নারায়ণ দাস
ব্যালট পেপারের পরিবর্তে ইভিএম-এর সাহায্যে ভোটগ্রহণ প্রথা চালু হওয়ার পর থেকেই বিরোধীরা তার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে চলেছেন। অর্থাৎ ইভিএম এখনও বিরোধীদের মন জয় করতে পারল না। ভোটে হেরে গেলেই যে অভিযোগটা প্রথমেই বিরোধীরা তোলেন, তা হল ইভিএমের সাহায্যে শাসক দলের কারচুপি। আর তাই তাদের প্রার্থীদের পরজিয়। বিরোধীদের আরও অভিযোগ, জাতীয় নির্বাচনে কমিশন নিরপেক্ষ ও স্বাধীনভাবে নির্বাচন পরিচালনা করতে পারবে না। কেন্দ্রীয় সরকারের এ ব্যাপারে ভূমিকা নিয়েও তাঁরা সরব হন। তাছাড়া শাসক দলের প্রার্থীদের বাড়তি সুযোগ দেওয়ার অভিযোগ তো কমিশনের বিরুদ্ধে রয়েছে। তাই বিরোধীদের সোজাসুজি প্রশ্ন, নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করার বাধা আসে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে। তাই কমিশন একটি স্বাধীন সংস্থা বলে দাবি করলেও, সে যে স্বাধীন তা এখনও পর্যন্ত প্রমাণ করতে পারেনি। এর বাইরে ভোটার তালিকা ত্রুটিমুক্ত করার ব্যাপারেও কমিশন ব্যর্থ। অনেক ভুয়ো ভোটারের নাম ভোটার তালিকায় থাকে তাদের ভোট কিছুতেই বৈধ বলে বিবেচিত হতে পারে না। গত কয়েক বছরে ইভিএমের সাহায্যে দেশে যতগুলি নির্বাচন হয়েছে, কমিশন তা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে পরিচালনা করেছে— এই প্রশংসা কমিশনের কপালে জোটেনি। বিরোধীদের প্রার্থীরা হেরে গেলেই নির্বাচন কমিশনকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো এবং ইভিএমের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে আসছে। বিরোধীরা যদি ইভিএমের সাহায্যে ভোট নিয়ে স্বচ্ছতার প্রশ্ন তুলতেই থাকেন, তাহলে আর কী ব্যবস্থায় ভোট হতে পারে? লোকসভার নির্বাচনই হোক অথবা রাজ্যগুলির বিধানসভা নির্বাচনই হোক, নির্বাচন কমিশনের ঘাড়ে দোষ চাপানো তাদের প্রার্থীদের পরাজয়ের জন্য বিরোধীদের একটি অভ্যেসে পরিণত হয়ে গেছে। অতীতে ব্যালট পেপারের সাহায্যে ভোট হত, তা নিয়েও অনেক অভিযোগ ছিল। ভোটের গণনা ঠিকমতো হয় না বলে অভিযোগ আসত বিরোধীদের পক্ষ থেকে। তবুও এখনও অনেক নেতা আছেন, যাঁরা আবার ব্যালট পেপারে ভোটের প্রথা ফিরিয়ে আনার দাবি জানান ভোটে হারার পর। কারণ তাঁরা কিছুতেই ইভিএমের স্বচ্ছতা থেকে নিতে নিতে পারেন না।
এই অবস্থায় নির্বাচন কমিশনেরই বা করার কী আছে? কী করে কমিশন বিরোধীদের মন জয় করতে পারে? প্রশ্ন বড় কঠিন— উত্তর দেওয়াও সোজা নয়। কারণ ইভিএম যে সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত এবং স্বচ্ছতা সহকারে ভোটগ্রহণ হতে পারে, তা বোঝাতে পারে না কমিশন। তবে বিরোধীরা যতই অভিযোগ আনুক, নির্বাচন কমিশন পুরো স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে ভোট পরিচালনা করে এই দাবি সম্প্রতি করলেন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব কুমার। ইভিএমের স্বচ্ছতা নিয়ে যত অভিযোগই বিরোধীরা করুন, তা তিনি নাকচ করে দিয়ে বললেন, ইভিএমের সাহায্যে ভোট ত্রুটিমুক্ত ভাবেই হয়। এই মেশিনকে এ কারণে দোষ দেন বিরোধীরা ভোটে তাঁদের প্রার্থীদের হারার পর। তিনি বিরোধীদের সব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে দাবি করলেন, নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন সংস্থা, যা নিরপেক্ষভাবে ভোট পরিচালনা করে। প্রশ্ন ওঠে, তাহলে বিরোধীদের সব অভিযোগই কি মিথ্যে? এই প্রশ্নে রাজীব কুমার বলেন, নানাভাবে প্রমাণ দেওয়া হয়েছে ইভিএমের সাহায্যে ভোট ত্রুটিমুক্ত হয় এবং কমিশনের বিরুদ্ধে ভূরি ভূরি অভিযোগ ধোপে টেকে না। বিশেষজ্ঞদের দিয়ে ইভিএমের পরীক্ষা নানাভাবে হয়েছে এবং এই পরীক্ষা হয়েছে বিরোধী দলগুলির প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে। তাঁরা কোনও ত্রুটি বের করতে পারেননি। কিন্তু ভোটে হারলেই ইভিএমকে দোষী করা হবে অনিার্যভাবে। বিরোধীদের একটাই অস্ত্র।
