তিনি আপামর বাঙালির ‘নিভৃত প্রাণের দেবতা’ ঠিকই। কিন্তু প্রতিবার পঁচিশে বৈশাখে তাঁকে ঘিরে উৎসব রচনা করে বাঙালি। কিন্তু এমন নিভৃতবাসের পঁচিশে বৈশাখ কে কবে দেখেছে! যদিও এমন একটা ইঙ্গিত বোধহয় তিনি দিয়ে গিয়েছিলেন তার একটি গানে– উৎসবে তাঁর আসে নাই কেহ, / বাজে নাই বাঁশি, সাজে নাই গেহ…’ সত্যিই এবার সেজে ওঠেনি এবার কবিগুরুর সেই ঐতিহ্যময় বাড়ি জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি।
প্রতিবার পঁচিশে বৈশাখে যে জোড়াসাঁকো হয়ে ওঠে আপামর বাঙালির তীর্থভূমি। ফুলে, আলপনায় সেজে ওঠে তার বীন্দ্রনাথের শেষ শয়ানের ঘর। ঠাকুরবাড়ির মধ্যে রবীন্দ্রনাথের আঁতুড়ঘরটি দেখার জন্য লম্বা লাইন পড়ে। মুক্তমঞ্চে ধ্বনিল আহ্বান মধুর গম্ভীর প্রভাত অম্বর মাঝে, দিকে দিগন্তরে ভুকন মন্দিরে শান্তি সঙ্গীত বাজে। কিন্তু সেই আহ্বান এবার ধ্বনিল বই।
যে পঁচিশে বৈশাখে গল্পে, গানে, ছন্দে, সুরে, বাচিকে, সংলাপে নৃতন করে আবার দেখা দেয় বিশ্বকবি জন্মের প্রথম শুভক্ষণ। এবার সেই জোড়াসাঁকো একেবারে নিস্তব্ধ। নেই কবিপ্রণামের জন্য ভিড়ের ঠেলাঠেলি বুড়ো আমগাছটার তলায় বেলফুলের স্তুপে ঢাকা রবীন্দ্রনাথের আবক্ষ মূর্তিটাকে ছোঁয়ার জন্য হুড়োহুড়ি।
মুক্ত মঞ্চে একের পর এক গান কবিতা শোনার জন্য রবীন্দ্রভক্তদের ঘেঁষাঘেঁষি ভিড়। করোনা জন্য মানুষকে এখন বাধ্যতামূলক সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং মানতে হচ্ছে। থাকতে হচ্ছে গৃহবন্দি। তাই এবার পঁচিশে বৈশাখে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি হয়ে উঠেছে শুন্য মন্দির মোর। কনটেইনমেন্ট জোনের আওতায় থাকা এই জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে রবিঠাকুর জেগে রইলেন একা।
শুধু জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি কেন, এবার সরকারি উদ্যোগে রবীন্দ্রসদনের পাশের কবিপ্রণামের অনুষ্ঠানেও ছন্দপতন। শুধুমাত্র নিয়মরক্ষার জন্য একটি ছোট্ট মঞ্চ করা হয়েছে। যেখানে বরীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতিতে বিকেল চারটের সময় পুস্পার্ঘ্য দেবেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একটা জায়ান্ট স্ক্রিনে পুরনো বছরে কবিপ্রণামের অনুষ্ঠানের নির্বাচিত ভিডিও দেখানো হবে। দর্শক কিংবা শ্রোতা কেউই থাকবে না। তবে কি এসবের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ কেবলই ছবি হয়ে থাকবেন? কিন্তু তিনি যে নও ছবি, নও ছবি নও শুধু ছবি।
তাই তাকে নিয়ে এবার গৃহবন্দি মানুষ উৎসব রচনা করবে নিজের ঘরে নিভৃতবাসে। পঁচিশে বৈশাখে বীন্দ্রস্মরণ এবার অনলাইনে গান, কবিতা, নাচ, সিনেমা, এমনকী ফেসবুকের স্টেটাসেও এবার বীন্দ্রনাথ থাকবেন তার সৃষ্টির মাঝে আকীর্ণ হয়ে। পচিশে বৈশাখের যাবতীয় আয়োজন এবার ফেসবুক কিংবা ইউ টিউবের মাধ্যমে পৌছে যাবে অগুণতি মানুষের কাছে। মুঠোফোনে কিংবা কম্পিউটার স্ক্রিনে।
তার জন্য প্রস্তুতি চলেছে বহুদিন ধরে। প্রথিতযশা শিল্পীদের সঙ্গে উদীয়মান শিল্পী সকলেই এবার গৃহবন্দি থেকেই রবীন্দ্রস্মরণ করছেন অনলাইনে। শিল্পী জয়তী চক্রবর্তীর প্রথম ডিজিটাল কনসার্ট ‘ইটস শোটাইম’ ব্যানারে হচ্ছে। যেখানে যোগ দিতে হবে পেটিএম-এর মাধ্যমে। অসীমকলসাগরে শিরোনামে অনুষ্ঠানে থাকবে রবীন্দ্রনাথের পূজা পর্যায়ের গান দিয়ে। জানালেন এই অসময়ে নীরবে একান্তে আছেন যিনি, তাঁকে এভাবেই অর্ঘ্য দেওয়া যায়।
শ্রীকান্ত আচার্যের সঙ্গে জুটি বেঁধে জয়তী চক্ৰবৰ্তী থাকবেন আগামী ১৬ মে, আরও একটি অনুষ্ঠানে। সকল রসের ধারা শিরোনামে সেই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে হবে আইএনআর-এর মাধ্যমে। শ্রীকান্ত আচার্য জানালেন এই অনুষ্ঠানের প্রবেশ মূল্য তাদের সহায়তায় দেওয়া হবে, যে সমস্ত সহযোগী শিল্পীরা এই লকডাউনে সমস্ত অনুষ্ঠান বাতিল হওয়ায় অর্থকষ্টে রয়েছেন।
শিল্পী প্রমিতা মল্লিকও এবারের পঁচিশে বৈশাখ পালন করবেন অনলাইনে, তার ছাত্রীদের সঙ্গে। বাচিক শিল্পী সুতপা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফানকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট নামে সংস্থাও আবৃত্তির অনলাইন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এবার পঁচিশে বৈশাখে কবিপ্রণামের আয়োজন করেছে।
পঁচিশে বৈশাখ উপলক্ষে পার্থ ডি মিত্রের তৈরি সিনেমা টেগোরস লাভও আজ ইউটিউবে মুক্তি পাচ্ছে। ইতিমধ্যেই তা আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সমাদৃত হয়েছে। ব্রহ্মকমল, কারিগর এমন অনেক সংস্থাই এবার পঁচিশে বৈশাখ উদযাপন করছে ভার্চুয়াল মিডিয়ায়।
যেখানে দর্শক শ্রোতাদের হয়তো সামনে থেকে প্রত্যক্ষ করা যাবে না। কিন্তু দেখা যাবে না চোখের আলোয়। কিন্তু তাতে কি? তিনি নিজেই তো লিখে গিয়েছিলেন চোখের বাহিরে যদি নাই বা দেখা যায়, অন্তরে আজ দেখব যখন আলোক নাহিরে। সেই আলোতে যে চিরদিন জ্বলে রইবেন রবিঠাকুর। করোনার সাধ্য কি অন্তরের সেই আলো নিভিয়ে দেয়? আমাদের অন্তরের সেই নিভৃতবাসেই জেগে থাকবেন রবীন্দ্রনাথ। আমাদের সকলের নিভৃত প্রাণের দেবতা।