মধ্যে রং ভরে চলল শিল্পকর্ম। স্টেনসিল, কাগজ, পোস্টার, টেক্সটাইল, এলইডি লাইট, মোজাইক বহু মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো স্ট্রিট আর্ট। এমনকি শুরু হল ‘ইয়ার্ন বম্বিং’-এর মত অভাবনীয় কাজ। যেখানে ফাইবার ব্যবহার করে ত্রিমাত্রিক করে তোলা হত শিল্পকর্মকে। এরই মধ্যে নিউইয়র্ক থেকে উঠে এলেন এমন সব শিল্পীরা, যাঁরা স্ট্রিট আর্টকে ফাইন আর্টের পরিধির মধ্যে নিয়ে এলেন। কিথ হেরিং এবং জঁ মিশেল বাসকিয়া হয়ে উঠলেন তার পুরোধা।
কিথ হেরিং:
আমেরিকান স্ট্রিট আর্টিস্ট কিথ হেরিংয়ের জন্ম পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে পেন্সিলভেনিয়ায়। ছোটবেলা থেকেই পপ সংস্কৃতি এবং শিল্পের প্রতি তাঁর ঝোঁক ছিল। ডক্টর সুস এবং ওয়াল্ট ডিজনির প্রতি গভীর অনুরাগ ছিল ‘আইভি স্কুল অফ প্রফেশনল আর্ট’-এর ছাত্রের, কিন্তু কমার্শিয়াল আর্ট এবং গ্রাফিক আর্টের দুনিয়ায় পা রাখতে নারাজ ছিলেন। শুরু থেকেই গতানুগতিক শিল্পের বিরোধী ছিল তাঁর কাজ। ১৯৭৮ সালে পিটাসবুর্গের ‘আর্ট অ্যান্ড ক্রাফট সেন্টার’-এ তিনি প্রথম তাঁর কাজ জনসমক্ষে আনেন। অপরাধ শিল্পের জগতে তখনও প্রবেশ করেননি কিথ। তাঁর সুযোগ ঘটলো যখন যখন তিনি পাড়ি দিলেন নিউইয়র্ক। ‘স্কুল অফ ভিসুয়াল আর্টস’-এ ভর্তি হলেন। খুব তাড়াতাড়ি তাঁর আলাপ হলো অন্য ধারার এবং অপরাধ শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা শিল্পীদের সঙ্গে। তাঁর সমসাময়িক শিল্পী জঁ মিশেল বাসকিয়া, কেনি শরফ, আন্ডি ওয়ারহোল, কৃস্টও-র কাজে গভীরভাবে প্রভাবিত হলেন। নিউ ইয়র্কের নিচের তলার বিখ্যাত এবং নিষিদ্ধ গ্যালারি ‘ক্লাব ৫৭’ হয়ে উঠল নতুন শিল্পমাধ্যম নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার আঁতুড়ঘর। কিন্তু গ্যালারির গণ্ডির মধ্যে বন্দি থাকার শিল্পী কিথ হেরিং নন। তিনি চেয়েছিলেন সাধারণ মানুষের মধ্যে তাঁর কাজকে ছড়িয়ে দিতে। তাদের প্রাত্যহিক জীবন যাত্রার অংশ করে তুলতে তাঁর শিল্পকে। অপরাধ শিল্পের জগতে পুরোপুরি পা বাড়িয়ে ফেললেন। নিউ ইয়র্কের সাবওয়ে হয়ে দাঁড়ালো তাঁর ল্যাবরেটরি। ফাঁকা বিজ্ঞাপনের কালো ক্যানভাসে চক দিয়ে শুরু করলেন কাজ। নিউ ইয়র্কের বিপুল সাবওয়ে সিস্টেম ভরে উঠল কিথ হেরিংয়ের শিল্পে। পুলিশের হাঙ্গামার শিকার হয়েছেন বারবার, কিন্তু থেমে যাননি। নিউ ইয়র্কের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রা এবং সাধারণ মানুষের রোজকার শিল্পী হয়ে উঠেছেন কিথ। ফাঁকা বিজ্ঞাপনের জায়গায় যে শিল্পকর্ম করতেন তা আবার ঢাকা পড়ে যেত বিজ্ঞাপনে। আবার আঁকতেন। ততদিনে কিথ হেরিং তাঁর কাজ সাধারণ মানুষের