ভীরু পায়ে, অচেনা ছন্দে সচল হল শহর

প্রতিকি ছবি (File Photo: iStock)

সোমবার থেকে আরও বেশি করে সচল হল কলকাতা। রাস্তায় আরও বেশি করে ছুটেছে গতিযান। সরকারি বেসরকারি অফিসে সফল হয়েছে সত্তর শতাংশ হাজিরার ফরমান। রেস্তোরাঁ, শপিং মলগুলোও ছিল না একেবারে শুনশান। শুটিং পাড়াতে যথারীতি প্রস্তুতিতে ক্যামেরা, সাউন্ড, অ্যাকশান। সব মিলিয়ে সোমবার এই শহরটা গতি পেল ঠিকই। কিন্তু ফিরল না তার ছেনা ছন্দে।

তিলোত্তমা যেন হাঁটতে শুরু করল ভীরু পায়ে। আনলকডাউন ফেজ টু’তে শহরটা সচল হল ঠিকই কিন্তু তার পায়ের বেড়ি কাটল না। এতদিনের বন্দিদশা কাটার পর সোমবার থেকে খোলা হাওয়া লাগল না তার পালে। মুক্তি পেলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারল না। উল্টে সোমবার এই শহরে রাস্তায় বেরনো মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে।

বেসরকারি বাস মিনিবাস সমস্ত রুটে তো চলেইনি। সরকারি পরিবহণ যা চলেছে তা যথেষ্ট ছিল না। অফিস যাওয়ার সময়েই বাসস্ট্যান্ডে কাতারে কাতারে মানুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। বহু রুটে স্ট্যান্ড থেকেই বাসের সিট ভরে যাওয়ায় গেট বন্ধ করেই ছুটেছে বাস। রাস্তায় কোনও স্টপেজে বাস দাঁড়ালে ঠেলাঠেলি পাদানিত পা রাখতে চেয়েছেন অনেকে। বাসে উঠে সিটে বসতে পাওয়াটা প্রায় লটারির টিকিট পাওয়ার মতো হয়ে গিয়েছে।


পথে কোথাও গাড়ি থামিয়ে কন্ডাক্টর যাত্রী নিতে চাইলে বাসের ভেতরেই সিটে বসা যাত্রীরা রইরই করে উঠেছে। কন্ডাক্টর অপেক্ষারত যাত্রীর হয়ে সওয়াল করলে তার সঙ্গেও বাকবিতণ্ডা হয়েছে বাসযাত্রীদের। সোস্যাল ডিসট্যান্সিং-এর গেরোয় মানুষে মানুষে হিউম্যান ডিসট্যান্সিং প্রকট হয়ে উঠেছে। কোথাও বাসে দাঁড়ানো যাত্রী দেখালে বাস থামিয়ে তাঁদের নামিয়ে দিয়েছে। ফলে পথেই এসে দাঁড়াতে হয়েছে যাত্রীদের।

ফলে সোমবার ভোগান্তির শেষ ছিল না অফিসযাত্রীদের। সরকারি অফিস খুলওে অফিস চত্বরে প্রাইভেট গাড়ি রাখতে দেওয়া হয়নি। সরকারি অফিস তবু লাল দাগের চোখরাঙানি থেকে অব্যাহতি দিয়েছে তাদের কর্মচারীদের। কিন্তু বেসরকারি অফিসে তো সেই ছাড়পত্র মেলেনি। ফলে হয়রানির শিকার হতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। অটো বা ট্যাক্সি প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ভাড়া চাইলে চাকরি বাঁচাতে মানুষ তাই দিতে বাধ্য হয়েছে।

শপিং মলগুলি চালু হয়েছে সোমবার থেকে। কিন্তু সেখানে ঘেঁষাঘেঁষি ভিড় তো নেইই। বরং জিনিসপত্র কেনার চেয়েও ছোঁয়াচ বাঁচানোর দিকেই বেশি করে নজর মাস্ক পরা শপিং মল মুখো মানুষের। বিকেলের দিকে রেস্তোরাঁগুলিতে কিছু মানুষকে অবশ্য খাওয়ার অর্ডার করতে দেখা গিয়েছে। তবে মোগলাই, চাইনিজ, দক্ষিণি খাওয়ারের গন্ধটা যেন মাস্কের ছিদ্রপথে তেমন করে নাকে এসে লাগেনি। স্যানিটাইজার চৰ্চিত হাতে কব্জি ডুবিয়ে খাওয়ার সুযোগ তো নেই-ই।

অফিস থেকে শপিং মল ঢুকতে গেলেই কপালে বন্দুক ঠেকানোর কায়দায় থার্মাল গান দিয়ে চেক আপ হয়েছে। দূরত্ব বিধি মেনে চলতে বারবার নজরদারি চালানো হয়েছে। ফুড কোর্টে পঞ্চাশ শতাংশ আসন খালি রাখা হয়েছে। আগামী ১০ জুন থেকে সিনেমা, মেগা সিরিয়াল, ওয়েব সিরিজ সহ সবকিছুর শ্যুটিং শুরু হবে। এজন্য দু’দিন আগে সোমবার থেকেই সেখানে তোড়জোড় শুরু হয়েছে। তবে যথেষ্ট স্বাস্থ্যবিধির কড়াকড়ি মেনে।

ফলে সেই রাজনীতি, অর্থনীতি, ক্রিকেট-ফুটবল, সংস্কৃতি-গসিপ নিয়ে গলা ফাটানো, নানান বিষয় নিয়ে চায়ের পেয়ালায় তুফান তোলা কলকাতা যেন হঠাৎ করে থম মেরে গিয়েছে। লকডাউনের বাঁধন একটু আলগা হলেও ‘সুরক্ষা বিধির বাঁধন’ খুলতে পারেনি শহরটা। তাই সোমবার থেকে এই শহর ‘কলকাতা চলিয়াছে নড়িতে নড়িতে’ বলা গেলেও, এটা কখনই বলা যাচ্ছে না, কলকাতা আছে কলকাতাতেই’।