• facebook
  • twitter
Friday, 22 November, 2024

আজ বিশ্ব কবিতা দিবস

প্রদীপ কুমার চৌধুরী ইউনেস্কো, ইতিমধ্যে বছরে ৩৬৫ দিনের অধিকাংশই কোনও না কোনও দিবস হিসেবে ধার্য করেছে৷ যেমন— বিশ্ব খাদ্য দিবস, বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস, বিশ্ব প্রবীণ নাগরিক দিবস, বিশ্ব নারী দিবস ইত্যাদি৷ কিন্ত্ত ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত কবিতার জন্য কোনও নির্দিষ্ট দিবস ধার্য ছিল না৷ এই কবিতা দিবস ধার্য না হওয়া নিয়েই ছিল আমাদের (আমরা যারা কবিতা

প্রদীপ কুমার চৌধুরী

ইউনেস্কো, ইতিমধ্যে বছরে ৩৬৫ দিনের অধিকাংশই কোনও না কোনও দিবস হিসেবে ধার্য করেছে৷ যেমন— বিশ্ব খাদ্য দিবস, বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস, বিশ্ব প্রবীণ নাগরিক দিবস, বিশ্ব নারী দিবস ইত্যাদি৷ কিন্ত্ত ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত কবিতার জন্য কোনও নির্দিষ্ট দিবস ধার্য ছিল না৷

এই কবিতা দিবস ধার্য না হওয়া নিয়েই ছিল আমাদের (আমরা যারা কবিতা লিখি, কবিতা ভালোবাসি, কবিতা চর্চা করি…) ক্ষোভ, আপত্তি এবং কবিতা দিবস ধার্য করার আন্দোলন৷ আনুমানিক ১৯৮৫-৮৬ সালে কবিতাপ্রেমী একঝাঁক কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে আলোচনায় উঠে আসত— ‘কবিতার জন্য কোনও দিবস ধার্য নেই কেন?’ কবিতার প্রতি এই তাচ্ছিল্য, একজন কবিতাপ্রেমী হিসেবে আমাকে তো পলে পলে বিদ্ধ করত৷ আমি প্রশ্ন করেছিলাম, সুনীলদা (সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়)সহ অনেক অগ্রজ কবি-সাহিত্যিককে৷

সুনীলদাও এক কথায় স্বীকার করেছিলেন যে, ইউনেস্কোরও উচিত কবিতার জন্য একটি দিবস ধার্য করা৷
প্রশ্ন হল, এই কঠিন কাজটি কীভাবে হবে? বেশ কয়েক বছর অতিবাহিত হওয়ার পরেও এই ব্যাপারে তেমন কোনও উদ্যোগ চোখে পড়েনি৷ ইতিমধ্যে উচ্চশিক্ষা ও কর্মসূত্রে অনেকবার আমাকে জাপান, আমেরিকা ও ইউরোপ যেতে হয়েছিল৷ সেখানে কাজের ফাঁকে বিদেশি কবিবন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ হতে থাকল এবং কবিতা দিবসের ব্যাপারে খোঁজ নিতে শুরু করলাম৷ উল্লেখ করা যেতে পারে, সেই সময় বিদেশের বহু নামি সাহিত্য পত্রিকায় আমার ইংরেজি কবিতা প্রকাশিত হচ্ছিল ধারাবাহিকভাবে৷ ইউনেস্কোর সদর দফতর থেকে জানতে পারলাম, সেখানে ব্যক্তিগতভাবে কোনও আবেদন বা প্রতিবাদপত্র গ্রাহ্য হয় না৷ এরজন্য প্রয়োজন ফেডারেশন অফ ইন্টারন্যাশনাল পোয়েট্রি অ্যাসোসিয়েশন (ফোইপা)-এর মাধ্যম৷ সুতরাং যেতে হল, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা রাজ্যে অবস্থিত ফোইপার প্রধান কার্যালয়ে৷ এখানে পেঁৗছে আরও অনেক অজানা তথ্যের সন্ধান পেলাম৷ কোনও দেশের কবি-সাহিত্যিককে ব্যক্তিগতভাবে ফোইপার সদস্যপদ দেওয়া হয় না৷ একমাত্র সে দেশের সরকারি রেজিস্ট্রিকৃত সংস্থাকেই ফোইপার সদস্যপদ দেওয়া যেতে পারে যদি সেই সংস্থা ফোইপার শর্তাবলী পূরণ করে আবেদন করে৷

