পুলিশ তার উর্দির জোরে সবাইকে জেরা করে। অথচ বৃহস্পতিবার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে প্রশাসনিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীর জেরার মুখে পড়তে হল পূর্ব মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার অমরনাথকে।
এদিন প্রকাশ্যেই ওই জেলার আইন শৃঙ্খলা নিয়ে তাঁকে সতর্ক করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
নিদান দিলেন ‘রাজনৈতিক চাপ’ হোক কিংবা ‘রাজ্যপালের ফোন’ কারও দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে যেন নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেন ওই জেলার পুলিশ সুপার।
এদিন সর্বসমক্ষেই মুখ্যমন্ত্রী ওই পুলিশ সুপারকে অভয় দিয়ে বলেন, কাজ করতে কি ভয় হচ্ছে। সেরকম হলে যেন সরাসরি তাঁকে জানানো হয়, এমনই নির্দেশ মমতার।
তবে প্রকাশ্যে পুলিশ সুপারকে ভৎসনা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হল। ঘটনার ভিডিও টুইট করলেন রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়। সমালোচনায় মুখর হলেন বিরোধীরা।
পুরভোটের ঘোষণা হওয়ার পরপরই নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে রাজ্যের জেলাশাসক ও পুলিশ সুপারদের নিয়ে বৈঠক ডেকেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী।
সেখানে বিভিন্ন জেলা নিয়ে তাঁর যা কিছু সংশয়, যা কিছু অভিযোগ তা নিয়ে রীতিমতো কড়া দাওয়াই দিলেন প্রশাসনিক অধিকর্তাদের।
এদিন প্রশাসনিক বৈঠক থেকে পূর্ব মেদিনীপুরের পুলিশ সুপারকে দাঁড় করিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, আপনার জেলা সম্পর্কে আমি কিছু অভিযোগ পেয়েছি। কাউকে সাজিয়ে দাঙ্গা লাগানোর চেষ্টা চলছে। পরিকল্পিতভাবে সবটা হচ্ছে।
অনেকদিন ধরেই আপনাদের জানানো হয়েছে বিষয়টি। তারপর আমাকে জানানো হয়েছে এবং আমি হস্তক্ষেপ করেছি।
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, হলদিয়াতেও অভিযোগ পেয়েছি। তাই দুজনকে গ্রেফতার করতে হল। কারণ এক্সাইড ইন্ডাস্ট্রি আর ধানুকারা অভিযোগ করেছিল।
পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর প্রভাব বিস্তারের ঘটনা বেশ কিছুদিন ধরেই নজরে রাখছিলেন মুখ্যমন্ত্রী।
তবে বিধানসভার ফলাফলের পরে শুভেন্দুর ডানা অনেকটাই ছাঁটা হয়েছে। এই জেলায় বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত অভিযোগের প্রসঙ্গে এদিন নিশান করেন রাজ্যপাল জগদীপ ধনড়কেও।
কারণ বেশ কিছুদিন ধরেই রাজাপাল রাজ্যের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি তথা বিধানসভা ভোট পরবর্তী হিংসা নিয়ে রাজ্যের বিরুদ্ধে তোপ দাগছেন।
বৃহস্পতিবারের প্রশাসনিক বৈঠকে মমতা ওই পূর্ব মেদিনীপুরের পুলিশ সুপারকে প্রশ্ন করেন, রাজ্যপাল কি ফোন করছেন? কেউ কি রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করছেন?