মনের মধ্যে গেঁথে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৯৮০-র দশকে কিথ হেরিংয়ের কাজ গগনচুম্বী হয়ে উঠেছিল। সোহতে তিনি নিজের ‘পপ শপ’ খুলেছিলেন যেখানে তাঁর কাজ, খেলনা, টি-শার্ট, পোস্টারের মাধ্যমে হুহু করে বিক্রি হয়ে যেতে লাগল। অনেক সমালোচনা তাঁর দিকে তেড়ে এসেছিল, চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল নানা বিধিনিষেধ। আমল দেননি বিশেষ। তিনি নিউ ইয়র্কে, বার্সেলোনায়, ভেনিসে, সাও পাওলোতে তাঁর কাজ ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। ১৯৮৮ সালে কিথ হেরিং আক্রান্ত হন এইডস রোগে। সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা তাঁর অনুরাগীরা বিশ্বাস করতে চাননি সেই রূঢ় বাস্তবকে। তাঁর অফুরান প্রাণশক্তি কিন্তু মারণ রোগের কাছে মাথা নোয়ায়নি। তাঁর কাজের ধারার পরিবর্তন হয়েছে। এইডস সচেতনতার বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছেন দেওয়ালে দেওয়ালে। ‘কিথ হেরিং ফাউন্ডেশন’-এর মাধ্যমে সচেতনতা ছড়িয়ে দিয়েছেন মানুষের মধ্যে। ১৯৯০ সালে যখন চলে যান, বয়স ছিল মাত্র ৩১ বছর। অপরাধ শিল্পীদের প্রথম সারিতে থাকা হেরিং জনপ্রিয়তার শিখর ছুঁয়েছিলেন। আমেরিকার প্রতি বড় শহরে তাঁর শিল্প ছড়িয়ে দিয়েছিলেন পরবর্তী নবীন শিল্পীরা। তার তৈরি ‘ক্র্যাক ইজ ওয়াক’, ‘রেডিয়েন্ট বেবি’, ‘ইগনরেন্স=ফিয়ার’, ‘বারকিং ডগ’ দেশ-কালের সীমানা ছাড়িয়ে অন্যযুগে পাড়ি দিয়েছিল।
জঁ মিশেল বাসকিয়া:
১৯৬০ সালের ব্রুকলিনে এক পুয়ের্তো রিকন পরিবারে জন্ম নেওয়া জঁ মিশেল বাসকিয়া অপরাধ শিল্পীদের অনুপ্রেরণা সারা পৃথিবী জুড়ে। সাহিত্য-সংগীত-শিল্পচর্চায় অনেক ছোটবেলা থেকেই ছিল তাঁর মুন্সিয়ানা। আলফ্রেড হিচককের ভক্ত বাসকিয়া মায়ের সাহচর্যে ছোটবেলা থেকেই পরিচিত ছিলেন নিউ ইয়র্ক এবং ব্রকলিনের মিউজিয়াম এবং আর্ট গ্যালারিগুলোর সঙ্গে। ম্যানহাটনের পরীক্ষামূলক স্কুলব্যবস্থা ‘সিটি অ্যাজ স্কুল’-এ পড়াশোনা করেছেন বাসকিয়া। সেখানেই পরিচিত হন গ্রাফইত্তি শিল্পী আল ডিয়াজ-এর সঙ্গে। বয়ঃসন্ধি সবে পেরোনো দুই শিল্পী তৈরি করেন গ্রাফইত্তি অবয়ব ‘সেমো’। ম্যানহাটন, ব্রুকলিনের জীর্ণ পুরনো ইমারতগুলো তাঁরা ভরিয়ে তোলেন তীক্ষ্ণ রাজনৈতিক স্লোগানে, সঙ্গে থাকে তীক্ষ্ণতর ব্যবহার কাউন্টার লাইনস-এর। যেহেতু ক্যানভাস কেনার টাকা ছিল না তাই অপরাধ জেনেও নিউ ইয়র্ক শহর এবং শহরতলি নিজেদের ক্যানভাস করে নেন জঁ মিশেল বাসকিয়া আর আল ডিয়াজ। গ্রাজুয়েশন শেষ হওয়ার নয় মাস আগে জঁ মিশেল বাসকিয়া ছেড়ে দেন স্কুল। স্কুলের গতানুগতিক পড়াশোনায় মন বসাতে পারছিলেন