শুনতে কিছুটা অবাক মনে হলেও এটাই বাস্তব। মস্তিষ্ক এবং কৌশলেই একে অপরকে টেক্কা দেওয়ার রাজনীতি শুরু হয়েছে দেশজুড়ে। ব্যাতিক্রম নয় এই রাজ্যও। প্রতিপক্ষের দোষ ত্রুটি চুলচেরা বিশ্লেষণ করে আগেভাগেই ২০১১-এর বিধানসভা নির্বাচনের প্রস্তুতি সেরে রাখতে চায় শাসক দল। তৃণমূল কংগ্রেসের অন্দরে কান পাতলেই এমনই খবর পাওয়া যাচ্ছে। ২৯৪ টি বিধানসভার রাজনৈতিক মানচিত্র তৃণমুল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অজানা নয়। সে কারণে অনেকটা আগে থেকেই বিধানসভা ভিত্তিক ফলাফল বিশ্লেষণ করে আগামী রণকৌশল ছকে রাখছে তৃণমূল।
এক্ষেত্রে দু’তিনটি গেম প্ল্যানও রয়েছে। কোন আসনে কি ধরনের প্রার্থী প্রয়ােজন কাকে টিকিট দিলে দলে ভারসাম্য বজায় থাকবে সেই সঙ্গে জয়ও মসৃণ হবে। বিভিন্ন দিক মাথায় রেখে এই ছক কষা হচ্ছে। তবে পুরসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে আসলে একুশেরই কৌশল রচনা করছে তৃণমূল। এক্ষেত্রে বিজ্ঞানভিত্তিকভাবে বুথস্তর পর্যন্ত ইতিমধ্যে ডেটা সংগ্রহ করেছে প্রশান্ত কিশােরের টিম। পুরসভা নির্বাচনেও দলীয় প্রস্তুতিও তুঙ্গে। যদিও বাইরে থেকে দেখলে বােঝার কোনও উপায় নেই। কারণ কেন্দ্রে বিজেপি শাসিত সরকার রয়েছে। অন্যান্য রাজ্যগুলির বিধানসভা নির্বাচনের ক্ষেত্রে যে ধরনের কৌশল অবলম্বন করে অবিজেপি রাজ্যগুলির শাসক দলকে রাজনৈতিকভাবে বেকায়দায় ফেলতে বিভিন্ন সময়ে বিজেপি তৎপর হয়ে উঠেছে এ রাজ্যের ক্ষেত্রেও এমন কৌশল বিজেগি নেবে না কে বলতে পারে। ফলে সম্ভাব্য সব ধরনের পরিস্থিতির মােকাবিলা করার জন্য মমতার টিম তৃণমূল তৈরি। এমনই আভাস পাওয়া গিয়েছে।
কলকাতা পুরসভা নির্বাচন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে হলে তৃণমূলের খুব একটা অসুবিধা হবে না। কারণ রাজ্যের শাসক দল হওয়ার যে সুবিধা তা তৃণমুলের পক্ষেই যাবে। অন্যদিকে রাজ্যের তিনটি বিধানসভা উপনির্বাচনের ফলাফলে তৃণমুলের নেতা কর্মীরা যথেষ্টই উজ্জীবিত। তার ফসল দ্রত নিজেদের ঘরে তােলার জন্য শাসক দল ব্লু প্রিন্ট তৈরি করছে।
রাজ্যে বিজেপির হাতে চলে যাওয়া প্রায় সব পুরসভা পুনর্দখল সম্ভব হচ্ছে। ভাটপাড়া পুরসভাও তৃণমূল নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে চলেছে দ্রুত। সেই সঙ্গে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় শাসক দলের কার্যালয় দখল মুক্ত হওয়া সম্ভব হয়েছে। বিজেপি বিভিন্ন রাজ্যে নির্বাচনী ফলাফলে পিছিয়ে থেকেও সে রাজ্যে সরকার গড়েছে। এমন নজির রয়েছে। সে কথাও তৃণমূলের অজানা নয়। ফলে আগামী দিনে যারা তৃণমূলের টিকিটে বিধানসভায় লড়ার ছাড়পত্র পাবেন তাদের শাসক দলের প্রতি দায়বদ্ধতায় যাতে কোনও ধরনের প্রশ্নচিহ্ন না থাকে সেটাও প্রধান বিবেচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে।
যতদূর জানা গিয়েছে শুধু দলীয় নেতারাই নয় বিভিন্ন ক্ষেত্রের যেমন অভিনয়, খেলাধুলা, শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তিদের পাশাপাশি সাংবাদিক ও স্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত স্বচ্ছ ভাবমূর্তির মানুষজনের উপর এবারও নজর থাকছে তৃণমুলের। নতুন মুখেরও সম্ভাবনা উজ্জ্বল। সব মিলিয়ে বিধানসভা কেন্দ্রের রাজনৈতিক তাৎপর্য বিচার করে প্রার্থী বাছাই করা হবে যাতে করে প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিকভাবে পর্যুদস্ত করে সহজে জয় তুলে আনা সম্ভব হয়।
