শুধু জরুরি পরিষেবা নয়, জুনিয়র ডাক্তারদের সব পরিষেবায় কাজ করতে বললেন প্রধান বিচারপতি। সোমবার সুপ্রিম কোর্টে আরজি কর মামলার পঞ্চম শুনানিতে এই নির্দেশ দেন ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়। পাশাপাশি হাসপাতালগুলিতে সিসিটিভি বসানোর কাজ শেষ করতে রাজ্যকে সময় বেঁধে দিল শীর্ষ আদালত। ৩১ অক্টোবরের মধ্যে এই কাজ সম্পূর্ণ করতে হবে রাজ্যকে। সিবিআইয়ের তদন্তের আওতায় থাকা ব্যক্তিদের অবিলম্বে সাসপেন্ড করার পক্ষে সোমবার আদালতে সওয়াল করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে সিবিআইয়ের কাছ থেকে তদন্তের আওতায় থাকা ব্যক্তিদের নামের তালিকা চাওয়া হল। পাশাপাশি এদিন তদন্তের স্টেটাস রিপোর্ট জমা দেয় সিবিআই। ঘুমন্ত অবস্থায় কীভাবে নির্যাতিতার চোখে আঘাত লাগল এই নিয়েও প্রশ্ন তোলেন প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ। এছাড়াও এদিন শুনানির সময় উঠে আসে সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের হামলার প্রসঙ্গও।
সোমবার বিকেল ৪টে ১৫ মিনিট নাগাদ আরজি কর মামলাটি প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের বেঞ্চে ওঠে। শুনানি শুরুর সঙ্গে সঙ্গে সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা শুনানি পিছিয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানান। এরপর ৫ মিনিটের বিরতি নিয়ে ফের শুরু হয় শুনানি। শুনানি শুরু হলে প্রথমেই নির্যাতিতার ছবি সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গ উঠে আসে। এপ্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমরা এই নিয়ে আগেই নির্দেশ দিয়েছি।’ সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা এই বিষয়ে রাজ্যকে পদক্ষেপ করার পক্ষে সওয়াল করেন। সমাজমাধ্যমে নজরদারি চালাতে রাজ্যকে নোডাল অফিসার নিয়োগ করার কথা বলেন নির্যাতিতার পরিবারের আইনজীবী বৃন্দা গ্রোভার। তাঁর দাবি, ওই নোডাল অফিসারের তত্ত্বাবধানেই নির্যাতিতার ছবি সমাজমাধ্যম থেকে মুছে ফেলার কাজ করা যাবে।
সোমবার সুপ্রিম কোর্টে রাজ্যের তরফে জানানো হয়, জুনিয়র ডাক্তাররা শুধুমাত্র জরুরি পরিষেবা দিচ্ছেন। বহির্বিভাগ ও অন্য ক্ষেত্রে তাঁরা পরিষেবা দিচ্ছেন না বলে দাবি করা হয়। যদিও প্রথমে এই বক্তব্যে আপত্তি জানান জুনিয়র ডাক্তারদের আইনজীবী ইন্দিরা জয়সিংহ। প্রয়োজনীয় পরিষেবা দেওয়া হচ্ছে বলে দাবি করেন তিনি। এ প্রসঙ্গে সওয়াল জবাবের পর প্রধান বিচারপতির মন্তব্য, হাসপাতালের বহির্বিভাগ ও অন্য ক্ষেত্রগুলি–সহ সমস্থ প্রয়োজনীয় পরিষেবায় কাজ করবেন জুনিয়র ডাক্তাররা।
আরজি কর ইস্যুর পটভূমিতে একটি স্বল্প দৈঘ্যের ছবির প্রসঙ্গও শুনানিতে উঠে আসে। এই ছবিটি বন্ধ করার পক্ষে সওয়াল করেন আইনজীবী বৃন্দা। তবে প্রধান বিচারপতি জানান এই নির্দেশ দেওয়ার জন্য শুনানির প্রয়োজন রয়েছে। এই এজলাসে সেটা সম্ভব নয় বলে বুঝিয়ে দেন তিনি। প্রসঙ্গত এদিনই এই ছবির মুক্তি পিছিয়ে দেওয়ার কথা জানান সম্প্রতি তৃণমূল ছাত্র পরিষদ থেকে সাসপেন্ড হওয়া রাজন্যা হালদার।
উল্লেখ্য, আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে তরুণী চিকিৎসক খুন ও ধর্ষণের ঘটনায় সিবিআই যে তদন্ত প্রক্রিয়া চালাচ্ছে তার স্টেটাস রিপোর্ট দেখল প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ। রিপোর্ট দেখে তাঁদের বক্তব্য, ‘সিবিআই তদন্তে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে এসেছে। তারা তদন্ত চালিয়ে নিয়ে যাক।’ পাশাপাশি এই রিপোর্ট দেখে নির্যাতিতার চোখের চোট নিয়ে প্রশ্ন তোলেন বিচারপতি। যদিও এবিষয়ে সলিসিটর জেনারেল জানান, চশমা খুলে না রাখার জন্য চোখে চোট লাগতে পারে। ঘুমন্ত অবস্থায় চোখে চশমা কেন ছিল সেই প্রশ্নও উঠে আসে। উল্লেখ্য, হাসপাতালগুলিতে জাল ওষুধের চক্র চলছে বলে শুনানি চলাকালীন অভিযোগ করেছেন জনস্বার্থ মামলাকারীর আইনজীবী ফিরোজ এডুলজি।
