বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ছটা নাগাদ সুন্দরবনে আছড়ে পড়ল আম্ফান। দিল্লির মৌসম ভবন এমনটাই জানিয়েছে। সেই সময় ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৫৫-১৬৫ কিলোমিটার। তবে সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৮৫ কিলোমিটার। সন্ধ্যা ৭:২০ মিনিটে কলকাতায় সেই ঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় প্রায় ১৩৩ কিলোমিটার।
এদিকে আম্ফানের জেরে রাজ্যের বিস্তীর্ণ এলাকা লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। কলকাতার পাশাপাশি দুই মেদিনীপুর এবং দুই চব্বিশ পরগনা, হাওড়া, হুগলির অবস্থা যথেষ্টই ভয়াবহ। বিভিন্ন জেলা থেকে হাজার হাজার কাঁচা বাড়ি ভেঙে পড়ার খবর পাওয়া গিয়েছে। গাছপালা ভেঙেছে যত্রতত্র। বহুতল বাড়ির কাচও ভেঙেছে। উপড়ে গিয়েছে বিদ্যুতের খুঁটি। রাস্তায় গাছ পড়ে যাওয়ায় যান চলাচল বন্ধ।
যদিও এদিন সিংহভাগ মানুষই ছিলেন ঘরবন্দি। জরুরি পরিষেবা দিতে যাঁদের বাড়ি থেকে বেরোতে হয়েছে তাদের অধিকাংশকেই রাত কাটাতে হয়েছে অফিসে। আম্ফানের প্রভাবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ যে বহুগুণে বাড়বে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বুধবার রাত্রি আটটা পর্যন্ত তিনজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে।
এদিন দুপুর আড়াইটে নাগাদ ঘূর্ণিঝড়টি স্থলভূমিকে ঢোকে। তারপর সন্ধে সাড়ে ছটা নাগাদ দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সুন্দরবন উপকূলে আছড়ে পড়ে। কেন্দ্রীয় আবহাওয়া দফতরের ডিরেক্টর মৃত্যুঞ্জয় মহাপাত্র জানান, বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ আম্ফান ঢুকে পড়ে স্থলভাগে। আর সাড়ে ছটার মধ্যে সুন্দরবন এলাকায়।
মিনাখাঁ, হিঙ্গলগঞ্জ, সন্দেশখালি, হাসনাবাদ, হাভোয়াসহ উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার বিভিন্ন এলাকায় কমপক্ষে সাড়ে পাঁচ হাজার মাটির বাড়ি ভেঙেছে বলে এই জেলার জেলাশাসক জানিয়েছেন। সুন্দরবনের বিভিন্ন জায়গায় নদীর জল বাঁধ ভেঙে গ্রামে ঢুকে গিয়েছে।
তিনজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে। বাড়ির উঠোনে গাছ ভেঙে বসিরহাটে মহন্ত দাস নামে বছর কুড়ির এক তরুণের মৃত্যু হয়েছে। অন্য দিকে মৃত্যু হয় হাওড়ার এক কিশোরী ও মিনাখাঁর এক প্রৌঢ়ার।
প্রবল ঝড়বৃষ্টিতে হাওড়ার শালিমারে ঝড়ে উড়ে যাওয়া টিনের আঘাতে ১৩ বছরের কিশোরী লক্ষ্মীকুমারী সাউয়ের মৃত্যু হয়। শালিমার এলাকার রাজকিশোর চৌধুরী লেনের বাসিন্দা ছিল সে।
এদিকে মিনাখার ছাপান্ন বছরের এক প্রৌঢ়া নুরজাহান বেওয়া ঝড়ে প্রাণ হারিয়েছেন বলে জানা গিয়েছে। বসিরহাট মহকুমার মিনাখাঁ থানার দক্ষিণ বার্গায় নারকেল গাছ পড়ে নুরজাহান বেওয়ার মাথায়। বাড়ি থেকে বেরনোর সময় গাছ ভেঙে পড়ে তার মাথায়। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।
পাশাপাশি হাড়োয়ায় গাছ পড়ে আরও দু’জনের আহত হওয়ার খবর মিলেছে। বর্তমানে তারা হাড়োয়া গ্রামীণ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। রাজ্য সরকারের তরফে দুটি মৃত্যুর ঘটনা নিশ্চিত করা হয়েছে। বিপজ্জনক এলাকা থেকে বহু বাসিন্দাকে নিরাপদে সরানো হয়েছে অন্যত্র। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে কন্ট্রোল রুমে থেকে গোটা রাজ্যের পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছেন।
দিঘাতে প্রবল জলোচ্ছ্বাস এবং সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া বইছে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার জন্য মঙ্গলবার সেচ দফতরের বাংলোতে ঘাঁটি গেড়েছেন সেচমন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী। প্রতি মুহূর্তে তিনি আপডেট নিচ্ছেন এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিচ্ছেন আধিকারিকদের।
এদিকে রাজ্যের সেচ ও পরিবহণমন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী দিঘায় সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে জানান, ‘এখনও পর্যন্ত ফণীর চেয়ে দশগুণ ক্ষতি করেছে আস্ফান। নন্দীগ্রামে বেশিরভাগ কাঁচাবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক জায়গায় বাঁধ ভেঙে গিয়েছে। মোবাইল বন্ধ রয়েছে। সেকারণে এখনই আনুমানিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বলা সম্ভব নয়। কিছুটা সময় লাগবে।’
এদিকে আজ বিকেল পাঁচটায় বুড়িগঙ্গার ওপর কচুবেড়িয়ায় জেটি ভাঙার খবর পাওয়া গিয়েছে। সেইসঙ্গে পাথরপ্রতিমায় বেশ কিছু গাছও ভেঙেছে। কলকাতার সাতাশটি জায়গায় রাস্তার ওপর থেকে গাছ সরানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
আম্ফানের প্রভাবে দুই মেদিনীপুর এবং দুই চব্বিশ পরগনার একাধিক জায়গা থেকে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির খবর এসেছে। ঘরবাড়ি ভেঙে পড়ার পাশাপাশি উড়ে গিয়েছে খড়ের চাল। উপকূল এলাকায় সমুদ্রে জলোচ্ছ্বাস ছিল চোখে পড়ার মতো। বিকেলের পর সেই দাপট আরও বেড়েছে।
দিঘার পাশাপাশি তাজপুর, মন্দারমণি, রামনগর, খেজুরিতে আম্ফানের প্রভাবে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বেশ কয়েক জায়গায় বাঁধ ভেঙে সমুদ্রের জল ঢুকে যায। এগরায় কাঁচা বাড়ি ভেঙে পড়ায় সেখানকার বাসিন্দাদের অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার পাথরপ্রতিমার অবস্থাও ভয়াবহ।
অনেক বাড়ি সেখানে ভেঙে পড়ায় আশ্রয়হীন হয়েছে বহু মানুষ। ভয়ঙ্কর ঝড়, সঙ্গে প্রবল বৃষ্টিতে মাটির বাড়িতে থাকা গ্রামবাংলার হাজার হাজার মানুষজন আতঙ্কে ভুগতে শুরু করেন বিকেল থেকেই। ভগবানই ভরসা। এর ওপরেই আশ্রয় করে পরিবার পরিজন নিয়ে ঘরবন্দি থেকেছেন তারা। অপেক্ষায় রয়েছেন ঝড় এবং বৃষ্টি থামার।