শুক্রবার সকালে গুরু নানকের জন্মদিন উপলক্ষে ভাষণ দিতে গিয়ে বিতর্কিত তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহার করে নেওয়ার কথা ঘোষণা করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এ বিষয়ে সাংবিধানিক পদ্ধতি সম্পূর্ণ করতে মাস খানেক সময় লাগবে বলে তিনি জানিয়েছেন।
গত বছর সেপ্টেম্বরে তিনটি নতুন কৃষি আইন তৈরি করেছিল মোদি সরকার। তাতে বৃহৎ কৃষি ব্যবসায়ীরাই লাভবান হবেন এবং মার খাবেন ক্ষুদ্র চাষীরা—এই ছিল অধিকাংশ কৃষক সংগঠনের বক্তব্য। বৃহৎ কর্পোরেট কৃষি ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যাবে বাজারের নিয়ন্ত্রণ।
এছাড়া কৃষিপণ্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) না থাকায় ক্ষতিগ্রস্ত হবেন সাধারণ কৃষকেরা। তার উপর এই আইনের ফলে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ওদামজাত করে রাখার উপর সমস্ত বিধি-নিষেধ তুলে নেওয়া হয়েছিল। এতে বড় ব্যবসায়ীদের মুনাফা করার পথ খুলে দেওয়া হয়েছিল। আর এসবের বিরুদ্ধেই আন্দোলন করতে লক্ষ লক্ষ কৃষক পথে নেমেছিলেন।
আন্দোলনরত কৃষকরা যাতে রাজধানী শহর দিল্লিতে ঢুকতে না পারেন, তার জন্য দিল্লি-হরিয়ানা ও দিল্লি-ইউপির সব সীমান্তে কাঁটাতার দিয়ে বাঁধানো ব্যারিকেড তুলে দিয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার। রাস্তায় বসিয়ে দিয়েছিল উঁচু উঁচু তীক্ষ্ণ পেরেক।
উত্তর ভারতের তুমুল শৈত্যপ্রবাহ এবং গ্রীষ্মের দাবদাহের মধ্যেই অবস্থান করেছেন লক্ষ লক্ষ কৃষক। তাতে যোগ দিয়েছেন তাদের পরিবারের মহিলা ও শিশুরাও। প্রায় ৭০০ জন কৃষকের মৃত্যুও হয়েছে বলে দাবী করেছেন কৃষক নেতারা।
কিন্তু তাতে মন ভেজেনি মোদি সরকারের। কৃষক সংগঠনগুলির দাবী ছিল, যতক্ষণ পর্যন্ত না এই তিন কৃষি আইন বাতিল করা হচ্ছে, তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, কোনও রাজনৈতিক দলের পতাকা বা ব্যানার নিয়ে এই আন্দোলন হয়নি।
কংগ্রেস ও বামপন্থীদের সমর্থন নিশ্চয়ই ছিল এই আন্দোলনের পিছনে, কিন্তু প্রধান মুখ ছিলেন কৃষক সংগঠনের নেতারাই। বিজেপি-বিরোধী অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলিও পূর্ণ সমর্থন করেছে এই আন্দোলনকে। সেইসঙ্গে এও লক্ষ্য করার বিষয়, আর অল্প কয়েক মাসের মধ্যেই বিধানসভা নির্বাচন হতে চলেছে উত্তর প্রদেশ ও পাঞ্জাবে।
এই দুই রাজ্যেই কৃষিজীবী মানুষের সংখ্যা বেশি। সুতরাং কৃষকদের বিরুদ্ধে গিয়ে এই দুই রাজ্যে নির্বাচনে জেতা যাবে না এ হিসেব অত্যন্ত সোজা এবং স্পষ্ট স্বাভাবিকভাবেই মোদি সরকারের বিরোধী দলের নেতারা বলছেন, উত্তর প্রদেশ ও পাঞ্জাবের নির্বাচনের কথা ভেবেই মোদি সরকারের এই পদক্ষেপ।
এতে নরেন্দ্র মোদিকে কৃষক-দরদী ভাবার কোনও কারণ নেই। মনে রাখা দরকার, সুপ্রিম কোর্ট এই তিনটি নতুন কৃষি আইনকে সাময়িকভাবে স্থগিত রাখার কথা বলেছিল। কিন্তু তাতে কৃষক নেতারা আন্দোলন বন্ধ করেননি। তারা চেয়েছিলেন এই আইনগুলি সম্পূর্ণভাবেই বাতিল করতে হবে।
বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কৃষক নেতারা তাঁদের এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাতের অভিযোগও তুলেছেন। গত ৩ অক্টোবর উত্তর প্রদেশের লখিমপুরে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অজয় মিশ্রের ছেলে আশিস মিশ্র আন্দোলনরত কৃষকদের উপর গাড়ি চালিয়ে দিয়ে চারজন কৃষক ও একজন সাংবাদিকের মৃত্যু ঘটিয়েছেন, এই অভিযোগ করেছেন আন্দোলনকারী কৃষকেরা।
গ্রেফতারও হয়েছেন আশিস মিশ্র। প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণায় আন্দোলনকারী কৃষকেরা তাঁদের জয় হয়েছে মনে করলেও, এখনই তাঁরা আন্দোলন তুলে নিতে রাজি নন।
সংসদে এই আইন বাতিল হওয়ার পর ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) নিশ্চিত করার নতুন আইন প্রণয়ন করতে হবে এবং আশিস মিশ্রের শাস্তির যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, এটাই তাঁদের দাবি। প্রাথমিক জয় উদযাপন করলেও তারা এখনও সংশয়মুক্ত হতে পারছেন না।