অগ্নিগর্ভ অমিত শাহর রোড শো

অমিত শাহর রোড শো-তে দাঙ্গা-হাঙ্গামা'র চিত্র (Photo: IANS)

নাচ গান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দিয়ে শুরু হয়েছিল, শেষটা হল বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা, দাঙ্গা-হাঙ্গামা দিয়ে। বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহের রােড শােকে কেন্দ্র করে অগ্নিগর্ভ শহর কলকাতা।

এদিন অমিত শাহের রােড শাে কলেজ স্ট্রিটে পৌছতেই কালাে পতাকা দেখিয়ে ‘গাে ব্যাক’ স্লোগান তােলে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সমর্থকরা। অমিত শাহ বাংলাকে ‘কাঙাল’ বলার বিষয়টির সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি তারা। এই মন্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করা হয় ছাত্রছাত্রীদের তরফে।

অমিত শাহের সভা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে পৌছতেই বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সমর্থকরা। এদিকে ব্যারিকেড ভেঙে বিক্ষোভরত ছাত্রছাত্রীদের ওপর পাল্টা চড়াও হয় বিজেপি কর্মী এবং এবিভিপির সমর্থকরা। দু’পক্ষের মধ্যে ইট-পাটকেল ছোঁড়াছুড়িও শুরু হয়। রােড শাে একটু এগিয়ে বিদ্যাসাগর কলেজের সামনে যেতে আরও মারাত্মক আকার ধারণ করে এই রােড শাে। সেখানে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সমর্থকদের ওপর হামলা করে এবিভিপির সমর্থকরা, এমনটাই অভিযােগ ওঠে।


তৃণমূল-বিজেপির সংঘর্ষে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে কলেজ চত্বর। বিদ্যাসাগর কলেজের সামনে তিনটি বাইকে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এই দাঙ্গায় ভেঙে ফেলা হয় বিদ্যাসাগরের মূর্তিও। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে লাঠিচার্জ করে পুলিশ। এরপর বিধান সরণি বন্ধ করে দেয় পুলিশ। ঘটনাস্থলে প্রচুর পুলিশ মােতায়েন করা হয়।

শুধু তাই নয়, রােড শাে শুরুর আগেই গণ্ডগােলের সূত্রপাত হাের্ডিং খােলা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়। মঙ্গলবার দুপুরে ধর্মতলা চত্বরে সরকারি জায়গায় লাগানাে হাের্ডিংগুলি খুলে ফেলে পুলিশ। পুলিশ সূত্রে দাবি, নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ মােতাবেকই এই হাের্ডিংগুলি সরিয়েছে তাঁরা। পুরাে ঘটনাক্রমের ভিডিও করা হয় পুলিশের তরফে। এদিকে পুরাে বিষয়টিই রাজ্য প্রশাসনের চক্রান্ত বলে অভিযােগ তােলে বিজেপি। তাদের কথায় হাের্ডিং শুধু খােলা হয়নি, বরং তা ভাঙচুরও করেছে পুলিশ। পুরাে ঘটনার প্রতিবাদে সাময়িকভাবে ধর্নাতেও বসেন কৈলাস বিজয়বর্গীয়। যদিও কিছুক্ষণ পরেই ধর্না থেকে উঠে রােড শােতে যােগ দেন তিনি।

এদিনের কর্মসূচি ছিল পুরােদস্তুর রাজনৈতিক সভা। রাস্তা মােড়া ছিল গেরুয়া বেলুন, অমিত শাহ-মােদির হাের্ডিং পােস্টারে। কিন্তু আদৌ কি রাজনীতি নিয়ে ভাবার সুযােগ করে দিল অমিত শাহের রােড শাে? নাকি ভরতনাট্যম, ভাঙড়া, মাদ্রিনাচ, অসমিয়া নাচ থেকে শুরু করে সাঁওতালি নাচ ও ঢাকের তালে আদপে ‘ছন্দ কাটল’ আদ্যোপান্ত রাজনৈতিক প্রচারের জন্য আয়ােজিত এই প্রচার অভিযানের? উঠছে এই প্রশ্ন।

মঙ্গলবার শহরে অমিত শাহের রােড শাে নিয়ে আত্মবিশ্বাসী ছিলেন রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব। এমনকি এই শাে ‘ঐতিহাসিক’, এমনটাও দাবি করছে গেরুয়া শিবিরের। এদিন বিকেল ৪টে নাগাদ শহিদ মিনার থেকে অমিত শাহের রােড শাে শুরু হওয়ার কথা থাকলেও অনুমতি নিয়ে জটিলতার কারণে ধর্মতলা রােড থেকে তা শুরু হয়।

প্রসঙ্গত, শহিদ মিনারে কোনও সভা করতে গেলে কমপক্ষে ২৪ ঘন্টা আগে অনুমতি নিতে হয়। কিন্তু অমিত শাহের রােড শােয়ের জন্য নির্দিষ্ট সময়ে অনুমতি না চাওয়ায় বাধ্য হয়ে রােড শাে শুরুর স্থান পরিবর্তন করে ধর্মতলা রােডে করা হয়। এই ধরনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সভায় অনুমতির ক্ষেত্রে কেন সময় থাকতে আবেদন করলেন না রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব, তা নিয়েও উঠছে প্রশ্ন।

