রাজ্যে ভারী বৃষ্টির জেরে সোমবার একাধিক জেলা জলমগ্ন হয়ে পড়ে। পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, পশ্চিম মেদিনীপুর সহ একাধিক জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা জলমগ্ন হয়েছে। একাধিক জায়গায় নদী বাঁধ ভেঙেছে। নদীর দুই কুল ছাপিয়ে প্লাবিত হয়েছে বহু গ্রাম। জলের চাপে অনেক জায়গায় রাস্তায় ধস নেমেছে। বিভিন্ন স্থানে সেতু ডুবে যাওয়া বা ভেঙে যাওয়ার ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থাও বিচ্ছিন্ন হয়েছে। একাধিক জায়গায় বাড়িঘরও ভেঙেছে। দেওয়াল চাপা পড়ে দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছেন একজন বৃদ্ধ এবং এক যুবতী। পশ্চিম বর্ধমানের আসানসোলের বারাবনির রানীগঞ্জ এলাকায় অতিবৃষ্টিতে গোয়াল ঘরের দেওয়াল ভেঙে মৃত্যু হয়েছে এক ব্যক্তির। মৃতের নাম অশোক বন্দ্যোপাধ্যায় (৫০)।
বন্যার প্রকোপে হাজার হাজার বিঘা কৃষি জমি জলে ডুবে ফসলেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। মঙ্গলবারও সেই বন্যার প্রকোপ অব্যাহত রয়েছে। আরও বিস্তীর্ণ একলা জলমগ্ন হয়েছে। এদিকে বাংলা ও ঝাড়খণ্ডের একাধিক জলাধার থেকে জল ছাড়ার ফলে বাংলার বন্যা পরিস্থিতির ওপর আরও ভয়ঙ্কর প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। মঙ্গলবার নতুন করে রাজ্যের যেসব এলাকাগুলি প্লাবিত হয়ে ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, তাদের মধ্যে অন্যতম হল হুগলির খানাকুল। এখানে বাঁধ ভেঙেছে। গ্রামে হু হু করে জল ঢুকতে শুরু করেছে।
উদয়নারায়ণপুরে দামোদরের জল বিপদসীমার কাছে। ডিভিসির ছাড়া জলে হাওড়া জেলার আমতা ও উদয়নারায়ণপুরে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ডিভিসির ছাড়া জলে প্লাবিত আমতার দ্বীপাঞ্চল ভাটোরা এলাকা। ইতিমধ্যেই আমতা বিধানসভার দ্বীপাঞ্চলের অধিকাংশ নীচু এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। সুবর্ণরেখা নদীর জল বাড়ায় পশ্চিম মেদিনীপুরের দাঁতনে ব্রিজের উপর দিয়ে বইছে জল। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন বেলমুলা-সহ বিস্তীর্ণ এলাকার সঙ্গে। পূর্ব বর্ধমানের দামোদর নদের জলও বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পূর্ব বর্ধমানের কাটোয়া,আউশগ্রামের বহু কৃষি জমি প্লাবিত হয়েছে। কৃষকদের প্রচুর ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। দু’কূল ছাপিয়ে বইছে বরাকর নদীও।
এদিকে কুয়ে নদী ছাপিয়ে জল উঠেছে ফারাক্কা-হলদিয়া মজলিশপুরের কাছে বাদশাহী সড়কে। এই নদীর জলে প্লাবিত মুর্শিদাবাদের বড়ঞা থানার সোনাভারুই, কয়থা, মজলিশপুর, ভড়োয়ার মতো কিছু এলাকা। জলস্ফীতির জেরে মুর্শিদাবাদের ভরতপুর থানার ইব্রাহিমপুরের কাছে মিশে গিয়েছে কুয়ে ও ময়ূরাক্ষী নদী। স্লুইস গেট ভেঙে কুয়ে নদীর জলে প্লাবিত মুর্শিদাবাদের ভরতপুর থানার আঙারপুর গ্রামের একাংশ। জলমগ্ন হয়েছে ওই এলাকার কৃষিজমি থেকে কিছু ঘর-বাড়িও। বাসিন্দারা জানান, স্লুইস গেট ভেঙে যাওয়ায় গতকাল, সোমবার গভীর রাত থেকে গ্রামে জল ঢুকতে শুরু করেছে। এই ঘটনায় স্থানীয় পঞ্চায়েত, সেচ দপ্তরের দিকে অভিযোগের আঙুল তোলা হয়েছে। পঞ্চায়েতের অভিযোগ স্লুইস গেট অনেকদিন ধরেই খারাপ ছিল। সেচ দপ্তরকে তা জানানো হয়েছিল। কিন্তু মাটির বস্তা দিয়ে অস্থায়ীভাবে মেরামতি করা হয়েছিল। স্থায়ীভাবে সমস্যার কোনও সমাধান হয়নি। যার ফলে গতকাল, গভীর রাতে মাটির বস্তা সরে গিয়ে কুয়ে নদীর জল ওই এলাকায় ঢুকে পড়ে। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করছেন এলাকার চাষীরা। আবার দ্বারকা নদের জলে প্লাবিত হয়েছে মুর্শিদাবাদের খড়গ্রাম থানার কাদিপুর গ্রাম। যার জেরে আমন ধানের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
