• facebook
  • twitter
Saturday, 26 April, 2025

সুপ্রিম রায়ে পথে শিক্ষক-শিক্ষিকারা

ব্যাপক দুর্নীতি এবং নানা কারচুপির জন্য স্কুল সার্ভিস কমিশনের (এসএসসি) ২০১৬ সালের নিয়োগ প্রক্রিয়ার পুরো তালিকা বাতিল করেছে সুপ্রিম কোর্ট।

নিজস্ব চিত্র

ব্যাপক দুর্নীতি এবং নানা কারচুপির জন্য স্কুল সার্ভিস কমিশনের (এসএসসি) ২০১৬ সালের নিয়োগ প্রক্রিয়ার পুরো তালিকা বাতিল করল মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ। এর ফলে ২৫,৭৫৩ জন শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মীর চাকরি বাতিল এবং চাকরিরত অসহায় শিক্ষকেরা পথে বসলেন। ভাগ্যের এমনই পরিহাস যে, এই বাতিল হওয়া তালিকায় যেসব শিক্ষক-শিক্ষিকারা যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে চাকরি পেয়েছিলেন তাঁরাও পড়ে গেলেন। যেহেতু যোগ্য ও অযোগ্য শিক্ষকদের আলাদা করে দেখার গ্রহণযোগ্য কোনও তথ্যপ্রমাণ ছিল না। তাই যোগ্যদেরও চাকরি গেল এবং তাঁদের জীবনে বিড়ম্বনা নেমে এল।

মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের এই ঐতিহাসিক রায় ঘোষণার পর যেমন রাজনৈতিক বিতর্ক শুরু হয়ে গেল, তেমনই চাকরিহারা শিক্ষক ও শিক্ষিকারা অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন। তাঁদের অনেকের আয়েই সংসার চলত, অনেক পরিবারে যাঁরা অসুস্থ, তাঁদের চিকিৎসা চলত। চলতে ছেলেমেয়েদের পড়াশুনা এবং সংসার চালানো। প্রচুর সংখ্যায় শিক্ষক যাঁরা পরীক্ষায় সফল হয়ে যোগ্যতার নিরিখে চাকরিতে ঢুকেছিলেন, তাঁরাও চরম অসহায়ের মধ্যে পড়ে গিয়ে চোখের জল মুছলেন। যাঁরা অযোগ্য, তাঁদের কথা না হয় ছেড়েই দেওয়া যায়, কারণ তাঁরা নানা কারচুপি ও অসুদোপায় অবলম্বন বা বিপুল পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে চাকরি পেয়েছিলেন, তাঁদের জন্য কারওর সমবেদনা নেই, কিন্তু যোগ্যরা বিনা দোষে দোষীদের মধ্যে পড়ে গিয়ে এখন চোখে অন্ধকার দেখছেন। কেন যোগ্য ও অযোগ্য আলাদা করা গেল না— সেই প্রশ্নই সবার মুখে মুখে। বি

বিপুল সংখ্যাক শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের চাকরি যাওয়ার ফলে, এখন রাজ্যের বহু স্কুলে শিক্ষকের অভাবে পড়াশুনা প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে যাঁরা পড়াতেন, তাঁদের চাকরি চলে যাওয়ায় এই দুই শ্রেণির পড়ুয়ারা এখন অঘাত জলে পড়ে গেল। বলতে গেলে রাজ্যের ইশক্ষার ব্যবস্থাই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ল। এর জন্য দায়ী কে বা কারা, তাদের খুঁজে বের করে আইনি প্রক্রিয়ায় শাস্তির বিধান করা এখন মানুষের প্রধান দাবি। অনেক স্কুলে অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে স্কুল ও ক্লাশ শুরু ও শেষ হওয়ার সময়সীমা জানিয়ে বেল (ঘণ্টা) বাজানোর অশিক্ষক কর্মী নেই। দলে একটি স্কুলের প্রধানশিক্ষককে এই কাজ। অর্থাৎ ক্লাশ শেষ হওয়ার বেল বাজাতে দেখা গেল। এই ধরনের অপ্রত্যাশিত ও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা অতীতে ঘটেছে বলে কারওর জানা নেই। সবচাইতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে যাচ্ছে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীরা। কারণ তাদের বিভিন্ন বিষয়ে ক্লাশ নেওয়ার শিক্ষকের অভাব। আর এই পড়ুয়ারাই আগামীতে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় বসবে। তাদের ক্লাশগুলি ফাঁকা যাচ্ছে, যেহেতু শিক্ষকের অভাব। যাঁরা পড়াতেন,তাঁরা যোগ্য-অযোগ্য যাই হোক, মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির কলমের খোঁচায় তাঁদের চাকরি চলে গেল।

