নিজস্ব প্রতিনিধি, বারাসত: একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসছে বারাসতের কাজীপাড়ার কিশোর খুনের ঘটনায়। নিজের ভাইপো ফারদিন নবীকে খুনের পর পুলিশ এবং স্থানীয়দের নজর এড়াতে সবরকম চেষ্টা করে জ্যেঠা আঞ্জিব নবী। তবুও শেষরক্ষা হয়নি। কিশোর খুনের এবং বাচ্চা চুরির গুজব রটানোর অপরাধে বারাসত পুলিশের হাতে গ্রেফতার হতে হয়েছে তাকে। বারাসত পুলিশের তরফ থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে যে, আঞ্জিবই ফারদিনের একমাত্র খুনি তথা সম্পূর্ণ ঘটনার মূল অভিযুক্ত। এবার অভিযুক্তকে জিজ্ঞাসাবাদের পর তদন্তকারীরা মনে করছেন, আঞ্জিব অত্যন্ত ঠান্ডা মাথার খুনি। তাই বারবার বয়ান বদলে, ছেলেধরার গুজব রটিয়ে পুলিশ এবং স্থানীয়দের বিভ্রান্ত করতে চেয়েছিল সে। এখানেই শেষ নয়। দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদের পর পুলিশ জানতে পারে, ফারদিনকে খুন করে কবর দিতে চেয়েছিল আঞ্জিব। কিন্তু শেষমেষ পুলিশি তৎপরতায় তাঁর পরিকল্পনা বদলায়। তারপর খুন করে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়ার ফন্দি আঁটে। যদিও এই বিষয়টিও সে আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল। সেইজন্য তার ভাই অর্থাৎ মৃতের বাবা গোলাম নবীর বাড়ি থেকে একটি শাড়ি চুরি করে নিজের কাছে রেখেছিল আঞ্জীব।
ময়নাতদন্তের রিপোর্টে জানা যায়, ঘটনার দিন ৬:৫০ থেকে ৭:৩০ এর মধ্যে খুন হয়। ভাইপোর গালে চড় মেরে গলা টিপে খুন করে গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলিয়ে দেয় পরিত্যক্ত বাড়িতে। পুলিশ সূত্রে খবর, খুনের পর একটু দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল সে। সেজন্য সে মসজিদে যায়। নমাজ পড়ে। কিন্তু সে দিনের নমাজ পড়ার ঘটনা তার মনে নেই। খুনের দিন বাড়িতে সে কী করেছিল, এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে পুলিশের কাছে আঞ্জিব বার বার বলে, ভারত-পাকিস্তানের ক্রিকেট ম্যাচ দেখছিল। কিন্তু ওই খেলায় কী কী হয়েছে, পুলিশি জেরায় সে সম্পর্কে সে কিছুই বলতে পারেনি।
পুলিশ সূত্রে খবর, বারবার স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে খুনের তদন্তে ঢুকে তদন্তকারীদের আগাগোড়া বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে আঞ্জিব। নমাজ পড়ার সময় স্থানীয়দের ভুল বুঝিয়ে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করে। তবে জেরার মুখে ভেঙে পড়ে ওই অভিযুক্ত। শেষ পর্যন্ত ভাইপোকে খুনের কথা স্বীকার করে নেয়। বারাসত পুলিশ জেলার পুলিশ সুপার প্রতীক্ষা ঝাড়খড়িয়া বলেন, “ফারদিনের দেহ একটি কাপড় দিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই কাপড়টি সংগ্রহ করে গত ৮ জুন থেকেই নিজের ব্যাগে রেখে দিয়েছিল আঞ্জিব। বাবা গোলামকে খুন করা কঠিন, কিন্তু বালক ফারদিন সেই তুলনায় অনেক সহজ নিশানা। এটাই ছিল পরিকল্পনা। ৮ জুন থেকেই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল আঞ্জিব। ৯ জুন সেই সুযোগ পায় সে। ১০ জুন থেকেই খুন ধামাচাপা দিতে বিভিন্ন ভুয়ো তথ্য ছড়াতে শুরু করে আঞ্জিব।”