আরজি করের ধর্ষণ–খুনের ঘটনাকে সাধারণ ঘটনা হিসেবে দেখলে ভুল হবে বলে এদিন এজলাসে মন্তব্য করেন জুনিয়র ডাক্তারদের আইনজীবী ইন্দিরা জয়সিংহ। তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে চার জনের নাম রয়েছে। দু’জনের নাম আমরা সিবিআইকে দিয়েছি। ওই চার জন অকুস্থলে ছিলেন।’ পাশাপাশি তদন্তের আওতায় থাকা আরজি কর মেডিক্যালের ৭ জনকে আপাতত সাসপেন্ড করার পক্ষে সওয়াল করেন তিনি। তাঁরা হাসপাতালে থেকে প্রভাব খাটাতে পারেন বলে মনে করেন এই আইনজীবী।
এ প্রসঙ্গে জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অফ ডক্টরস-এর আইনজীবী করুণা নন্দী বলেন, ‘যেহেতু সিবিআই দুর্নীতির তদন্ত করছে, তাই তদন্তের স্বার্থে কয়েকজন প্রভাবশালীকে সাসপেন্ড করা হোক।’ যদিও এপ্রসঙ্গে রাজ্যের আইনজীবী জানান, ইতিমধ্যেই ৫ জনকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। কতজন সিবিআইয়ের স্ক্যানারে রয়েছে তাঁদের তালিকা আদালতে পেশ করার নির্দেশ দেন প্রধান বিচারপতি। পাশাপাশি সাসপেন্ড হওয়া ব্যক্তিদেরও নাম জানতে চায় শীর্ষ আদালত। রাজ্যের তরফেও সিবিআইয়ের কাছ থেকে তদন্তের আওতাধীন ব্যক্তিদের নামের তালিকা চাওয়া হয়েছে। আদালতে রাজ্য জানায়, তদন্তকারী সংস্থা নামের তালিকা দিলে তাঁদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করা হবে। সিবিআইয়ের স্ক্যানারে থাকা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করতে রাজ্যের কোনও সমস্যা নেই।
এদিন হাসপাতালের নিরাপত্তার বিষয়ে শীর্ষ আদালত রাজ্যের তরফে পদক্ষেপের কথা জানতে চায়। সিসিটিভি বসানোর কাজ কতদূর এগিয়েছে তা রাজ্যের আইনজীবীর কাছে জানতে চান প্রধান বিচারপতি। এই কাজ করার জন্য এদিন কিছুটা সময় চেয়ে নেয় রাজ্য। জানানো হয়, রাজ্যের বন্যা পরিস্থিতির জন্য সিসিটিভি বসানোর কাজ কিছুটা থমকে গিয়েছিল। এরপর প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড় ৩১ অক্টোবরের মধ্যে কাজ সম্পূর্ণ করার নির্দেশ দেন। এই কাজের মধ্যে রয়েছে, ২৮টি হাসপাতালে সিসিটিভি বসানো, শৌচাগার নির্মাণ ও সংস্কারের কাজ। এরপর রাজ্যের তরফে জানানো হয়, আরজি কর হাসপাতালের ডিউটি রুমের টেন্ডার হওয়ার কাজ থমকে রয়েছে। সিবিআই ছাড়পত্র দিলে কাজ শুরু করা যাবে বলে জানায় রাজ্য। যদিও এই প্রসঙ্গে কিছুটা কটাক্ষের সুরে সিবিআই জানায়, ‘ঘটনার পর ৫ দিন কাজ হয়েছে। এখন আর আমাদের আপত্তি থাকবে কেন?’
এদিন শুনানি চলাকালীন সাগর দত্ত মেডিক্যালে জুনিয়র ডাক্তারদের উপর হামলার প্রসঙ্গ তুলে সরব হন আইনজীবী করুণা নন্দী। পুলিশের সামনেই চিকিৎসকদের উপর হামলা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। এবিষয়ে প্রধান বিচারপতি জানান, সাগর দত্তে হামলার ঘটনায় যুক্তদের বিরুদ্ধে রাজ্যের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। পাশাপাশি এদিন টাস্ক ফোর্সে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিনিধি রাখার পক্ষে সওয়াল করেন আইনজীবী ইন্দিরা। তাঁর সঙ্গে সহমত পোষণ করেন প্রধান বিচারপতিও। তিনি জানান, আগামী শুনানিতে টাস্ক ফোর্সের কাছ থেকে রিপোর্ট নেবে আদালত। আগামী ১৪ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্টে আরজি কর মামলার পরবর্তী শুনানির সম্ভাবনা রয়েছে।