• facebook
  • twitter
Wednesday, 9 October, 2024

ফের পুরনো কৌশলেই ফিরতে চায় তৃণমূল

মাঠে নেমেই মোকাবিলা

দেবাশিস দাস

আগামীর কথা মাথায় রেখে সংগঠনকে কিভাবে আরও বেশি করে শক্তিশালী করা যায়, তা নিয়ে তৃণমূলের অন্দরে আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে। জনসংযোগ নিবিড় করার জন্য দলীয় নেতাদের বিশেষ নির্দেশ দেওয়া হবে রাজ্যের শাসক দলের শীর্ষ নেতৃত্বের তরফে। একটানা তিনবার মুখ্যমন্ত্রী পদে রয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। স্বাভাবিকভাবে রাজ্যজুড়ে শাসক দলের সংগঠন যথেষ্ট শক্ত ভিতের উপর অবস্থান করছে। তা সত্ত্বেও, দলের শীর্ষ নেতৃত্ব চাইছে সংগঠনে ফাঁকফোকর মেরামত করে তৃণমূলকে আরও বেশি করে গতিশীল করতে। এই নিয়ে দলের অন্দরে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে। বিভিন্ন দাবিদাওয়াকে সামনে রেখে জুনিয়র ডাক্তাররা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। আমরণ অনশনের ডাক দিয়েছেন তাঁরা। ধর্মতলায় তাঁদের অনশন চারদিনে পা দিয়েছে। পুরো পরিস্থিতির উপর নবান্নের পাশাপাশি নজর রাখছে রাজ্যের শাসক দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। সমস্যা সমাধানে উপায় খুঁজছে নবান্ন। ঠিক একই ভাবে এই অরাজনৈতিক আন্দোলন কিছুটা হলেও তৃণমূলের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরাসরি এই আন্দোলন সিপিএম কিংবা বিজেপি করলে তাহলে তা মোকাবিলা করা তৃণমূলের পক্ষে খুব কঠিন ছিল না। কিন্তু অরাজনৈতিক এই আন্দোলনের নেপথ্যে শাসক বিরোধী দলগুলি রয়েছে, এমনটাই মনে করছে তৃণমূল। জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের চালিকাশক্তি কারা, কাদের পরামর্শে রাজ্যজুড়ে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছে, তা খুঁজে বের করে সমস্যার সমাধানে ভিতরে ভিতরে উদ্যোগী হচ্ছে তৃণমূল।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনপ্রিয়তা এবং সেই সঙ্গে বিগত বাম সরকারের বিরুদ্ধে পুঞ্জীভূত ক্ষোভকে পাথেয় করে ২০১১ সালে রাজ্যে প্রশাসনিক ক্ষমতায় আসে তৃণমূল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর সেই সময় মুকুল রায়, সুব্রত বক্সি ও পার্থ চট্টোপাধ্যায় সংগঠন দেখভাল করতেন। তৃণমূলের জন্মলগ্ন থেকে সংগঠনের রাজ্য সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন সুব্রত বক্সি। মুকুল রায় তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর তৃণমূলের তাঁর মতো সংগঠন বোঝার মতো এত ক্যারিশ্মা অন্য নেতাদের ছিল না। হাতের তালুর মতো করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন গোটা রাজ্যটাকে চেনেন, ঠিক একইভাবে শুধু জেলা নয়, অঞ্চল এমনকি  বুথস্তরের নেতাদেরকেও নাম ধরে ডাকতে অভ্যস্ত ছিলেন মুকুল রায়। তিনিই ছিলেন সেই সময় দলের সেকেন্ড-ইন কম্যান্ড। বহুবার অনেক হারা ম্যাচকে নিজেদের অনুকূলে নিয়ে এসে নিজের জাত চিনিয়ে দিয়েছিলেন মুকুল রায়। সেই তিনি দল বদলে বিজেপি এবং পরে তৃণমূলে ফিরে এলেও স্বমহিমায় তাঁকে আর দেখা যায়নি। শারীরিকভাবে তিনি খুব অসুস্থ। পার্থ চট্টোপাধ্যায় পরিষদীয় রাজনীতিতে দক্ষ ছিলেন। তিনি ছিলেন দলের মহাসচিব। শিক্ষা দুর্নীতিতে গ্রেপ্তার হয়ে তিনি জেলে রয়েছেন।

স্বাভাবিকভাবে পুরনো দক্ষ নেতাদের ছাড়াই সুব্রত বক্সিকে চলতে হচ্ছে নতুন প্রজন্মের নেতাদেরকে নিয়ে। এমনই এক আবহে তৃণমূলে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্থান হয়। বর্তমানে তিনি দলে সেকেন্ড-ইন কম্যান্ড। ২০২১ বিধানসভা নির্বাচন, ২০২৩ পঞ্চায়েত নির্বাচন, ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের ভালো ফলের পিছনে অভিষেকের অবদান কোনও অংশেই কম নয়। ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে প্রশান্ত কিশোরের সংস্থা আইপ্যাককে পরামর্শদাতা হিসেবে নেয় তৃণমূল। এই সমীক্ষক সংস্থার প্রচারের কৌশল এবং ধারা নিঃসন্দেহে ছিল আকর্ষণীয়। সংগঠন এবং সমীক্ষক সংস্থার পরামর্শের উপর ভর করে সহজ জয় পায় তৃণমূল। এ রাজ্যকে ঘিরে বিজেপির প্রশাসনিক ক্ষমতা দখল করার স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়। তৃণমূল থেকে বেশ কয়েকজন হেভিওয়েট নেতা বিজেপিতে চলে গেলেও তৃণমূলকে রাজনৈতিকভাবে দুর্বল করা সম্ভব হয়নি। মূলত, সমীক্ষক সংস্থার পরামর্শকে সামনে রেখে সামনের দিকে এগোতে থাকে তৃণমূল।