না। তখন বয়স সতেরো। বাড়ি ছেড়ে থাকতে শুরু করেন ম্যানহাটনের অলিতে গলিতে। দেওয়ালের সঙ্গে চলতে থাকে জামাকাপড়ে নিজের কাজ। সেসব বিক্রি করেই দিনযাপন করতে থাকেন। এর মধ্যে ক্যানাল স্ট্রিটে জুটিয়ে ফেলেছিলেন শিল্প জগতের বিভিন্ন শাখার সহযোদ্ধাদের। শিল্পীরা যেমন ছিলেন তেমনি ছিলেন সংগীত জগতের শিল্পীরাও। এই ক্যানাল স্ট্রিট এই ‘স্ট্যান পেশকেট লফট’ থেকে পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে বারবার। বাসকিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল সেই চিরাচরিত ভেন্ডালিজমের। বারবার হেনস্থা হয়েও বাসকিয়া ছাড়েননি স্ট্রিট আর্ট। ১৯৮০ সালে ডিয়াজের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় জঁ মিশেল বাসকিয়ার, যদিও তাঁদের গ্রাফইত্তি শিল্প বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। জঁ মিশেল বাসকিয়া নিজে গ্রাফইত্তি আর্টিস্ট কথাটিকে খানিকটা জাতিবিদ্বেষ বহনকারী বলে মনে করতেন, তাছাড়া তাঁর মনে হয়েছিল সমাজের উঁচুতলার শিল্পরসিকদের কাছে পৌঁছানোর রাস্তাতেও খানিকটা বাধা এইসব তকমা। জঁ মিশেল বাসকিয়া বিশ্বাস করতেন সমাজের একদম নিচু তলা থেকে ওপর তলা অবধি পৌঁছানোর মেধা তাঁর শিল্পের আছে এবং সেটা প্রয়োজনীয়। ১৯৮০-তেই বাসকিয়া পরিচিত হন শিল্প সমালোচক এবং মেট্রোপলিটন কিউরেটর হেনরি গ্লেজারের সঙ্গে। যার ‘অবাঁগার্দ’ এবং ‘নিউ ওয়েভ’ ‘কাজ দা টাইমস স্কোয়্যার শো’ বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তাঁর হাত ধরেই জঁ মিশেল বাসকিয়া, কিথ হেরিংকে চিনতে পারেন এবং নিউইয়র্কের শিল্প ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব মুহূর্ত তৈরি হয়। বাসকিয়া এবং কিথের একসঙ্গে করা কাজগুলো স্ট্রিট আর্টের চিরনিশান হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে নিউ ইয়র্কের অলিতে গলিতে। ঠিক পরের বছর ১৯৮১-তে অ্যান্ডি ওয়ারহল-এর সঙ্গে কাজ শুরু করেন বাসকিয়া। আন্ডি ওয়ারহল তাঁর আমৃত্যু সঙ্গী ছিলেন। বারংবার বাধা পাওয়া সত্ত্বেও বাসকিয়ার হাল না ছাড়া মনোভাব তাঁকে নিয়ে যায় ‘অনিনা নসেই’ গ্যালারিতে। সেখানে তাঁর বেসমন্টের কাজগুলি তাঁকে পৌঁছে দেয় খ্যাতির শিখরে। নিউ এক্সপ্রেশালিস্ট মুভমেন্টের একদম শুরুতে যখন মানুষের চেহারা অবয়ব আবার ফিরে আসছে মূল ধারার শিল্পকর্মে, তখন বাসকিয়ার কাজ সারা বিশ্বের আর্টিস্টদের আলোর দিশা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এতসব কিছুর পরেও যেন ছিলেন ব্রাত্য। তীব্র জাতিবিদ্বেষের শিকার হয়েছেন। বারবার অবসাদে গিয়েছেন হেরোইনের কাছে। যত উচ্চমার্গের শিল্পই হোক