কেমন ছিল রবীন্দ্রনাথ ও বিবেকানন্দের সম্পর্ক

দেবরঞ্জন তরফদার

বর্তমানের এই এই পোড়া খণ্ড বঙ্গভূমিতে উনিশ শতকে যে কয়েকজন মহান পুরুষের আবির্ভাবে তৎকালীন পরাধীন অখণ্ড বঙ্গভূমি ধন্য হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে অন্যতম দু’জন ক্ষণজন্মা ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ও বিবেকানন্দ। এই দু’জন মহাপুরুষ সমগ্র পৃথিবীতে দু’ভাবে ভারতের নাম উজ্জ্বল করেছেন। একজন ছিলেন সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী জগদ্বিখ্যাত কবি, অপরজন ছিলেন আন্তর্জাতিক ধর্মসভায় ভারতের আধ্যাত্মিক শক্তির প্রতিভূ বীর সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ। এখন এই দু’জন পরস্পর প্রতিবেশী ও সমসাময়িক প্রতিভাধর ব্যক্তিত্বের মধ্যে কোন সরাসরি বা প্রত্যক্ষ সম্পর্ক ছিল কিনা, সে বিষয়ে একটু তত্ত্বতালাশ নেওয়াই হল এই প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয়।

এই দু’জন বড় বড় বড় মানুষের ছোট ছোট সম্পর্ক নিয়ে পাঠকের মধ্যে আজও কৌতূহলের শেষ নেই। ঠাকুর ও দত্ত পরিবারের এই দু’জনেরই বাস উত্তর কলকাতার ঢিল-ছোঁড়া দূরত্বে। তবুও দু’জনের মধ্যে সম্পর্ক কী ছিল বা দু’জনের মধ্যে আদৌ কখনো সাক্ষাৎ হয়েছিল কিনা তা নিয়ে ভক্ত জনের মধ্যে আজও ঘুরে ফিরে নানা প্রশ্ন জাগে। যদিও প্রায় সকলেই জানেন কবির দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথের বড় ছেলে দ্বিপেন্দ্রনাথ ছিলেন নরেন্দ্রনাথের প্রতিবেশী সহপাঠী এবং সেই সূত্রে বাল্য বয়সে তিনি যে ঠাকুরবাড়িতে যাতায়াত করতেন তেমন ধরা যেতেই পারে। তবে এ বিষয়ে ১৯০২ সালে নরেন্দ্রনাথ বেঁচে থাকা পর্যন্ত উভয়ের কোনো লেখা বা স্মৃতিচারণায় এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য খুঁজে পাওয়া যায়নি। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ তো ছিলেন তখন প্রতিষ্ঠিত লেখক।


তবে  বিবেকানন্দের ‘পরিব্রাজক’ গ্রন্থের সেই সময়কার একটি লেখায় কবির উদ্দেশে তির্যক মন্তব্য লিখেছেন, ‘‘ওই যে একদল দেশে উঠেছে, মেয়েমানুষের মত বেশভূষা। নরম নরম বুলি কাটেন, এঁকে বেঁকে চলেন, কারুর উপর চোখ রেখে কথা কইতে পারেন না, আর ভূমিষ্ঠ হয়ে অবধি পিরীতের কবিতা লেখেন। আর বিরহের জ্বালায় ‘হাসান-হোসেন’ করেন।’’
পরবর্তীকালে ভক্ত গবেষক শংকরীপ্রসাদ বসু ও রবীন্দ্র-অনুরাগী গবেষক অমিতাভ চৌধুরী এঁদের দু’জনের মধ্যেকার সম্পর্ক নিয়ে অনেক খোঁজ খবর করেছেন। তবে এর আরও লেখালেখির মধ্যে এ বিষয়ে পরোক্ষ উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন, গৌরমোহন মুখার্জী স্ট্রিটে স্বামীজির পৈতৃক বাড়ির পুজোর দালানে একটি ব্রাহ্ম বিদ্যালয় ছিল। তাঁর কাকা তারকনাথ ছিলেন খোদ ঠাকুরবাড়ির উকিল। সহপাঠী দ্বিপেন্দ্রনাথের সঙ্গে ঠাকুরবাড়িতে যাতায়াতের সূত্রে স্বয়ং মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ নরেন্দ্রনাথকে খুব স্নেহ করতেন। এই সময়ে মহর্ষির কাছে বারে বারে যাওয়া আসার সূত্রে নরেন্দ্রনাথের মনে এক গভীর আধ্যাত্মিক সংকটের সৃষ্টি হয় বলে তাঁর জীবনীকার প্রমথ বসু উল্লেখ করেছেন। তাঁর বিবরণে জানা যায়, নরেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মসমাজে নামও লিখিয়েছিলেন। এ বিষয়ে স্বয়ং অবনীন্দ্রনাথ উল্লেখ করেছেন। তাছাড়া স্বামী গম্ভীরানন্দ রচিত ‘যুগনায়ক বিবেকানন্দ’ বইটিতে মহর্ষির সঙ্গে নরেন্দ্রনাথের বহুবার সাক্ষাতের ইঙ্গিত রয়েছে।