বর্তমানে জুনিয়র ডাক্তারদের অরাজনৈতিক আন্দোলন সমাজে আমজনতার মধ্যে যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছে। গোটা পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে আগামী নির্বাচনগুলিতে শাসক বিরোধী দলগুলি এর ফায়দা তুলতে চায়। যদিও সাংগঠনিকভাবে তৃণমূল যথেষ্ট শক্তিশালী। কিন্তু আত্মতুষ্টিতে ভুগতে রাজি নয় শাসক দল। সে কারণে বুথস্তর পর্যন্ত সংগঠনকে চাঙ্গা করার জন্য দলের মধ্যে যথেষ্ট ভাবনা চিন্তা শুরু হয়েছে। শুধু সমীক্ষক সংস্থার উপর নির্ভর করে নয়, সাংগঠনিকভাবে যে কোনও রাজনৈতিক কিংবা অরাজনৈতিক আন্দোলনকে মোকাবিলা করার জন্য বুথস্তর থেকে তথ্য সংগ্রহে উদ্যোগী হবে তৃণমূল। এই কাজ শুধু সমীক্ষক সংস্থাকে দিয়েই নয়, নেতানেত্রীদের দিয়েও করাবে তৃণমূল। দলীয় নেতানেত্রীদের পাঠানো রিপোর্টকে সমান গুরুত্ব দিতে চায় রাজ্যের শাসক দল। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গিয়েছে, সমীক্ষক সংস্থা যে ধরনের নির্দেশিকা দিয়ে জনসংযোগ নিবিড় করতে বিভিন্ন ধারা অবলম্বন করতে বলত নেতানেত্রীদের, সেই কাজই করতে অভ্যস্ত থাকতেন বিধায়ক, সাংসদ থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্তরের জনপ্রতিনিধি, এমনকি দলীয় নেতারা।

ফলে, রণকৌশল তৈরি করে দেওয়া হত দলের শীর্ষস্তর থেকে। বর্তমান পরিস্থিতিতে এক্ষেত্রেও পরিবর্তনের সম্ভাবনা। এবার থেকে দলীয় নেতাদের রিপোর্টকেও বিশেষ গুরুত্ব দিতে চলেছে তৃণমূল। কারণ দিনের শেষে শাসক বিরোধী শক্তিগুলির সঙ্গে বুথস্তরে লড়তে হবে দলীয় নেতাদের। সমীক্ষক সংস্থা পরামর্শ দিতে পারে, পথ দেখাতে পারে, কিন্তু মাঠে নেমে লড়াই, সংগ্রামটা নেতানেত্রীদেরই করতে হবে, এমনটাই মনে করছে রাজ্যের শাসক দল। জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন কলকাতা সংলগ্ন এলাকায় যতটা প্রভাব ফেলেছে, গ্রামাঞ্চলে এখনও সেভাবে দাগ কাটতে পারেনি। যদিও এই আন্দোলনের কথা, মানুষের মুখে মুখে ফিরছে। ফলে আমজনতার মনে আরও গভীরভাবে প্রভাব ফেলার আগেই ঘর গোছানোর কাজে নামতে চায় তৃণমূল। ২০২৬-এ বিধানসভা নির্বাচন রয়েছে। শাসক বিরোধী দলগুলির চেয়ে অনেক এগিয়ে তৃণমূল। তা সত্ত্বেও, ফুরসত নেওয়ার সময় নেই। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাতে কোনওভাবে না চলে যায়, সে কথা মাথায় রেখে পুজোর পরে বড়সড় বৈঠকে বসতে চলেছে তৃণমূল। চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে রয়েছেন অভিষেক। বাড়ির কালীপুজোয় তিনি থাকবেন, এমনটাই জানা যাচ্ছে। তারপরেই তৃণমূলের বৈঠক হবে আগামীর কথা মাথায় রেখে।

তৃণমূল সুপ্রিমো তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্যামাক স্ট্রিটের অফিসে গিয়ে বৈঠক করেন রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সি। এই প্রথম অভিষেকের অফিসে গিয়ে বৈঠক করলেন সুব্রত। সমীক্ষক সংস্থার পরামর্শ মেনে বেশ কয়েকটি পুরসভার চেয়ারম্যান এবং দলীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে রদবদল চেয়েছিলেন অভিষেক। সেই সব নিয়েই অভিষেক ও সুব্রত বক্সির বৈঠক হয়। আগামী দিনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে তৃণমূল কোন কৌশল অবলম্বন করবে, তা নিয়েই বিশদে আলোচনা হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। দল পরিচালনার ক্ষেত্রে অভিষেকের বিজ্ঞানভিত্তিক ও গাণিতিক পদ্ধতিতে যেভাবে তৃণমূলের অগ্রাধিকারের মধ্যে থাকবে, ঠিক একইভাবে দলের পুরনো একনিষ্ঠ কর্মী থেকে নেতাতে উত্তরণ সুব্রত বক্সির পরামর্শ এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা প্রবল। এর পাশাপাশি, দলের পুরনো সৈনিকদের শুধু সংবর্ধনা দিয়েই তৃণমূল থেমে থাকবে না, তাঁদেরকে দলের দায়িত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রেও যাতে প্রাধান্য দেওয়া হয়, তা নিয়েও আলোচনা শুরু হয়েছে।