না কেন অপরাধীর তকমাও যেন চিরসঙ্গী হয়েছিল। বিপদ ঘনিয়ে এলো যখন অসময়ে চলে গেলেন তার পথপ্রদর্শক এবং ড্রাগ থেকে তাঁকে দূরে রাখার বন্ধু অ্যান্ডি ওয়ারহোল। চূড়ান্ত অবসাদে ভুগে মাত্র ২৭ বছর বয়সে হেরোইন ওভারডোজে চলে গেলেন জঁ মিশেল বাসকিয়া। থেকে গেল মানহাটন ব্রুকলিন এর বিস্তীর্ণ শহর প্রান্তরে তাঁর কাজ। সারা পৃথিবীর স্ট্রিট আর্টিস্টদের এক সত্যিকারের বন্ধু। মৃত্যুকে ম্লান করে দিয়ে আজও তাঁর কাজ ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন দেশে ,মহাদেশে, দেওয়াল ভরে উঠছে জঁ মিশেল বাসকিয়ায়। আগের শতকের শেষ দিক থেকে এই শতকের গোড়ার দিকটা মাতিয়ে রেখেছেন যাঁরা তাঁদের মধ্যে কর্ন ব্রেড, শেফার্ড ফেয়ারি, লেডি পিঙ্ক, ব্লউরা বারংবার বেনামে তাঁদের শিল্পচর্চা করতে বাধ্য হয়েছেন এই কারণেই। সমাজ থেকে শুরু করে প্রশাসন ক্রমাগত রক্তচক্ষু দেখিয়ে গিয়েছে শিল্পীদের। তাতে ‘অপরাধ’ অবশ্য কমেনি, বরং বেড়েছে।
গেঁড়ে বসা ব্যবস্থার, সে সরকারই হোক আর ধর্মই হোক, বিরুদ্ধে যখনই শিল্পীরা তাঁদের কাজের মাধ্যমে কিছু বলতে চেয়েছেন তখনই তাঁদের শিল্প ও চামড়া যুগপৎ গুটিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাতে কিন্তু শিল্পীরা দমে যাননি। যে প্রাণী জন্ম ইস্তক গুহায় আঁকিবুকি কাটছে, ইজিপ্টে কেটেছে, রোমে কেটেছে, মেসেডনিয়েয় কেটেছে সে খামোখা চোখরাঙানির ভয়ে মতিলাল স্ট্রিটে আঁকিবুকি কাটা ছেড়ে দেবে কেন! কিন্তু বিপদ বড়ও তো হতে পারে! যেমন হয়েছিল চিনদেশের উত্তর পশ্চিম সীমান্তের শিল্পী আই ওইউই-এর ক্ষেত্রে। সাড়া জাগানো ইনস্টলেশন ‘সানফ্লাওয়ার সীড’-এর জনক, চীনের গ্রাফইত্তি শিল্পের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক যখন দু’হাজার আট সালের সিচুয়ান ভূমিকম্পের পর ‘সিচুয়ান স্কুল করাপশন স্ক্যান্ডাল’ সামনে আনলেন, বিপদ ঘনিয়ে এল। তাঁর শিল্প তাঁকে বিনা বিচারে জেলের অন্ধকারে ঠেলে দিল। একাশি দিন রইলেন, বিনা বিচারে। অবশেষে দেশ থেকে বিতাড়িত। জার্মানি, কেমব্রিজ, পর্তুগাল— অস্থির জীবনযাত্রায় চলে গেলেন।
‘অপরাধী’ শিল্পীদের চোখের মণি ব্যাংকসির ক্ষেত্রে কিন্তু বিষয়বস্তু একদমই অন্যরকম। ব্রিস্টলের নাগরিক জীবনের নীচের তলায় তিনি তাঁর সাম্রাজ্য শুরু করেছিলেন গত শতকের গোড়ার দিকে। তবে তিনি নেই। মানে তাঁর আসল নাম নেই, তাঁর কোনও ছবি জনসমক্ষে প্রকাশিত নয়। শিল্প (অপরাধ) করার সময় তাঁর কোনও ছবি নেই। মোটের উপর অপরাধগুলো আছে, অপরাধী নেই। নে এবার কী করবি কর! অপরাধীই নেই তো জেলে পুরবি কাকে আর দেশান্তরে পাঠাবি কাকে! ওয়েবসাইট কিন্তু আছে দু’খানা। তার মধ্যে একটির নাম আবার ‘পেস্টকন্ট্রোলঅফিস ডট কম’। বুঝুন একবার। আপনি ঋষি শুনকের বেজায় ভক্ত হতে পারেন কিন্তু এই স্যাটায়ার উপেক্ষা করতে পারবেন না। ব্যাংকসির ডকুমেন্টরি ফিল্ম ‘এক্সিট থ্রু দ্য গিফট শপ’ অস্কারে নমিনেটেড পর্যন্ত হয়েছে। অবশ্য তাঁর টিকির দেখা পাওয়া যায়নি।