অন্যদিকে বসে নেই বিজেপিও। তিনটি বিধানসভার উপনির্বাচনে পরাজিত হয়ে বিজেপি রীতিমতাে ব্যাকফুটে। ডিসেম্বর মাসের মধ্যে বিজেপির সাংগঠনিক নির্বাচন শেষ হওয়ার কথা। নতুন বছর থেকে বাংলা দখলের লড়াইয়ে বিজেপি ঝাঁপাবে এমনটাই জানা যাচ্ছে। তবে তার আগে দলীয় সাংগঠনিক নির্বাচন শেষ করার পাশাপাশি বুথস্তর পর্যন্ত রাজ্যের শাসক দলকে টেক্কা দিতে সেই সঙ্গে পিকে মােকাবিলায়ও কোমর বেঁধে নামছে বিজেপি। কর্পোরেট কায়দায় রাজ্যের আমজনতার মনকে কিভাবে স্বপক্ষে আনা যায় তা নিয়ে আলােচনা শুরু হয়েছে বিজেপিতে অনেক দিন আগে থেকেই।
কিন্তু রাজ্যে বিজেপিকে নেতৃত্ব দেওয়ার প্রশ্নে দলের মধ্যেই বিস্তর সমস্যা রয়েছে। বিজেপির সর্বভারতীয় স্তরের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে রাজ্য বিজেপি সেই সঙ্গে আরএসএসের ঘনিষ্ট যােগাযােগ রয়েছে, এমন নেতাকে সামনে রেখেই বিজেপি বাংলায় পদ্মের সৌরভ ঘটাতে চাইছে। স্বচ্ছ ভাবমূর্তির নেতা বিজেপিতে নেই যে এমন নয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে তিনি কতটা জনপ্রিয়। এই জায়গাতেই ধাক্কা খাচ্ছে বিজেপি। আলােচনার মাধ্যমে সেই সমস্যা কাটিয়ে উঠে নতুন বছরের শুরুতেই অন্য মেজাজে পাওয়া যেতে পারে বিজেপিকে। যদিও মহারাষ্ট্রের বিধানসভার নির্বাচন এবং সেই সঙ্গে এনআরসি ইস্যুতে যথেষ্টই নড়বড় লেগেছে বিজেপি নেতাদের। তবে সংসদে জাতীয় নাগরিক সংশােধনী বিল পাশ করে নিয়ে এসে তা শুধু বাংলা নয় দেশের মানুষের মধ্যে প্রচার করে বিজেপি এর ফায়দা তুলতে চাইছে।
বাম-কংগ্রেসের মধ্যে সম্পর্কের রসায়ন নিয়েও এই দুই দলের মধ্যে আলােচনা শুরু হয়েছে। কংগ্রেসের মধ্যে তৃণমূল পন্থী নেতার অভাব নেই। তাদের সিংহভাগ তৃণমূলের সঙ্গে জোট করে ভােটে লড়ার পক্ষপাতী। যদিও রাজ্যের তিনটি বিধানসভার উপনির্বাচনে এ রাজ্যে ত্রিমুখী লড়াইয়ে তৃণমূলেরই লাভ হয়েছে। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনের আগে ২০২০-র পুরসভা নির্বাচন মহড়া হতে চলেছে।
রাজনৈতিক মহলের একাংশের মতে, যারা পঞ্চায়েত, পুরসভার মতাে স্থানীয় নির্বাচনে জয়ী হয় দিনের শেষে দেখা গিয়েছে বিধানসভা নির্বাচনে তাদেরই পাল্লা ভারি। ফলে পুরসভা নির্বাচন তৃণমুলের কাছে অনেকটা অ্যাসিড টেস্টের মতাে। এদিকে পিছিয়ে থেকেও দুটি কেন্দ্রে বিধানসভা উপনির্বাচনে যেভাবে তৃণমূল জয় ছিনিয়ে নিয়েছে বিজেপির কাছ থেকে তা অতি বড় বিজেপি সমর্থকও কখনও ভাবতে পারেনি। তৃণমূল চায় জয়ের এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে।
অন্যদিকে বিজেপিও বুথস্তরে শাসক দলের মাটি আলগা করে দেওয়ার জন্য যেন বিধানসভা নির্বাচনকেই পাখির চোখ করছে। সব মিলিয়ে একুশের বিধানসভা নির্বাচন এখনও অনেক দেরি হলেও রাজ্য রাজনীতি কিন্তু নতুন বছরের শুরুতেই সরগরম হতে চলেছে।