আবার গায়ক নরেন্দ্রনাথ যে রবীন্দ্রসংগীতে বিশেষ অভ্যস্ত এবং নিয়মিত গাইতেন তার যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। ‘সংগীত কল্পতরু’ নামে যে গানের বইয়ের সংকলন তিনি করেন সেখানেও কয়েকটি রবীন্দ্রনাথের গান রয়েছে, যেগুলি নরেন মাঝে মাঝে ঠাকুর রামকৃষ্ণকে গেয়ে শোনাতেন।

আরও একটি স্মরণীয় ঘটনা উল্লেখ করার মতো। ঋষি রাজনারায়ণ বসুর কন্যা লীলাবতীর বিবাহে সংগীত পরিবেশনা। মহর্ষির অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ লীলাবতীর বিবাহসভার জন্য দুটি গান রচনা করেন (১৮৮১)। তার একটি হলো— ‘দুটি হৃদয়ের নদী একত্র মিলিল যদি বল দেব! কার পানে ছুটিয়া যায়’। তখনকার খ্যাতিমান গায়ক নরেন্দ্রনাথ সেই সংগীতে অংশগ্রহণ করেন। সবচেয়ে যা আশ্চর্য তথ্য, রবীন্দ্রনাথ নিজেই গায়কদের গান
শিখিয়েছিলেন।

পরবর্তীকালে প্রবোধচন্দ্র সেন মহাশয় নরেন্দ্রনাথের প্রিয় রবীন্দ্র সংগীতের একটি তালিকা দিয়েছেন। যেমন— ‘গগনের থালে রবি-চন্দ্র-দীপক জ্বলে’, ‘তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা’, ‘মহাসিংহাসনে বসি শুনিছ হে বিশ্বপিতঃ’। তিনি এই গানগুলি বাগবাজারের বলরাম বসুর বাড়িতে ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে ১৪ জুলাই শোনান। কিন্তু সেখানে উভয়ের মধ্যে কোনো প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎ হয়েছিল কিনা তা কুয়াশাচ্ছন্ন রয়ে গিয়েছে। শংকরীপ্রসাদ বসুর উদ্ধৃতি অনুযায়ী ক্ষিতিমোহন সেন নিজে কাশীতে স্বামীজির স্বকন্ঠে রবীন্দ্রনাথের ‘সখী, আমার দুয়ারে কেন আসিলে নিশিভোরে যোগী ভিখারী’ গানটি শুনেছেন।

আবার বিশ্ববিজয় করে বিবেকানন্দ স্বদেশে ফিরলে ১৮৯৭-এর ২৮ ফেব্রুয়ারি শোভাবাজার রাজবাড়ীতে যে সংবর্ধনা সভা হয়েছিল তার যে রিপোর্ট ৩ মার্চ, ১৮৯৭-এ সংবাদপত্রে বেরিয়েছিল সেখানে কিন্তু কবির নাম নেই। নাম আছে গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বলেন্দ্রনাথ ঠাকুরের।

আরও সাক্ষাতের উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে। এবার সাক্ষী সিস্টার নিবেদিতা। তাঁর বাড়িতে ঘরোয়া চা-সভায় (২৭ জানুয়ারি, ১৮৯৯) রবীন্দ্রনাথ তিনটি স্বরচিত গান গেয়েছিলেন এবং সেই সভায় বিবেকানন্দও গান গেয়েছিলেন। এ বিষয়ে ভক্ত-গবেষক শংকরীপ্রসাদ বসুর মতে ওই সভায় রবীন্দ্রনাথ গীত গানটি ছিল ‘বেলা গেল তোমার পথ চেয়ে,/ শূন্য ঘাটে একা আমি, পার করে লও খেয়ার নেয়ে।’ তবে বিবেকানন্দ এই সভায় কোন গানটি করেছিলেন তার কোনো উল্লেখ নেই। আবার ওই ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জানুয়ারি জোসেফিন ম্যাকলিওডকে লেখা নিবেদিতার একটি পত্রে জানা যায়, মাঘোৎসবে কোনো এক সংগীতসভায় রবীন্দ্রনাথ ও বিবেকানন্দ উভয়েই উপস্থিত ছিলেন। সেই সভায় রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং দুটি গান গেয়েছিলেন। কিন্তু উভয়ের মধ্যে এখানে কোনো বাক্যালাপের উল্লেখ নেই। নিবেদিতাও এ প্রসঙ্গে লিখেছেন— ‘Only there was some cloud— I could not tell what’ অর্থাৎ এখানেও সেই ‘মেঘ’।

