• facebook
  • twitter
Friday, 17 January, 2025

শীতে পিকনিক হোক, পরিবেশও মাথায় থাকুক

বনভোজন, পিকনিকের নামে রাজ্যের বিভিন্ন নদী, ঝিলের পাড়, শান্ত গ্রামের এলাকায় ফাঁকা মাঠে চলে। হইহুল্লোড়বাজি, নাচাগানা ধামাকা।

শুরু হয়েছে শীতের মরশুম। একই সঙ্গে রাজ্যজুড়ে শুরু হয়ে গিয়েছে বনভোজন, পিকনিক করার ধূম। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরেই পিকনিকের মরশুমে রাজ্যের পরিবেশ বিশেষজ্ঞ, পক্ষীপ্রেমী বিশারদদের কপালে চিন্তার বড়োসড়ো ভাঁজ পড়ে যাচ্ছে। বনভোজন, পিকনিকের নামে রাজ্যের বিভিন্ন নদী, ঝিলের পাড়, শান্ত গ্রামের এলাকায় ফাঁকা মাঠে চলে। হইহুল্লোড়বাজি, নাচাগানা ধামাকা। তাতে শান্ত পরিবেশ অশান্ত হচ্ছে। আতঙ্কে ত্রস্ত পরিযায়ী পাখিরা। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কড়া নির্দেশে রাজ্যের পরিবেশ দপ্তর এ ব্যাপারে কড়া মনোভাব নিয়েছে।

শুধু কলকাতা শহর লাগোয়া এলাকাতেই নয়, রাজ্যের বিভিন্ন জেলা, মহকুমা, এমনকি ব্লক স্তর পর্যন্ত প্রশাসনিক কর্তাদের কড়া নির্দেশ জানিয়ে পরিবেশ দপ্তর থেকে বলা হয়েছে, ’আনন্দ হোক। কিন্তু হুল্লোড়বাজি করে পরিবেশ দূষণ, পশু-পাখিদের বিব্রত করা, এসব বরদাস্ত করা হবে না। স্থানীয় প্রশাসন, গ্রাম পঞ্চায়েতের কর্তাদের কড়া নজরদারি রাখারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যেসব এলাকা পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে পরিচিতি, সেই সব এলাকার জেলাশাসক, মহকুমা শাসক এবং ব্লক উন্নয়ন আধিকারিকরা ইতিমধ্যেই পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা এবং পশুপাখিদের বিরক্ত না করার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশিকাও জারি করেছেন রাজ্য পরিবেশ দপ্তর সূত্রের খবর।

সল্টলেকের ’ভেরিয়েবল এনার্জি সাইক্রোটন সেন্টার (ভিইসিটি)’ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে, বিশেষ করে উপকূল এলাকায় পশুপাখি সুনির্দিষ্টভাবে পরিযায়ী পাখিদের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে ব্যাপকভাবে সমীক্ষা চালায়। তাদের সমীক্ষা রিপোর্ট দেখে রাজ্যের পরিবেশ দপ্তর এবং পশুপাখি প্রেমীরা রীতিমতো উদ্বিগ্ন। কোতও চোরা শিকারীদের উৎপাত, কোথাও আবার ঝিল বা নদীর ধারে পিকনিক করার নামে ডিজে বাজানো বা তারস্বরে মাইক বাজানোর আওয়াজে রীতিমতো ত্রস্ত্য পরিযায়ী পাখিরা। পশু-পাখি বিশেষজ্ঞরাই জানিয়েছেন, ‘বছর কয়েক আগেও শীতের মরশুমে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ঝিল, নদী, খাঁড়িতে দেশ-বিদেশের পরিযায়ী পাখিরা ভিড় জমাত। পূর্ব বর্ধমানের পূর্বস্থলীর চুপিতে গঙ্গা নদীর খাঁড়িতে (ছাড়ি গঙ্গা) বিদেশের পরিযায়ী পাখিরা প্রচুর সংখ্যায় ভিড় জমাত। সেইসব পরিযায়ী পাখিদের তথ্য সংগ্রহ করতে দেখা বিদেশের পর্যটক ও পক্ষীপ্রেমীরা আসতেন এই রাজ্যে।