প্রায় দশ বছর অতিক্রান্ত৷ ১৯৯৬ সালে পোয়েটস ফাউন্ডেশন গঠিত হল৷ ১৯৯৭ সালে আন্তর্জাতিক শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি-সমাজসেবা সংস্থা পোয়েটস ফাউন্ডেশনের কর্ণধার হিসেবে ফোইপার সদস্যপদ পেয়ে জানতে পারলাম, ফোইপার গভর্নিং বডির সদস্য নির্বাচিত না হতে পারলে ইউনেস্কোতে ভারতবর্ষের প্রতিনিধিত্ব করার জায়গায় পেঁৗছতে পারব না৷ সেই সময় সারা পৃথিবীতে ইউনেস্কোর সদস্য দেশের সংখ্যা ছিল ১৯৮টি৷ ভারতবর্ষের মতো তৃতীয় বিশ্বের কোনও দেশের এই নির্বাচনে অংশ নেওয়া একটা বড় চ্যালেঞ্জ বা এরকম দুঃসাধ্য ব্যাপার ছিল৷ নির্বাচনে জয়লাভ প্রায় অসম্ভব জেনেও বিভিন্নভাবে চেষ্টা করতে লাগলাম৷ তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যথা আফ্রিকার দেশসমূহ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু দেশ, লাতিন আমেরিকার কিছু দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করলাম, কবিতাসূত্রে যাঁদের সঙ্গে পূর্ব পরিচয় ছিল৷ সেবার আমাকে প্রায় একমাস আমেরিকার শিকাগো এবং নিউজার্সি-নিউইয়র্কে থাকতে হয়েছিল৷ ‘শেষ দেখে ছাড়ব’— এই প্রতিজ্ঞা নিয়ে নির্বাচনের প্রস্ত্ততিপর্ব পর্যন্ত দেখে এসেছিলাম৷ হার মেনে নেব বলে মনে মনে তৈরিও ছিলাম৷ কিন্ত্ত নির্বাচনের ফলাফল সব হিসেবে উল্টে দিল৷ অপ্রত্যাশিত জয়ের স্বাদ পেলাম৷ ভারতবর্ষ থেকে একমাত্র প্রতিনিধি পোয়েটস ফাউন্ডেশনের কর্ণধার হিসেবে প্রদীপ কুমার চক্রবর্তী ফোইপার গভর্নিং বডিতে সদস্যপদে ছয় বছরের জন্য নির্বাচিত হল৷ সে এক অনাবিল আনন্দ৷ গভর্নিং বডির ছয় সদস্য দেশগুলি ছিল— ইউএসএ, ইউকে, ফ্রান্স, রাশিয়া, বেলজিয়াম ও ভারতবর্ষ৷

তারপর ফেইপার গভর্নিং বডির সদস্য দেশগুলোর প্রতিনিধি হিসেবে একযোগে ইউনেস্কোতে আবেদন ও দরবার৷ ফলস্বরূপ ইউনেস্কোর ২০০০ সাল থেকে প্রতিবছর ২১ মার্চ ‘বিশ্ব কবিতা দিবস’ ঘোষণা৷ সেই সংবাদের বিস্তৃত বিবরণ আমাদের হাতে আসে ২০০০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে৷ সঙ্গে সঙ্গে আমি সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে কলকাতার সমস্ত প্রথম শ্রেণির দৈনিক সংবাদপত্র ও সংবাদমাধ্যমগুলোকে এই বিশেষ খবরটি জানাই৷ এই খবর কলকাতার বেশ কয়েকটি প্রথম শ্রেণির দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিতও হয়েছিল৷