অবশ্য করলেও তুমি বলবে না প্রকাশ্য প্রশাসনিক বৈঠকে এই ধরনের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না পূর্ব মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার অমরনাথ।
সাজানো দাঙ্গা নিয়ে সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীর জেরার মুখে পড়ে তিনি বলেন, আমার তদন্ত করে অ্যাকশান নিয়েছি ম্যাডাম। অতিরিক্ত বহিনী মোতায়েন করেছি।
এরপর মুখ্যমন্ত্রী হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন, যাঁরা দাঙ্গা করে, তাঁরা হিন্দু বা মুসলিম কোনও ধর্মেরই নয়। কোনও কোনও রাজনৈতিক নেতা পেছন থেকে ইন্ধন দেয়, তাই দাঙ্গা হয়।
সুতরাং এটা তোমাকে কড়াভাবে দেখতে হবে। একথা বলে পূর্ব মেদিনীপুরের পুলিশ সুপারকে কড়া বার্তা দিলেন মমতা। এখানেই থেমে না থেকে তিনি সরাসরি ওই পুলিশ আধিকারিককে জিজ্ঞেস করেন, তোমার কি ওখানে কাজ করতে ভয় করছে? তোমাকে কি রাজ্যপাল ফোন করেন। বলেন, এটা করবে না, ওটা করবে না তোমার ওসব দেখার দরকার নেই। মনে রেখো, তুমি রাজ্য সরকারের কাজ করছ। মুখ্যমন্ত্রীর এই অভয়বাণী পেয়ে ওই পুলিশ সুপার কতটা আশ্বস্ত হলেন সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। তবে এইভাবে প্রকাশ্যে পুলিশ সুপারকে ধমক দেওয়ার জন্য মুখ্যমন্ত্রীর সমালোচনা করলেন রাজ্য বিজেপি নেতারা।
পূর্ব মেদিনীপুরের পাশাপাশি এদিন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে ব্যারাকপুরের কমিশনারেটকেও এদিন কড়া বার্তা দেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
গত কয়েকদিনে ইছাপুরে এক তৃণমূল নেতা খুন এবং হালিশহরে বোমা বিস্ফোরণে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।
এইসব প্রসঙ্গ তুলে ব্যারাকপুর কমিশনারেটকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, বাইরে থেকে ক্রিমিনালরা ঢুকছে। দুই-তিনটি পরিকল্পিত ঘটনা ঘটছে।
দরকারে এসটিএফ এবং কলকাতা পুলিশের সাহায্য নিতে পরামর্শ দেন মমতা। সীমান্তে ট্রাক টার্মিনাসে টাকা নয়ছয় নিয়েও ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী।
এবার সীমান্তের ট্রাক চলাচলে রাজ্য সরকারের পরিবহণ দফতরের নিয়ন্ত্রণ জারি করা হচ্ছে বলে জানিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী। বৃহস্পতিবারের প্রশাসনিক বৈঠকের এই অধ্যায় প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ।
পর্যবেক্ষকদের মতে, এদিন মুখ্যমন্ত্রী শুধু যে পূর্ব মেদিনীপুরের জেলা পুলিশ সুপারকে বার্তা দিলেন তাই নয়, চাপে রাখা হল বিভিন্ন জেলার প্রশাসনিক কর্তাদের। এইভাবে মুখ্যমন্ত্রী বুঝিয়ে দিলেন সব কিছুর ওপরই তাঁর তীক্ষ্ণ নজর রয়েছে।
তবে প্রকাশ্যে পুলিশ সুপারদের এইভাবে প্রকাশ্যে তিরস্কার করা নিয়ে বামফ্রন্টের শমীক লাহিড়ি বলেন, এইভাবে পুলিশ সুপারের মিডিয়া ট্রায়াল করালেন মুখ্যমন্ত্রী।
আসলে সামনেই পুরভোট এবং মিউনিসিপ্যাল ভোট আসছে। পুলিশ সুপাররা যাতে নিরপেক্ষ কাজ না করতে পারে, সেজন্য তাদের চাপে রাখলেন মুখ্যমন্ত্রী।
বিজেপি নেতা শমীক ভট্টাচার্য বলেন, মুখ্যমন্ত্রী প্রশাসনিক প্রধান, রাজাপাল সাংবিধানিক প্রধান।
কিন্তু প্রকাশ্যে সাংবিধানিক প্রধান তথা রাজ্যপালের প্রসঙ্গ টেনে সাংবিধানিক সংকট তৈরি করলেন মুখ্যমন্ত্রী।
প্রাক্তন কিছু আমলার মতে, মুখ্যমন্ত্রীর কিছু বলার থাকলে আলাদা করে ডেকে নিয়ে বলতে পারতেন।
ওই বৈঠকে আমলাদের মনোবল তলানিতে চলে যাচ্ছে। এইভাবে প্রকাশ্যে পুলিশ সুপারকে তিরস্কার করায়, ওই পুলিশ সুপার তাঁর অধক্তনদের কাছে হেয় প্রতিপন্ন হলেন।
আবার প্রাক্তন আমলাদের একাংশের মতে, নির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতেই মুখ্যমন্ত্রী পুলিশ সুপারকে সতর্ক করেছেন। প্রশাসনিক নিয়ম শৃঙ্খলা বজায় রাখতে এটা তিনি করতেই পারেন।