মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শিক্ষাক্ষেত্রে চাকরি নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগে সারা রাজ্য যখন তোলপাড়,তখন সর্বপ্রথম সম্প্রতি বিধানসভায় বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলে দাবি করলেন,গত ১০ বছরে ১ লক্ষ টকিরি হয়েছে তার মধ্যে ৫০ থেকে ১০০ টা কেস ভুল হতে পারে।
ভুল হলে সংশোধনের সুযোগ দিতে হবে। মুখ্যমন্ত্রী ভুলের যে সংখ্যাটি বলেছেন সেটাই যদি সত্যি হত তাহলে বলার কিছু ছিল না। সারা রাজ্যে নিয়োগে দুর্নীতির প্রতিবাদে প্রার্থীরা বিক্ষোভে সামিল হতেন না । যদিও একটি ভুলও ভুল।
তা না হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। কিন্তু আদালতে নিয়োগের বিরুদ্ধে মামলায় যে তথ্য বেরিয়ে আসছে তাতে দেখা যাচ্ছে ভুল তো পাহাড় সমান। এ ভুলের সংশোধন কঠিন। নিয়োগ কমিশন আয়োজিত পরীক্ষায় পাশ করে মেধানুযায়ী চাকরিপ্রার্থী হয়ে যাদের সরকারের খাতায় নাম উঠেছে, তাদের চাকরি না হয়ে যারা পরীক্ষাতেই বসেনি, পাশ -ফেল তো দুরের কথা, তাদের চাকরি হয়ে গেল। যেমন তথ্য বলছে, ২৭২ জন শিক্ষক যাঁরা চাকরি পেয়েছেন তাঁরা পরীক্ষাতেই বসেননি আবার যাঁরা বসেছেন তাঁদের উত্তরপত্র লোপাট করা হয়েছে।
তাছাড়া আরও কয়েকশো নিয়োগ পুরো অনৈতিকভাবে হয়েছে। এটাকে কি ভুল বলা যায় ? আর পরেশ অধিকারী শিক্ষাদফতরের প্রতিমন্ত্রী হয়ে দুর্নীতির আবর্তে পড়ে তাঁর স্নেহধন্যা কন্যাকেই শিক্ষিকার পদে ঢুকিয়ে দিলেন।
এখনও এই মন্ত্রী এত বড় পাপ করা সত্ত্বেও বহাল তবিয়তে মন্ত্রিত্বের পদের গরম, অন্যান্য সুযোগসুবিধে ভোগ করে যাচ্ছেন। সিবিআই এই মন্ত্রীমহোদয়কে তিন দফায় জেরা করার সময় অভিযোগের উত্তরে তিনি কি সাফাই গেয়েছেন তা অবশ্য জানা যায়নি।
প্রাথমিক ও তার ওপরের স্তরের শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির যে বন্যা বয়েছে তা ঘটেছে তদানীন্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের আমলে মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে ‘ ক্লিনচিট ’ দিয়েছেন বিধানসভায় এ বিষয়ে বক্তৃতার সময়।
যদি ধরে নেওয়া যায় দলের এই দুই নম্বর স্থানাধিকারী নেতা শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির বিষয়ে কিছু জানেন না, তবুও তিনি দায় এড়ান কীভাবে?
শিক্ষা দফতরের দুর্নীতির দায় তো তাঁকেই বহন করতে হবে।কারণ তিনিই দফতরের শীর্ষে অবস্থান করছেন মন্ত্রী হিসেবে। যেমন রাজ্যে রাজ্যপাল সাংবিধানিক প্রধান, কিন্তু এক্সিকিউটিভ প্রধান হলেন মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং।
রাজ্যে যদি বড় ধরনের কোনো ঘটনা ঘটে, তার সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর কোনো সম্পর্ক না থাকলেও দায় কিন্তু তাঁর ওপরই বর্তায় কারণ রাজ্যের শাসনের হাল ধরে আছেন তিনিই।
পার্থবাবু শুধু মন্ত্রী নন, তিনি দলের মহাসচিব,দলের শৃঙ্খলা রক্ষা কমিটির অন্যতম সদস্য। সুতরাং শাসক দলে তাঁর স্থান অনেক ওপরে। তার বলেই কি তিনি ‘ ক্লিনচিট ’ পেলেন?
যদিও তদানীন্তন শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি বিষয়ক ব্যাপারে তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা সিবিআইয়ের জেরার সম্মুখীন হয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী নিয়োগে সামান্য ভুল হতেই পারে বললেও ভুল যা হয়েছে তা সীমাহীন।
অবশ্য মুখ্যমন্ত্রীর কাছে অনেক বড় রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক হিংসার ঘটনাও সামান্য ঘটনা -প্রচণ্ড মারপিটের ঘটনা ঘটলেও, তা ছোট ছেলেদের কাজ , অজানা জ্বরে উত্তরবঙ্গে প্রচুর শিশুমৃত্যুর ঘটনা ঘটলেও মুখ্যমন্ত্রীর কাছে তা সামান্য জ্বর যা তিনি খোঁজ নিয়ে দেখেছেন।
সুতরাং তাঁর কথায় শিক্ষক নিয়োগে সামান্য ভুলভ্রান্তি হয়েছে। একটা বিষয় বোঝার অসাধ্য। এই যে শিক্ষক নিয়োগে এত বড় দুর্নীতি হয়েছে, তা নিয়ে রাজ্যময় আলোড়ন সৃষ্টি হলেও, ঢাল হিসেবে বাম আমলে যে ভুরিভুরি দুর্নীতি হয়েছে, তা টেনে আনা হয়েছে।
বলা হচ্ছে ওই সময় চিরকুটেও চাকরি হত। তাই সেই আমলে দুর্নীতি হলেও , এই আমলে যদি সেই রকম কিছু হয় তাতে ক্ষতি কি? অদ্ভুত যুক্তি ! আর এই যুক্তি দাঁড় করানোর জন্য তৃণমূলে ঘোষের ন্যায় মুখপাত্র রয়েছেন।
তেমনি এখানে রকমের কোনো রাজনৈতিক হিংসার ঘটনা নিয়ে পত্রপত্রিকায় তার সমালোচনা এবং বিরোধী রাজনৈতিক নেতারা সরব হলে, সঙ্গে সঙ্গে তৃণমূলের মুখপাত্ররা লাফিয়ে উঠে বলেন- উত্তরপ্রদেশে, দিল্লি, গুজরাতে কী হচ্ছে?
তার অর্থ এই দাঁড়ায় এখানে তেমন কোনো ঘটনা ঘটলে অত চিৎকার চেঁচামেচির কী আছে? সত্যটাকে স্বীকার করে নেওয়াই ভালো।
একটিও অপ্রীতিকর ঘটনা যদি ঘটে, তা আকাঙ্ক্ষিত নয়। বাংলার শিক্ষা, সংস্কৃতি, সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে সম্প্রীতি নিয়ে আমরা গর্বিত।সেই বাংলায় খুনখারাপি , কোনো বিভেদ সৃষ্টি না হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়।
এই সরকারের একজন ক্ষমতাবান মন্ত্রী সম্প্রতি বলেছেন,দু’একটা হিংসার ঘটনা যদি না ঘটে তাহলে পুলিশ থেকে লাভ কী? তেমনি বামেদের সময় নিয়োগে যে দুর্নীতি হয়েছিল, এই আমলে তার পুনরাবৃত্তি হলে ক্ষতি কী? মুখ্যমন্ত্রী শাসনভার হাতে নিয়ে বলেছিলেন, আমরা বদলা চাইনা, বদল চাই। এই কি বদলের নমুনা?