তবে শঙ্করীপ্রসাদ নিবেদিতার পত্র থেকে সন্ন্যাসী বিবেকানন্দের রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আরও কঠোর মনোভাবের উল্লেখ করেছেন। তিনি একটি পত্রে নিবেদিতাকে লিখেছেন— ‘এমনকি সাধারণভাবে ঠাকুরবাড়ির প্রভাব বাংলাদেশের পক্ষে ক্ষতিকর হয়েছে,… এই পরিবার ইন্দ্রিয় রসের বিষ বাংলাদেশে ঢুকিয়ে দিয়েছে।’ সেখানে তিনি জ্বলে উঠে আরও বলেছিলেন— ‘আমার জীবনোদ্দেশ্য— রামকৃষ্ণ নয়— বেদান্ত নয়— আর কিছু নয়— শুধু জনগণের মধ্যে পৌরুষ আনা।’

আবার, ১৯০২ সালে ৪ জুলাই বিবেকানন্দের আকস্মিক প্রয়াণের পর তাঁর সম্পর্কে
রবীন্দ্রনাথের কোনো বিবৃতি সংবাদপত্রে দেখা যায়নি। এও ঠিক ১৯১৩-তে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির আগে পর্যন্ত কথায় কথায় কবির কোনো ভাষণ সংবাদপত্রে প্রকাশিত হত না। তবে স্বামীজির দেহাবসানের পর ভবানীপুর সাউথ সুবার্বন স্কুলে যে শোকসভা হয় তাতে রবীন্দ্রনাথ সভাপতিত্ব করেন। যদিও সেই সভায় তাঁর ভাষণের কোনো বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় না। লক্ষণীয় যে, রবীন্দ্রসৃষ্টির মধ্যে বিবেকানন্দের প্রতিফলন তাঁর জীবিত থাকাকালীন ও মৃত্যুর পর বহু জায়গায় লক্ষ্য করা গেলেও রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বিবেকানন্দ নীরব বা উদাসীন থেকেছেন। তবে তৎকালীন বিখ্যাত জাপানি কবি ওকাকুরা ভারতবর্ষকে বুঝতে যখন

বিবেকানন্দের কাছে যান তখন তিনি ওকাকুরাকে বলেছিলেন— ‘এখানে আমার সঙ্গে আপনার কিছুই করণীয় নেই। এখানে তো সর্বস্ব ত্যাগ। আপনি রবীন্দ্রনাথের কাছে যান। তিনি এখনও জীবনের মধ্যে আছেন।’ এই বক্তব্যের মধ্যে রবীন্দ্রপ্রতিভা ও তাঁর সৃষ্টিকর্মকে বিবেকানন্দের সমর্থনের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। অপর দিকে ওকাকুরা রবীন্দ্রনাথের কাছে পরামর্শ চাইলে তিনি বলেন — ‘If you want to know India, study Vivekananda. There is in him  everything possititive, nothing negative.’

এছাড়া বিবেকানন্দের মৃত্যুর অনেক পরে ১৯৩০ সালের ১৫ জানুয়ারি রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভাইঝি ইন্দিরা দেবীকে একটি চিঠিতে লিখেছেন— ‘অতীতের প্রতি শ্রদ্ধা রাখা উচিত। কিন্তু যেন সে অতীত নয়, এমন ব্যবহার করা অসঙ্গত। বেলুড়মঠে শুনেছি, বিবেকানন্দের ছবির সামনে রোজ অম্বুরি তামাকের ভোগ দেওয়া হয়।’ অর্থাৎ এতদিন পরে রবীন্দ্রচিত্তে তখনও
বিবেকানন্দের সশ্রদ্ধ অমলিন উপস্থিতি।

কিন্তু এত সব সাক্ষ্যসবুদ জোগাড় করেও এই দু’জন খ্যাতিমান সমকালীন পড়শির মধ্যে প্রত্যক্ষ সম্পর্কের কোনো প্রত্যয়িত ছবি তুলে ধরা গেল কি? তবে এটুকু বোঝা গেল, বিবেকানন্দ ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ছিল। আপাতত উভয়ের মধ্যে
প্রত্যক্ষ-সম্পর্ক অনুসন্ধানীদের এইটুকুতেই সন্তুষ্ট থাকা ছাড়া উপায় নেই।