উপনির্বাচনের দিন ঘোষণা হতেই টিকিট পেতে তদ্বির শুরু তৃণমূল নেতাদের

রাজ্যের ৬ বিধানসভায় উপনির্বাচন। আগামী ১৩ নভেম্বর এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। হাতে সময় খুবই কম। ইতিমধ্যে দেওয়াল লিখন শুরু হয়ে গিয়েছে বিভিন্ন এলাকায়। তবে এখনও প্রার্থীর প্রকাশ নাম করেনি শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস। ফলে এখনও সুযোগ থাকায় টিকিট পেতে তদ্বির শুরু করে দিয়েছেন দলের ছোটো, বড় ও মাঝারি মাপের নেতারা। কিন্তু কার কপালে শিকে ছিঁড়বে তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে জোর জল্পনা চলছে। বিশেষ করে এবার প্রার্থী বাছাইয়ে যথেষ্ট সতর্ক তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব।

এই মুহূর্তে টিকিট পাওয়ার দৌড়ে কেউ এগিয়ে যাচ্ছেন, তো পরমুহূর্তে দেখা যাচ্ছে, তিনি পিছিয়ে পড়ছেন। এ যেন অনেকটা সাপ-লুডোর খেলার মতো। তবুও প্রার্থী প্রত্যাশীরা চেষ্টা করে যাচ্ছেন, নিজেদের মতো করে। সেকারণে আদাজল খেয়ে রীতিমতো মাঠে নেমে গিয়েছেন তাঁরা। সামনে থেকে দেখলে বোঝার কোনও উপায় নেই। কিন্তু ভেতরে ভেতরে শুরু হয়েছে অসম প্রতিযোগিতা। এক্ষেত্রে স্নায়ুর লড়াইও কম নয়। কলকাতায় এসে সশরীরে তদ্বির করার চেয়ে মুঠোফোনেই ভরসা রাখছেন প্রার্থী হতে ইচ্ছুক তৃণমূলের নেতা নেত্রীরা। সব মিলিয়ে ফুরসত নেওয়ার সময় নেই। এখানে প্রত্যেকেই প্রত্যেকের প্রতিদ্বন্দ্বী। মমতা-অভিষেকের ঘনিষ্ঠ বৃত্তে থাকা শীর্ষ নেতাদের কাছে তদ্বির করে ফোন আসছে প্রতিনিয়ত। টিকিট প্রত্যাশীরা শীর্ষ নেতাদের বোঝাতে চাইছেন, তাঁকে প্রার্থী করা হলে দলের জয় পেতে কত সুবিধা হবে, কোন কোন ফ্যাক্টর তার হয়ে কাজ করবে, এভাবেই প্রত্যেকেই মানুষের কাছে নিজের গ্রহণযোগ্যতা তুলে ধরতে মরিয়া প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন।

তবে এক্ষেত্রে সব কিছুই নির্ভর করছে তৃণমূল সুপ্রিমো তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সাংসদ তথা দলের সর্ব ভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর। চিকিৎসার জন্য অভিষেক এখন বিদেশে রয়েছেন। যতদূর জানা গিয়েছে, এই ছয়টি কেন্দ্রে উপনির্বাচন ঘোষণা যেকোনও দিন হতে পারে, তা তৃণমূলের অজানা ছিল না। সেকারণে আগে ভাগেই প্রস্তুতি সেরে রেখেছে রাজ্যের শাসকদল।


জুনিয়র ডাক্তারদের লাগাতার আন্দোলনের ফলে কিছুটা হলেও অস্বস্তি বেড়েছে তৃণমূলের। তা সত্ত্বেও তৃণমূলের টিকিট পাওয়ার জন্য চাহিদা তুঙ্গে। শাসকদল সূত্রে জানা গিয়েছে, এক একটি বিধানসভায় প্রার্থী হওয়ার জন্য ২০ থেকে ২৫ জন দলীয় নেতা-নেত্রী তদ্বির করছেন। রাজনৈতিক মহলের একাংশের মতে, একবার তৃণমূলের টিকিট পেয়ে গেলে বিধানসভায় যাওয়ার ছাড়পত্র প্রায় পাকা। স্বাভাবিকভাবে সেই কারণেই রেষারেষি শুরু হয়েছে দলীয় নেতাদের মধ্যে।