ব্যাংকসিকে নিয়ে বহু চর্চা ও মতামত থাকা সত্ত্বেও জনসমক্ষে ব্যাংকসি এখনো অধরাই। এদিকে তাঁর এই ‘সিউডনিমাস’ অবস্থান সারা পৃথিবীর গ্রাফইত্তি শিল্পীদের মধ্যে তাঁকে জনপ্রিয় করে তুলেছে। তাঁর অনুকরণে নিজেকে আড়াল করছেন বিশ্বজোড়া শিল্পীরা। ইউরোপের ‘গ্রাফইত্তি-অপরাধের’ জগতে কিন্তু ব্যাংকসি একা ছিলেন না। নিক ওয়াকার, ইঙ্কী, থ্রি ডি (‘ম্যাসিভ আট্যাক’ ব্যান্ডের রবার্ট ডেল নায়া), এঁরাও ছিলেন। ব্যাংকসির সঙ্গেও কাজ করেছেন একজোটে। ব্যাংকসির মুরাল ‘বম্ব হগর’ আগুনের মত ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা ইউরোপে, আমেরিকায়। প্রায় একই রকম জনপ্রিয় তাঁর ‘টেডি বিয়ার এন্ড রায়ট পুলিশ’। একটি টেডি বিয়ার তিনজন রায়ট পুলিশের দিকে মলটভ ককটেল ছুঁড়ছে। ব্রিস্টলের ফটোগ্রাফার স্টিভ লজারিডেজ- এর ক্যামেরাবন্দী সেই মুরাল ইউরোপ ছাড়িয়ে পাড়ি দিয়েছিল অন্য মহাদেশে।
দু হাজার চার সালের আগস্ট মাসে ব্যাংকসি এবং তাঁর সহকর্মীরা সেই সময়কার সরকার আর রাজপরিবারকে ভয়ানক অস্বস্তিতে ফেলেছিলেন। দশ পাউন্ডের নোটে রানির মুখ সরিয়ে বসিয়েছিলেন ‘প্রিন্সেস অফ ওয়েলেশ’ ডায়ানার মুখ। আর ‘ব্যাংক অফ ইংল্যান্ড’ লেখাটি হয়ে গিয়েছিল ‘ব্যাংকসি অফ ইংল্যান্ড’। সেই নোট আবার ছড়িয়ে দেওয়া হয় ‘নটিং হিল কার্নিভাল’-এ আসা সহস্রাধিক মানুষের মধ্যে। একদিকে রানি ভিক্টোরিয়াকে সমকামী দেখানোর জন্য দ্য ভিঞ্চিকে ব্যবহার করার স্বাধীনতা নিয়েছেন, অন্যদিকে অশান্ত সময়ে প্যালেস্টাইনে গিয়ে দেওয়াল ভরিয়ে তুলেছেন মুরালে। বলছিলাম না, গেঁড়ে বসা ব্যবস্থার নিরন্তর কাটাছেঁড়া করা যে সব শিল্পীর রক্তে মজ্জায়, তাঁদের দমিয়ে রাখা মুশকিল তা সে ব্যবস্থা যত শক্তিশালী হোক না কেন।
জানুয়ারি। অপরাধী শিল্পীদের মাস। গুস্তাভ করবেট, ফ্রান্সের রিয়ালিজমের প্রথম সারির শিল্পী, এই মাসেই প্রকাশ করেছিলেন ‘দ্য অরিজিন অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’ যা তুমুল সমালোচিত হয় গেঁড়ে বসা ব্যবস্থা সহজ নগ্নতা মেনে নিতে পারছিল না বলে। তবে যতদিন এই ধরনের ব্যবস্থাপনা থাকবে, কিথ, বাসকিয়া থাকবেন, আই থাকবেন, ব্যংকসি থাকবেন, গুস্তাভ থাকবেন। কিউবা থেকে কলকাতা, মিউনিখ থেকে মুম্বই রঙ চুঁয়ে পড়বে দেওয়ালে। স্ট্রিট আর্ট থাকবে, প্রয়োজনে অপরাধ হয়েও।