পাঁচ বছর আগে ২০২০ সালে বিহার বিধানসভা নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে তিন সদস্যের প্যানেলে যোগ দেন রাজীব কুমার। ২০২২ সালে তিনি মুখ্য নির্বাচন কমিশনার হন। আসন্ন দিল্লির বিধানসভা নির্বাচন পরিচালনা করে রাজীব কুমার তাঁর শেষ কর্তব্য পালন করবেন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার হিসেবে। মোট ৩১টি নির্বাচন পরিচালনা করেছেন তিনি— যার মধ্যে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর নির্বাচনও রয়েছে। পরিচালনা করেছেন গত বছরের লোকসভা নির্বাচনও। এতগুলি নির্বাচন পরিচালনার পর তাঁর বিরুদ্ধে তথা নির্বাচন কমিশনের নিয়োগে বিরোধীদের আনা অসংখ্য অভিযোগ এসেছে তাঁকে ঘিরে। তার মধ্যে সবচাইতে বড় অভিযোগ ইভিএমকে নিয়ে। রাজীব কুমার সম্প্রতি এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন, অজস্রবার তিনি বিরোধীদের বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে ইভিএমের ভোট সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত। কিন্তু বিরোধীরা তাঁর সামনে তা কিছুটা মেনে নিলেও, নির্বাচনে প্রার্থীদের পরাজয়ের পর আবার ইভিএমকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে। তাঁরা বার বার একই প্রশ্ন তুলেছেন ইভিএমে কারচুপি করা সম্ভব। কিন্তু তাঁদের বোঝানোর চেষ্টা বহুবার করেছেন যে ইভিএমে ভোট একটি নিখুঁত ব্যবস্থা। এর স্বচ্ছতা নিয়ে কোনও প্রশ্ন ওঠে না। তবুও বিরোধীরা হারলেই ইভিএমের জন্য এই হার— তা নিয়ে শোরগোল তোলেন।
বড় অভিযোগ শাসকদল বিজেপি কারচুপি করেই লোকসভার ভোটে জিতে দিল্লির মসনদ ধরে রেখেছে। রাজীব কুমার বলেন, এই অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যে। ইভিএমে ভোটগ্রহণ একটি নিখুঁত ব্যবস্থা। তাঁর দাবি, ২০১৯ সালে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ইভিএমের পড়া ভোটের সঙ্গে ভিভিপ্যাড যন্ত্রের কাগজ গোনা শুরু হয়। প্রায় ৪.৫ কোটি ভিভিপ্যাড স্লিপ খোলানো হয়েছে। কিন্তু একটিও গরমিল পাওয়া যায়নি। রাজীব কুমারের আরও দাবি, কোনও যন্ত্রের মাধ্যমে ইভিএম হ্যাকিং করা যায় না। তিনি নিজেকে স্বচ্ছ বলে দাবি করলেও, কংগ্রেসের এক শীর্ষ নেতা অভিযোগ এনেছেন গত লোকসভা নির্বাচনে কমিশন শাসক দলের প্রতি পক্ষপাত দেখিয়েছে, তা অতীতে দেখা কমিশনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। রাজুব কুমার কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে যতই ঢাক বাজান, কেন্দ্রের শাসক দল নানাভাবে কমিশনের কাজকে প্রভাবিত করে।
রাজীব কুমার নির্বাচন কমিশনের গুণগান গাইলেও, বিরোধীদের অভিযোগ একাধিক রাজ্যের বিধানসভা ভোটার তালিকার সংশোধন ঠিকমতো হয়নি। নানা গলদ ধরা পড়েছে। কমিশন এই অভিযোগ উড়িয়ে দিতে পারে না। ’আপ’-এর একজন নেতা জানালেন, আসন্ন দিল্লির ভোটার তালিকায় বিজেপি বেছে বেছে আম আদমি পার্টির সমর্থকদের নাম বাদ দিয়েছে। কিন্তু ইভিএমের মতো ভোটার তালিকা ত্রুটিতে ভরা এই অভিযোগও উয়ে দিয়েছেন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার। তিনি বলেন, বাড়ি বাড়ি গিয়ে খতিয়ে দেখেই কারও নাম বাদ দেওয়া হয়। কারও নাম যদি বাদও পরে, সেই ব্যক্তির পক্ষে সুযোগ থাকে নিজের বক্তব্য পেশ করার। রাজীব কুমার বলেন, ভোটার তালিকা প্রস্তুতির কাজে রাজনৈতিক দলগুলি সক্রিয় ভাবে জড়িয়ে থাকে। কোনও রকম অস্বচ্ছতা থাকলে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলই তা তুলে ধরে। তখন বিষয়টি খতিয়ে দেখা হয়।
