কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই পেশাদারি দক্ষতা ও দায়িত্ব পালনে যে কতটা অদক্ষ ও অপদার্থ তা আর একবার প্রমাণ হয়ে গেল আরজিকরে তরুণী চিকিৎসকের নৃশংস ধর্ষণ-খুনের ঘটনায়। তথ্যপ্রমাণ লোপাট ও অদলবদলের গুরুতর অভিযোগে ধৃত হাসপাতালের প্রাক্তন অধ্যক্ষ এবং স্থানীয় থানার ওসি সন্দীপ ঘোষ ও অভিজিৎ মণ্ডলের জামিন হয়ে গেল সিবিআই-এর নিষ্ক্রিয়তায়। আদালতের এজলাসে সিবিআই যা জানিয়েছিল, চার্জশিটে তা জানাতে পারেনি।
৯ আগস্ট আরজি করের সেমিনার রুমে অর্ধনগ্ন অবস্থায় পড়ে থাকা পড়ুয়া-চিকিৎসকের দেহের কয়েক ফুট দূরত্বে বহিরাগতদের প্রায় মেলার মতো ভিড় করে থাকার যে ভিডিও প্রকাশ্যে এসেছিল, তা পর্যন্ত তথ্য-প্রমাণ হিসাবে চার্জশিটে উল্লেখ করতে পারেনি সিবিআই। ৯ আগস্ট রাতে কেন অতি তৎপর হয়ে পুলিশ দেহ দখল করে বাবা-মায়ের সম্মতি ছাড়াই সোদপুরের বাড়িতে নিয়ে যায়, তাঁদের অনুমতি ছাড়াই দ্বিতীয় ময়নাতদন্তের কোনও সুযোগ না রেখেই তৎপর হয়ে দ্রুত সৎকার করা হলো, তা অন্তত তথ্য-প্রমাণ লোপাট হিসাবে গণ্যই করেনি সিবিআই। কেন সকালে দেহ উদ্ধার হওয়ার পর রাতে এফআইআর নেওয়া হলো, কেন বাবা-মা’কে তিন ঘণ্টা বসিয়ে রেখেও মেয়ের দেহ দেখতে দেওয়া হল না, তা আদালতে জানালেও চার্জশিটে উল্লেখ করার ‘নিরপেক্ষতা’ দেখাতে পারেনি সিবিআই। অকুস্থল কি চারতলার মেডিসেনর সেমিনার রুমই, ৯০ দিন পরও তা জানাতে পারেনি সিবিআই। আদালতেই সন্দীপ ঘোষ ও টালা থানার প্রাক্তন ওসি’র কথোপকথনেই তথ্য-প্রমাণ লোপাট, ঘটনার পরে তা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টার তথ্য মিলেছে জানালেও, চার্জশিটে তার সামান্য উল্লেখ পর্যন্ত করেনি সিবিআই।
এইসব ঘটনা পরম্পরাই স্পষ্ট করছে, আরজি করে পড়ুয়া চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় ‘বৃহত্তর ষড়যন্ত্রে’র চেহারাকেই, যা সিবিআইয়ের চোখে চার মাস পরেও ধরা পড়েনি।
দেশের অন্যতম প্রধান একটি কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার পেশাদারিত্ব, তদন্তের মুন্সিয়ানা, যোগ্যতা নিয়েই গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে। তদন্তের চেহারা নিয়ে নিজেদের দাবির সঙ্গেই এমনতর বৈপরিত্য সাম্প্রতিককালে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার কোনও তদন্তেই দেখা যায়নি। ৯০ দিন পেরিয়ে গেলেও চার্জশিট দিতে না পারার কথা অবলীলায় জানিয়েছেন তদন্তকারী আধিকারিক সীমা আহুজা। অতিরিক্ত চার্জশিট জমা দিলে বিচার প্রক্রিয়া বিলম্বিত হবে বলে সিবিআইয়ের যুক্তি আদৌ গ্রহণযোগ্য নয় বলে মনে করেন আইনজীবীরা। দুই অভিযুক্তকে চার্জশিট জমা না দিয়ে জামিন পাইয়ে দেওয়া কতটা আইনত যুক্তিযুক্ত তা নিয়েও গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে। যদিও সিবিআইয়ের তরফে এ বিষয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া বা বিবৃতি দেওয়া হয়নি।
সমাজমাধ্যমেই ভাইরাল হয়েছিল গত ৯ আগস্ট সকালে সেমিনার রুমের ভিতরের একটি ভিডিও। সেই ভিডিওটি ভুয়ো এমন দাবি পুলিশও করেনি। বরং সেই ভিডিও দু’তিন দফায় লালবাজারে বসে সাংবাদিকদেরও দেখিয়েছিল কলকাতা পুলিশ। সেই ভিডিও ফুটেজে ৯ আগস্ট সকাল থেকে দুপুরের মধ্যে, ময়নাতদন্তের আগেই ঘটনাস্থলে মালদহ থেকে বর্ধমান হয়ে এসএসকেএম-এর চিকিৎসকরা কীভাবে চলে এলেন আরজি করের চারতলার সেমিনার রুমে? দেখা যায় ক্রাইম সিনে অর্থাৎ চারতলার সেমিনার রুমে যখন ওই চিকিৎসক-পড়ুয়ার দেহ পড়ে রয়েছে, ওই সময়তেই একাধিক মানুষের ভিড়। স্বাভাবিকভাবেই ওই ভিডিওতে ক্রাইম সিন নষ্ট করা হয়েছে। তথ্য-প্রমাণ লোপাটের অংশ হিসাবে দাবি করলেও পরে সিবিআই চার্জশিটে তার কোনও উল্লেখ করল না।
গত সেপ্টেম্বরে সুপ্রিম কোর্টে সিবিআই জানিয়েছিল রাজ্য দিয়েছে ২৭ মিনিটের ফুটেজ, তাও আবার চারটি ক্লিপিংসে। অথচ দেওয়ার কথা সারাদিনের ফুটেজ। অথচ আদালতে সে প্রশ্ন তুললেও, চার্জশিটে তা তোলেনি সিবিআই। নিজেদেরই করা আরও অজস্র অভিযোগ আদালতে তুললেও চার্জশিটে তা ধর্তব্যের মধ্যেই আনল না সিবিআই। জমা পড়া চার্জশিটের দুর্বলতার সুযোগেই জামিন পেয়ে গেলেন দুই অভিযুক্ত। ‘বৃহত্তর ষড়যন্ত্রে’র অংশ হিসেবেই দেখা হচ্ছে সিবিআইয়ের এই অপদার্থতাকে।