রাজনীতি আসলে ফুটবলের মতো। যাঁকে রিজার্ভ বেঞ্চে বসিয়ে রাখা হয়েছিল তিনিই হয়তো এসে ইনজুরি টাইমে গোল করিয়ে ম্যাচ জিতিয়ে দিয়ে তারকা হয়ে যান।
তারপর আর তাঁকে প্রথম একাদশ থেকে বসানো যায় না তৃণমূলের রাজনীতিতে গত তিন মাসে ফিরহাদ হাকিমের বিস্ময়কর পুনরাবির্ভাব এবং সরকার ও সংগঠনে গুরুত্ব বৃদ্ধি আবার ওই আপ্তবাক্যটাকে মনে করাল।
২০২১-র পুজোর সময়ও যাঁকে কাউন্সিলরের টিকিটও দেওয়া হবে কি না, সেই নিয়ে দলের মধ্যে গুঞ্জন ছিল, সেই ফিরহাদ শুধু কাউন্সিলর নয়, মেয়র হলেন।
আর মঙ্গলবার মন্ত্রিসভার দফতর পুনর্বণ্টনের পরে তৃণমূল সুপ্রিমোর আদরের ববির কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি দফতর, পরিবহণের পাশাপাশি পুর এবং নগরউন্নয়নও।
এর পাশাপাশি রাজ্যের শাসকদলের জাতীয় কমিটিতেও ফিরহাদ হাকিম মুখ্য সমন্বয়কারী, অর্থাৎ দলের অন্যদের সঙ্গে নেত্রীর যোগাযোগ রক্ষার দায়িত্ব ফিরহাদের উপর।
যদি কেউ মনোযোগ দিয়ে তৃণমূলের সাংগঠনিক কাঠামো দেখেন তাহলে দেখা যাবে প্রায় প্রতিটি কমিটিতেই চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের সঙ্গে ফিরহাদের দাপুটে উপস্থিতি।
সুব্রত বক্সী আর পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে যদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্মান দিয়ে থাকেন, তাহলে নিজের অনুগত ফিরহাদ হাকিমকে গুরুদায়িত্ব দিয়েছেন।
সেই গুরুত্ব গত ৩৪ বছরে বাম শাসনে কোনওদিন কোনও মুসলিম রাজনীতিককে দেওয়া হয়নি এইটা যেমন ইতিহাসে লেখা থাকবে, তেমনই মনে রাখতে হবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের ৩০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর এতদিনের আহত হৃদয়ে প্রলেপ লাগালেন।
একদা সিপিএমের কৃষকনেতা, পরবর্তীকালে দলত্যাগ করে চাষীর ব্যাটা নামে পরিচিত হওয়া, এবং আরও পরে তৃণমূলেরও মন্ত্রী হওয়া আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা আমাকে অনেকদিন আগে দুঃখ করে বলেছিলেন, বাম আমলে দলের মুসলিম নেতাদের গরু ছাগলের মন্ত্রী করা হতো।
হেলে ধরতে পারে না, কেউটে ধরতে গ্যাছে টাইপের অমর কয়েনেজ দেওয়া রেজ্জাক মোল্লা আসলে বলতে চেয়েছিলেন, সিপিএমের আমলে পশুপালনের মতো অগুরুত্বপূর্ণ দফতরই বরাদ্দ থাকত।
সিপিএমের ভট্টাচার্য চক্রবর্তীদের কোটারি মহম্মদ সেলিমকেও কারিগরি শিক্ষা দিয়ে আটকে রাখতে চেয়েছিল, আর সিঙ্গুরে কি হতে চলেছে তা আন্দাজ না করেই রেজ্জাক মোল্লাকে ভূমি রাজস্ব দেওয়া হয়েছিল।
বাম আমলের শেষদিকের রাজনৈতিক টানাপোড়েনটা জানি বলেই মনে করিয়ে দিতে পারি, সিঙ্গুর নন্দীগ্রামে ধাক্কা খাওয়ার পরে, পঞ্চায়েত নির্বাচনে পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে বোঝার পরেই সিপিএম আনিসুর রহমানকে পঞ্চায়েত দফতর দেয়।
এই পরিপ্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর দলে এবং সরকারে সংখ্যালঘুদের যে গুরুত্ব দিয়েছেন, তা অভাবনীয়। আর মঙ্গলবার তিনি তাঁর একান্ত বিশ্বস্ত ববিকে যে উচ্চতায় পৌছে দিলেন, তা পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।