সেই থেকে আজ পর্যন্ত ভারতবর্ষ ও উপমহাদেশে ‘বিশ্ব কবিতা দিবস’ উদযাপনের প্রথম এবং পথ প্রদর্শক সংস্থা হিসেবে পোয়েটস ফাউন্ডেশন অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করে আসছে৷ ২০০০ সালের ২১ মার্চ ভারতবর্ষে প্রথম ‘বিশ্ব কবিতা দিবস’ উদযাপন হয়েছিল কলকাতার পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির সভাগৃহে পোয়েটস ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে৷ সেদিনের অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় শিক্ষা ও সংস্কৃতি দফতরের মন্ত্রী ড. প্রতাপচন্দ্র চন্দ্র, রাজ্যের দমকল মন্ত্রী প্রতীম চট্টোপাধ্যায়, কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, ড. পবিত্র সরকার, কবি-সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ৷ সেদিনের অনুষ্ঠান কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিকসহ বহু দর্শকের উপচে পড়া সমাগমে পরিপূর্ণতা লাভ করেছিল৷

ইউনেস্কো তাদের বার্তায় জানিয়েছিল, ২১ মার্চ ‘বিশ্ব কবিতা দিবস’ এবং একই সঙ্গে ‘জাতিবৈষম্য দূরীকরণ দিবস’ও৷ তাই একই দিনে দুটি বিষয়ে যৌথ উদযাপন একটি গুরুত্বপূর্ণ মাত্রা যোগ করেছে সারা পৃথিবীতে৷ এতে কবিদের কবিতা, কাব্যরসিক ও পদ্য আন্দোলন যে শুধু জনপ্রিয় হচ্ছে তাই নয়, রীতিমতো সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে৷ ইউনেস্কো প্রত্যেক সদস্য দেশকে ‘বিশ্ব কবিতা দিবস’ নিজস্ব প্রথায় পালনের অনুরোধ জানিয়েছে৷ এই ব্যাপারে ভারতবর্ষ ও উপমহাদেশে ‘বিশ্ব কবিতা দিবস’ উদযাপনের প্রথম সংস্থা হিসেবে পোয়েটস ফাউন্ডেশনও সবাইকে (বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পৌর প্রতিষ্ঠান, সাহিত্য, সমাজসেবা সংস্থা ইত্যাদি) প্রতি বছর ২১ মার্চ ‘বিশ্ব কবিতা দিবস’ পালনের আহ্বান জানাচ্ছে৷ এই প্রসঙ্গে জানাই, ইউনেস্কোর বার্তাকে গুরুত্ব দিয়ে ২০০১ সাল থেকে দেশ-বিদেশে অবস্থিত পোয়েটস ফাউন্ডেশনের শিকাগো, ঢাকা, জম্মু, লন্ডন, গ্যাংটক, দিল্লি প্রভৃতি কেন্দ্রে ২১ মার্চ ‘বিশ্ব কবিতা দিবস’ উদযাপনে অংশগ্রহণ করে কবিতা আন্দোলনকে আরও এগিয়ে নেবার চেষ্টা করে যাচ্ছি৷

এই তাৎপর্যপূর্ণ দিনটি আমরা কবিতা পাঠ, কবিতার আবৃত্তি, কবিতার গান, কবিতার বই প্রকাশ, আলোচনা ইত্যাদির মাধ্যমে সমাজে কবিতার সুনির্দিষ্ট অবস্থানটি নিশ্চিত করতে চাই৷

আজ সারা বিশ্বের বহু দেশে দেশে যুদ্ধ৷ সেই দেশগুলো মারামারি, কাটাকাটি, হানাহানিতে জর্জরিত৷ যুদ্ধ যেন লেগেই আছে৷ দু’বছর অতিক্রান্ত, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এখনও চলছে৷ নতুন করে প্যালেস্তাইন-ইজরায়েল যুদ্ধ লেগেছে৷ থামবার কোনও লক্ষণ নেই৷ তাই এই পৃথিবীতে একমাত্র কবিতাই বিশ্বশান্তি ফিরিয়ে আনতে সহায়ক হবে বলে মনে করি৷ এটাই আমার দৃঢ় বিশ্বাস৷ কবিতার জয় হোক৷