এখন সেই ‘চুপি’তেই পরিযায়ী পাখিদের বিরক্ত না করা এবং পরিবেশ রক্ষার আবেদন জানিয়ে মাইক হাতে গঙ্গা নদীর তীরবর্তী এলাকায় ব্যাপক প্রচার চালাচ্ছেন এলাকার বিধায়ক তথা রাজ্যের প্রাণীসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রী স্বপন দেবনাথ। তিনি বলেন, ‘শুধু চোরা শিকারীরাই নন, এই শীতের মরশুমে গঙ্গা নদীর ধারে ধারে তারস্বরে মাইক বাজিয়ে বা ডিজে-র তালে তালে নাচানাচি করছেন পিকনিক করতে আসা মানুষজন। এটা আমরা বন্ধ করবই। মানুষের উৎপাতে পরিযায়ী পাখিরা যেন এই এলাকায় আসা-যাওয়া বন্ধ না করে দেয়, সেটা আমাদের দেখতেই হবে।’

তবে আশার কথা, এলাকার গ্রামবাসীরা তাঁর এই মাইক নিয়ে প্রচারে ব্যাপকভাবে সাড়া দিচ্ছেন— জানিয়েছেন রাজ্যের মন্ত্রী স্বপনবাবু।
বন দপ্তর সূত্রের খবর, রাজ্যের সাঁতরাগাছি ঝিল বা বালি জগাছা এলাকায় ২ ও ৫ নম্বর জাতীয় সড়কের সংযোগস্থলে বিশাল ঝিলে বছর কয়েক আগেও প্রচুর পরিযায়ী পাখির আনাগোনা ছিল। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, ‘একশ্রেণির স্বার্থান্বেষী মানুষ আস্তে আস্তে সেই ঝিল বুজিয়ে দেওয়ার চেষ্টাও করছেন। এই নিয়ে পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে আদালতে মামলাও করেছেন পরিবেশবিদ সুভাষ দত্ত।’

শুধু ঝিল বা খাড়িতেই নয়, কেন্দ্রীয় সংস্থা ’নিউক্লিয়ার পাওয়ার কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়া লিমিটেড সংগঠন’ পরিবেশ সংগঠন প্রকৃতি ও সংসদকে সঙ্গে নিয়ে পরমাণু কেন্দ্রের জন্য পশু-পাখি এবং প্রকৃতির উপর কী প্রভাব পড়ছে, তা নিয়ে ব্যাপক সমীক্ষায় নেমেছে। রাজ্যের জুনপুট উপকূল, হরিপুর, পেটোয়া ঘাট, ফ্রেজারগঞ্জ-সহ নানা সমুদ্র উপকূল এলাকায় এখনও কিছু কিছু পাখি দেখা যাচ্ছে বলে তাদের সমীক্ষায় প্রকাশ করা হয়েছে। উত্তরবঙ্গের গাজলডোবা পর্যটন কেন্দ্রে তিস্তা নদীর চরে দেখা মিলেছে ‘বিন গুজ’ পরিযায়ী পাখি। তাদের সমীক্ষায় আরও জানানো হয়েছে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, আলাস্কা থেকেও নানা প্রজাতির পরিযায়ী পাখিরা এখনও আসছে।

রাজ্যের পরিবেশ দপ্তরের কর্তারাই জানিয়েছেন, চোরা শিকারিদের উপদ্রব ও স্থানীয় কিছু বাসিন্দার উৎপাত কমাতে না পারলে পরিযায়ী পাখিরা যে এই রাজ্যের বিভিন্ন নদী, ঝিলে আর আসবে না পশু-পাখি বিশেষজ্ঞরা তা রাজ্য সরকারকে ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছেন। স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে পশু-পাখি, সরীসৃপ সহ বন্য পশু-পাখিদের বাঁচানোর জন্য সচেতনতা বৃদ্ধির বিষয়ে ব্যাপক প্রচার চালানো হচ্ছে। ইতিমধ্যেই ৯৫০৮ হেক্টর জমিকে বনসৃজনের আওতায় আনা হয়েছে।