বিরোধী রাজনৈতিক নেতারা এই চরম অনৈতিক অবস্থা সৃষ্টির জন্য মুখ্যমন্ত্রীকে দায়ী করে তাঁর পদত্যাগ দাবি করেছেন। তাঁদের অভিযোগ, মুখ্যমন্ত্রী সব জানতেন এবং জেনেও দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রীর হাতে রাজ্যের শাসনভার, সুতরাং প্রশাসনের কোন দফতরে কোথায় কী ঘটছে, তা তিনি জানেন বলে গর্ব ভরে বলেন। প্রাক্তন আইএএস অফিসার এবং প্রাক্তন তৃণমূল সাংসদ জহর সরকারও মুখ্যমন্ত্রীর সমালোচনা করে বলেন, তিনি কিছু জানেন না, এটা হয় না। মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের রায়ের কপি সামনে পেয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নবান্নে সাংবাদিক সম্মেলন করে বলেন, বিচার ব্যবস্থার প্রতি তাঁর পূর্ণ শ্রদ্ধা/আস্থা আছে। কিন্তু এই রায় তিনি মানতে পারছেন না। তিনি বিজেপি এবং সিপিএমের দিকে আঙুল তুলে বলেন, ‘এই কাজ ওরাই করিয়েছে’— কিন্তু এর ফল ওদের ভোগ করতে হবে। তাঁর অভিযোগ, বামেদের আমলে চিরকুটে চাকরি মিলত। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দেন এসএসসি একটি স্বশাসিত সংস্থা। সরকার তাদের বিষয়ে নাক গলায় না।

মুখ্যমন্ত্রী বলেন, তিনি চাকরিহারাদের পাশে আছেন এবং ভবিষ্যতেও থাকবেন। তাঁদের চোখের জল যাতে আর না ফেলতে হয়, তার জন্য যা যা ব্যবস্থা আইনানুযায়ী নিতে হয় নেবেন। আগামী ৭ এপ্রিল তিনি নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে চাকরিহারাদের সঙ্গে মিলিত হবেন এবং তাঁদের সান্ত্বনা জানাবেন। আইনজীবীরা অবশ্য বলেন, মুখ্যমন্ত্রী চাকরিহারাদের সান্ত্বনা জানানো ছাড়া আর কী বলতে পারেন, তা তাঁরা ভাবতে পারছেন না। সুপ্রিম কোর্টের পুরো রায় পর্যালোচনা করে মুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, মানবিক কারণেই তিনি এই রায় নিতে পারছেন না। বিরোধীরা বলছেন, তিনি নাকি দায়ী? কী করে? তাঁর প্রশ্ন, স্কুল সার্ভিস কমিশন একটি স্বাধীন সংস্থা। তার কাজে সরকার হাত দেয় না। তদানীন্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এখন জেলে। তৃণমূল মন্ত্রিসভায় তিনি দুই নম্বরে ছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে পার্থদা বলে সম্বোধন করতেন।

মামলাকারী সিপিএমের আইনজীবী ও রাজ্যসভার সাংসদ বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য এবং প্রাক্তন বিচারপতি এখন বিজেপির সাংসদ অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়কে কটাক্ষ করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘চাকরি দেওয়ার ক্ষমতা নেই, চাকরি কেড়ে নেবেন না। বিকাশবাবুর তো নোবেল পুরস্কার পাওয়া উচিত।’ এই ২৫,000-এর ওপর শিক্ষকদের চাকরি হারানোকে রাজ্যের মানুষ কীভাবে নেবে, তার প্রভাব রাজ্যে কতটা পড়বে, তাই এখন রজনৈতিক মহলের আলোচ্য বিষয়। ২০২৬ সালে বিধানসভার নির্বাচনে বিরোধী নেতাদের কাছে একটা বড় সুযোগ এসে গেল পাহাড়সমান দুর্নীতির অভিযোগে এত শিক্ষকের চাকরি যাওয়া। তাঁদের সংসার এখন কীভাবে চলবে? এই দুর্মূল্যের বাজারে তাঁদের জীবনে অন্ধকার নেমে এল।