পুলিশ সুপারের আরও দাবি, খুনের ঘটনা ধামাচাপা দিতে আঞ্জিব ব্যবহার করেছিল তাঁর পোশাক। মসজিদে আজান দেওয়ার কাজ করত সে। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে গত ১০ জুন, সোমবার আঞ্জিব নমাজ শেষে মসজিদেই এলাকাবাসীকে সাবধান করে দেয় যে, এলাকায় ছেলেধরা ঘুরছে। তাই বাইরের লোক দেখলেই তাঁকে মেরে তাড়িয়ে দিতে হবে। কিন্তু পুলিশি তদন্তে আঞ্জিবের সমস্ত পরিকল্পনা, কারসাজি ফাঁস হয়ে যায়। পুলিশ প্রথম থেকেই আঞ্জিবকে সন্দেহের তালিকায় রেখেছিল। কারণ ছিল তাঁর অতিসক্রিয়তা। পুলিশের সন্দেহ বৃদ্ধি পায় আঞ্জিবের বার বার বয়ান বদলে যাওয়ায়। শেষ পর্যন্ত তাকে গ্রেফতার করে চলে ম্যারাথন জেরা। যার ফলেই উঠে আসে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য। এখন প্রশ্ন হল, কেন আঞ্জীব ফারদিনকে খুন করে কবর দিতে চেয়েছিল?
উল্লেখ্য, গত ৩০ বছর ধরে কবর দেওয়ার কাজ করে সে। সেজন্য এই কাজে বেশ দক্ষ আঞ্জীব। একইসঙ্গে মুসলিম মতে, কারও মৃত্যু হলে তাঁকে যে গোসল বা স্নান করানো হয়, কবর দেওয়ার আগে সেই কাজও আঞ্জীব করত। তাই ভাইপোকে খুনের পরিকল্পনা করার পরই স্থানীয় মসজিদের পাশে থাকা কবরস্থানের চাবি নিজের কাছে নিয়ে রেখেছিল। এই বিষয়টি জানতে পেরে পুলিশের মনে সন্দেহ জাগে। তদন্তকারীরা মনে করছেন, সুযোগ পেলে ভাইপোর দেহ কবরস্থ করে ফেলত আঞ্জিব। কিন্তু পুলিশি তৎপরতায় সেই সুযোগ তিনি পাননি। সেই সুযোগ পেলে রহস্যের কিনারা করতে পুলিশকে বেগ পেতে হত। কিন্তু পুলিশি তৎপরতায় আঞ্জীব মৃত ভাইপোকে আর কবর দিতে পারেননি।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পৈতৃক সম্পত্তির বাঁটোয়ারা নিয়ে নিহত ফারদিনের বাবা গোলামের সঙ্গে দাদা আঞ্জিবের দীর্ঘ দিনের সমস্যা। গত ৭ জুন একটি তালগাছের ফল ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে ভাইয়ে-ভাইয়ে বাদানুবাদ হয়েছিল। সেই সময় বালক ফারদিন নাকি আঞ্জিবের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে। সেই থেকে ভাইপোর উপর রাগ গিয়ে পড়ে আঞ্জিবের। এরপর থেকেই ভাইকে শিক্ষা দিতে ভাইপোকে খুনের পরিকল্পনা করে আঞ্জিব। পরিকল্পনা মতো, ৯ জুন অর্থাৎ রবিবার ফারদিনকে হত্যা করে।
এদিন পুলিশ সুপার বলেন, “অভিযুক্ত এখন পুলিশি হেফাজতে আছে। অভিভাবকদের চিন্তার কারণ নেই। বাচ্চা চুরির গুজব ছড়ানোর পেছনে মাস্টারমাইন্ড সেই ছিল। এই জেলায় যেন এই ধরণের ঘটনা আর না ঘটে সেইজন্য মাইকিং চলছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় কেউ বাচ্চা চুরির পোস্ট করে থাকলে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে আমাদের টিম। আঞ্জীব একাই খুন করেছে, সে স্বীকার করেছে সেটা। জনসাধারণের আর ভীত হতে হবে না।”