রাজ্যের ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিশেষভাবে নজর রাখছেন দক্ষিণবঙ্গের বন্যা পরিস্থিতির ওপর। রাজ্যের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন মুখ্যমন্ত্রী। মঙ্গলবার নবান্নে সাংবাদিক বৈঠকে একথা জানান আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়। এদিন তিনি বলেন ‘ডিভিসি যে অতিরিক্ত জল ছাড়ছে তার জন্য দক্ষিণবঙ্গে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। মুখ্যসচিবকে মাথায় রেখে ১০ জন আইএএসদের নিয়ে কমিটি তৈরি করা হয়েছে। বন্যা পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে জেলাশাসকদের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’
এদিকে বন্যা পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে এলাকা পরিদর্শন করছেন রাজ্যের মন্ত্রীরাও। মঙ্গলবার মন্ত্রী পুলক রায়, বেচারাম মান্না এবং মানস ভূঁইয়া বন্যা কবলিত বিভিন্ন এলাকা খতিয়ে দেখেন। সেই সঙ্গে জেলার প্রশাসনিক কর্তাদের সঙ্গেও বৈঠক করেন। আমতা ও উদয়নারায়ণপুরে বন্যা পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে এলাকা পরিদর্শন করেন মন্ত্রী পুলক রায়। এলাকার বন্যা পরিস্থিতি খতিয়ে দেখার পর উদয়নারায়নপুরে একটি প্রশাসনিক বৈঠক করেন পুলক বাবু। তিনি সেখানে প্রশাসনের বিভিন্ন বিভাগের আধিকারিকদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে পর্যালোচনা করেন। বিধায়ক সমীর পাঁজা জানান, যেভাবে ডিভিসি জল ছাড়ার পরিমাণ বৃদ্ধি করছে, তাতে আগামীকাল অর্থাৎ বুধবার দুপুরের পর থেকে পরিস্থিতি আরও আশঙ্কাজনক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পূর্ণিমার কোটালের জেরে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে বলে আশঙ্কা স্থানীয় বাসিন্দাদের। ইতিমধ্যেই নদী তীরবর্তী এলাকায় মাইকিং করে মানুষকে সতর্ক করার কাজ শুরু হয়েছে। ত্রাণ শিবির প্রস্তুত রাখার পাশাপাশি পর্যাপ্ত ত্রাণও মজুত রাখা হয়েছে। প্রয়োজনে বন্যা কবলিত এলাকা থেকে মানুষকে নিরাপদ স্থানে ত্রাণ শিবিরে সরিয়ে নিয়ে আসা হবে।
উদয়নারায়ণপুর থেকে মন্ত্রী পুলক রায় আমতা ২ নং ব্লকে গিয়ে বিধায়ক সুকান্ত পালের সঙ্গে বৈঠক করেন। সুকান্ত পাল জানান, ‘প্রশাসনের পক্ষ থেকে পরিস্থিতির দিকে নজর রাখা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে প্রশাসনিক স্তরে বৈঠক করা হয়েছে। দ্বীপাঞ্চলের পঞ্চায়েতগুলিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে ত্রিপল ও ত্রাণ সামগ্রী পাঠানো হয়েছে। ঘটনাস্থলে সিভিল ডিফেন্সের টিম পৌঁছেছে। বিপর্যয় মোকাবিলায় এনডিআরএফ-কে খবর দেওয়া হয়েছে। দ্বীপাঞ্চলের প্রসূতি মায়েদের মূল ভূখণ্ডে নিয়ে আসার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ওই এলাকার নদীতে নৌকা চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে।’
আবার আরামবাগে বন্যা পরিস্থিতি খতিয়ে দেখেন রাজ্যের সেচমন্ত্রী মানস ভূঁইয়া। তাঁর সঙ্গে ছিলেন মন্ত্রী বেচারাম মান্নাও। তাঁরা দুজনে আরামবাগ মহকুমা শাসকের অফিসে বৈঠকও করেন।