এই ছয়টি বিধানসভার মধ্যে একমাত্র মাদারিহাট গেরুয়া শিবিরের দখলে ছিল। বাকি পাঁচটি কেন্দ্রে শাসকদল তৃণমূলই জয়লাভ করেছিল। রাজনৈতিক বিতর্ক যতই বাড়ুক, সাধারণত উপনির্বাচনের ফল শাসকদলের অনুকূলেই থাকে। সেক্ষেত্রে অনেকটাই এগিয়ে আছে তৃণমূল কংগ্রেস।

আর জি কর আবহে শহরের উপকণ্ঠে দুই বিধানসভা কেন্দ্র রয়েছে উত্তর ২৪ পরগণাতে। একটি নৈহাটি এবং অন্যটি হাড়োয়া। লোকসভা ভোটের মুখে সন্দেশখালির শেখ শাহজাহান বিতর্কের জেরে হাড়োয়ার প্রাক্তন বিধায়ক হাজী নুরুলকে বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্রে প্রার্থী করে তৃণমূল। তিনি নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হওয়ার পরে হাড়োয়া বিধানসভা কেন্দ্রটি বিধায়ক শূণ্য হয়ে যায়। এখানে দলের সাংগঠনিক শক্তি যথেষ্ট। জয়ের ব্যাপারে নিশ্চিত শাসক শিবির। গত লোকসভা ভোটে বসিরহাট কেন্দ্রে হাড়োয়া থেকেই সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়েছিলেন হাজি নুরুল। এই কেন্দ্রে ১ লক্ষ ১১ হাজার ১২১ ভোটে এগিয়ে ছিল ঘাসফুল শিবির। এরকম একটি নিশ্চিত কেন্দ্রে উপনির্বাচনের টিকিট পাওয়া নিয়ে একাধিক দলীয় নেতাদের মধ্যে তদ্বির শুরু হয়ে গিয়েছে। ইতিমধ্যে ছয়জন যোগ্য নেতার নাম চর্চায় রয়েছে। হাজি নুরুলের অনেক ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি টিকিট পাওয়ার জন্য জেলা ও রাজ্যের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন।

জল্পনা শোনা যাচ্ছে, হাজি নুরুল প্রয়াত হওয়ার পরে মানুষের মধ্যে তাঁর পরিবারের ওপর একটি ‘সিম্প্যাথি’ ফ্যাক্টর রয়েছে। সেজন্য পরিবারের কাউকে প্রার্থী করার বিষয়েও দলীয় স্তরে চর্চা হয়েছে বলে সূত্রের খবর। এই কেন্দ্রে প্রার্থী বাছাই নিয়ে দলের একটি টিম সমীক্ষা করেছে। সেই সমীক্ষা রিপোর্ট নিয়ে দলীয় স্তরে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। এসবের মধ্যে বুধবার কয়েকজন নেতা টিকিট পেতে রাজ্য নেতাদের স্মরণাপন্ন হয়েছেন। শেষ অবধি কে টিকিট পান, সেটাই এখন দেখার।

তবে বিজেপি-তে এখনও এই কেন্দ্রে তেমন কোনও উল্লেখযোগ্য মুখ সামনে আসেনি। এব্যাপারে গেরুয়া শিবির এখনই মুখ খুলতে নারাজ। তাঁরা তৃণমূলের প্রার্থীর নাম ঘোষণার পর সিদ্ধান্ত নেবেন বলে দলীয় সূত্রের খবর।