নির্বাচন কমিশনের দাবি, ইভিএমের মেশিনগুলি ভালো করে পরীক্ষা করা হয় ভোটের আগে। কোনও ত্রুটি ধরা পড়লে তা সঙ্গে সঙ্গে সংশোধন করা হয়ে থাকে। তাই ইভিএমের দোষ ধরা অনর্থক। তবে ভাট চলাকালীন কোনও কোনও বুথে ইভিএম মেশিন খারাপ হয় এবং ভোটারদের ভোট দিতে বিলম্ব ঘটে। যদিও ত্রুটিপূর্ণ মেশিন যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি পরিবর্তন করে নতুন মেশিন বসানা হয়— অথবা ত্রুটি সঙ্গে সঙ্গে সারানো হয়। এজন্য ভোটাররা অধৈর্য্য হয়ে পড়েন এবং ভোট কিছু সময়ের জন্য বন্ধ থাকে। কিন্তু তার জন্য কোনও ভোটার তাঁর ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারলেন না তা হয় না। সুতরাং মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের দাবি, ভোট সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য সর্বাত্মক প্রয়াস নেওয়া হয়। কমিশন কোনও বাবেই প্রভাবিত হয় না। তবে রাহুল গান্ধি থেকে আরও বিরোধী শীর্ষ নেতারা ভোটে হারার পর ইভিএমকে প্রথমে কাঠগড়ায় দাঁড় করান। তারপর অভিযোগ আনেন কমিশনের নিরপেক্ষতা এটা ঠিক নয়।
এদিকে নতুন বছরের প্রথম সপ্তাহেই দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের বাঁশি বাজিয়ে দিল কমিশন। আগামী ৫ ফেব্রুয়ারি দিল্লির পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী কে হবেন, তা বেছে নেবেন রাজধানীর দেড় কোটি ভোটার। ফল প্রকাশ হবে ৮ ফেব্রুয়ারি। সম্প্রতি কমিশন নির্বাচনের দিনক্ষণ জানানার সঙ্গে সঙ্গে রাজধানী জুড়ে নির্বাচনী আচরণবিধি জারি হয়ে গেল। কমিশন নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা করলেও এখন ভোটের মাঠে বসেনি ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। বিজেপি এবার দিল্লির মসনদ দখল করতে মরিয়া। গত ২৫ বছরে দিল্লির তখত দখল করতে পারেনি এই দল। সেই কারণে মহিলাদের হাতে নগদ তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা এই দলেরও। আগামী ১ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় বাজেট। তার চারদিনের মাথায় দিল্লির ভোট। স্বাভাবিকভাবেই কেন্দ্রের শাসক শিবির ভোটারদের প্রভাবিত করতে দিল্লিমুখী একাধিক প্রকল্প ঘোষণা করতে পারে বলে বলা হচ্ছে। এই প্রসঙ্গে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব কুমার বলেন, কেন্দ্রীয় বাজেটে দিল্লি সংক্রান্ত কোনও ঘোষণা যাতে না হয়, তা নিশ্চিত করতে সম্প্রতি ক্যাবিনেট সচিবকে নোটিশ পাঠিয়েছে কমিশন। আচরণবিধি সবাইকে মানতে হবে। কোনও নতুন প্রকল্প ঘোষণা করা যাবে না।
এবারের দিল্লির নির্বাচনে বিতর্কিত বিষয়গুলির মধ্যে অন্যতম হল মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন অরবিন্দ কেরজিওয়ালের সরকারি বাসভবনের সংস্কারের খরচ হওয়া বিপুল অর্থ। সিএজি’র রিপোর্ট অনুযায়ী খরচ হয়েছে প্রায় ৩৩ কোটি— যা করদাতাদের। নির্বাচনের প্রচারে বিজেপি এই বিষয়টিকেই প্রধান হাতিয়ার করবে বলে বিজেপি সূত্রে বলা হয়েছে। নির্বাচনী প্রচার এখন তুঙ্গে— কারণ নির্বাচনের বেশি দিন আর বাকি নেই। কেজরিওয়াল আমজনতার প্রতিনিধি হয়েও বাড়ি সংস্কারে ৩৩ কোটি টাকা খরচ করেছেন, এই বিষয়টি প্রচার হওয়াতে রীতিমতো চরম অস্বস্তিতে পড়েছে আপ নেতৃবৃন্দ। তাই আপ সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন সংস্কার করা বাড়িটি ঘুরে দেখার জন্য। তাতে কি এই বিপুল অঙ্কের টাকা ঢাকা পড়বে?