মঙ্গলবার দুপুর থেকেই বিভিন্ন জায়গা থেকে লােকজন জমায়েত হতে শুরু করে শহিদ মিনার চত্বরে। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে লােকজন আসার পাশাপাশি গুজরাত, অন্ধপ্রদেশ থেকেও এদিনের সভায় যােগ দিতে এসেছিলেন বহু মানুষ। এদিকে ধর্মতলা রােড থেকে যে রাস্তায় অমিত শাহের রােড শাে যাওয়ার কথা ছিল , তা সাজানাে হয় গেরুয়া বেলুন এবং বিজেপির পােস্টার দিয়ে। মঙ্গলবার সাংস্কৃতির অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে এগােতে থাকে রােড শাে। যদিও কর্মসূচিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তথা রাজ্য সরকার বিরােধী যে গান বাজছিল তা বাজছিল হিন্দি ভাষাতেই।

এরপর একেএকে বনপাধারীদের প্রদর্শন, মহিলা ঢাকিদের ঢাকের ছন্দে শুরু হয় রােড শােটি। কর্মসূচির জাঁকজমক এত বেশি ছিল যে বিরােধিতার সুর সেই জঁকজমকের কাছে কিছুটা ফিকে পড়ে গিয়েছিল, এমনটাই মত অভিজ্ঞ মহলের। প্রথম লগ্নে রােড শােতে যােগ দিতে আসা বিভিন্ন প্রান্তের শিল্পীদের বাদ দিলে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসাবে দেখা যায় লকেট চট্টোপাধ্যায় এবং সুরেন্দ্র সিং আলুয়ালিয়াকে। মিছিলের মধ্য থেকে একদিকে যেমন জয় ‘শ্রী রাম’ ধ্বনি উঠছিল, তেমনই হনুমান বেশধারী কিছু বিজেপি সমর্থককে দেখা যায় এদিনের রােড শােতে।

পাশাপাশি প্লাস্টিকের গদা হাতে ছিল খুদেরাও। ভরতনাট্যম, ভাঙড়া, সাঁওতালি নাচ- রাজনৈতিক সভায় বিভিন্ন ধরনের সংস্কৃতির স্বাদ উপভােগ করছিলেন সাধারণ মানুষ । রােড শাে শুরু হওয়ার প্রায় ১৮ মিনিট পরে শােতে যােগদান করেন বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ। প্রাথমিকভাবে তিনি একটি খােলা জিপে ছিলেন এবং তাঁর সঙ্গে ছিলেন রাহুল সিনহা। পেছনের একটি গাড়িতে ছিলেন দিলীপ ঘােষ, রূপা গঙ্গোপাধ্যায় এবং মুকুল রায়। এছাড়াও কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছিলেন বাবুল সুপ্রিয়, অনুপম হাজরা সহ অন্যান্য বিজেপি নেতা। সাধারণ মানুষের উদ্দেশে হাত নাডেন অমিত শাহ। একটু এগিয়ে যাওয়ার পর অবশ্য গাড়ি পরিবর্তন করেন তিনি। শঙ্কুদেব পণ্ডা যে গাড়িতে ছিলেন, সেটিতে উঠে পড়েন বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি। সঙ্গে ছিলেন কলকাতা উত্তর ও দক্ষিণের প্রার্থী রাহুল সিনহা ও চন্দ্র বসু এবং দিলীপ ঘােষ। জনতার উদ্দেশে ফুলও ছোঁড়েন তিনি।

এদিকে হুড়ােহুড়িতে মাঝেমধ্যেই বিশৃঙ্খলা তৈরি হচ্ছিল শাে চলাকালীন। অমিত শাহ অবশ্য হাত নেড়ে নিরাপত্তারক্ষী এবং সমর্থকদের শৃঙ্খলা বজায় রাখার নির্দেশ দিচ্ছিলেন বারংবার। এদিন অমিত শাহের এই রােড শােয়ের বিরােধিতা করে ‘গো ব্যাক’ স্লোগান তােলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সমর্থকরা। বিক্ষোভের মধ্য দিয়েই অবশ্য এগিয়ে যায় শােটি। সিমলা স্ট্রিটে এই কর্মসুচি শেষ হওয়ার কথা থাকলেও পুলিশের অনুমতি না পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত বিবেকানন্দ ক্রসিং-এই তা শেষ হয়।

কিন্তু শেষ দফার ভােটে কতটা লাভজনক হবে অমিত শাহের এই বর্ণাঢ্য কর্মসচি। বিষয়টি নিয়ে আশাবাদী বিজেপি নেতৃত্ব। এক বিজেপি নেতার কথায়, এই ধরনের সফল রাজনৈতিক সভা দীর্ঘদিন দেখেনি শহর কলকাতায়। অবশ্য এই বক্তব্যের পাল্টা হিসাবে কটাক্ষ করে এক তৃণমূল নেতার দাবি, রাজনৈতিক সভা নয়, গান-নাচের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের মনােরঞ্জন করার চেষ্টা করেছিল বিজেপি। সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা এবং ভালবাসা থেকেই প্রথমার্ধে তা দেখছিল কিছু মানুষ। কিন্তু বিশৃঙ্খলা তৈরি হওয়ায় বিজেপির সেই প্রয়াসও বাংলার মানুষ প্রত্যাখান করেছে বলে দাবি ওই তৃণমূল নেতার।