বারাকপুর কেন্দ্রে সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার পর নৈহাটি বিধানসভা কেন্দ্রে বিধায়ক পদ থেকে পদত্যাগ করেন পার্থ ভৌমিক। সেজন্য এই কেন্দ্রের উপনির্বাচনে তৃণমূলের দলীয় প্রস্তুতি তুঙ্গে। এখানে এবার পুর এলাকার ভোট ফ্যাক্টর হতে পারে বলে রাজনৈতিক মহলে একটা জল্পনা রয়েছে। আবার মেদিনীপুরে দলের প্রাক্তন বিধায়ক জুন মালিয়ার কেন্দ্রেও ভোট মার্জিন বাড়ানোর টার্গেট নিয়েছে শাসক শিবির। সেজন্য বুথ ভিত্তিক পুর উন্নয়নের তথ্য ভোটারদের সামনে তুলে ধরার পরিকল্পনা নিয়েছে দলের নেতা-কর্মীরা।

বাঁকুড়ার তালডাংরার বিধায়ক অরূপ চক্রবর্তী গত লোকসভা নির্বাচনে সাংসদ হিসেবে জয়লাভ করায় এই বিধানসভা খালি হয়। এই কেন্দ্রে প্রার্থী কে হবেন তা এখনও জানা না গেলেও জল্পনা বেড়েছে। কারণ, বৃহস্পতিবার এই কেন্দ্রের দেওয়াল লিখন শুরু হয়েছে। যদিও দলের প্রার্থীর নাম ঘোষণা না হওয়ায় সেই জায়গাটি ফাঁকা রাখা হয়েছে। রাজ্যের খাদ্য সরবরাহ দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যোৎস্না মাণ্ডি তালডাংরা বাজারে আনুষ্ঠানিকভাবে দেওয়াল লিখন শুরু করে দিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন বাঁকুড়া জেলা পরিষদের সভাধিপতি অনুসুয়া রায়। জ্যোৎস্না মান্ডি বলেন,’আমরা ৩৬৫ দিনই রেডি যে কোনও ঘোষণার জন্য। পার্টির জন্য। সে প্রার্থী যে কেউ হন।’

এদিকে চা মহল্লা অধ্যুষিত মাদারিহাট কেন্দ্র দখলে দাঁত কামড়ে পড়ে আছেন শাসকদলের নেতা কর্মীরা। তাঁরা গেরুয়া শিবিরের হাত থেকে এই আসনটি ছিনিয়ে নিতে বদ্ধ পরিকর। সেজন্য কমপক্ষে ৫১ শতাংশ ভোট পেতে মরিয়া তৃণমূল শিবির। ইতিমধ্যে বুথের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের থেকে রিপোর্ট সংগ্রহ করেছে শীর্ষ নেতৃত্ব। সেই অনুযায়ী, রণকৌশল সাজানো হচ্ছে। যদিও মাদারিহাট কেন্দ্রে মনোজ টিগ্গা একজন জনপ্রিয় নেতা। এখানে বিজেপির যথেষ্ট সাংগঠনিক দক্ষতাও রয়েছে।

অন্যদিকে সিতাই কেন্দ্রের তৃণমূল বিধায়ক ছিলেন জগদীপ বসুনিয়া। গত লোকসভা নির্বাচনে কোচবিহারে বিজেপি-র নিশীথ প্রামাণিককে হারিয়ে সাংসদ হয়েছেন জগদীপ বসুনিয়া। ফলে এই কেন্দ্রেও উপনির্বাচন রয়েছে। বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষা এই কেন্দ্রে জগদীপ বসুনিয়া একটি সুপরিচিত নাম। এখানে তাঁর যথেষ্ট সাংগঠনিক শক্তি রয়েছে। দলের সাংসদ হলেও দলের নিয়ন্ত্রণ তাঁর হাতেই রয়েছে। তিনিই এখানে উপনির্বাচনে ভোটের রণকৌশল সাজাচ্ছেন।