কুণালের অডিও ক্লিপের সত্যতা নিয়ে সংশয় নেই, জানিয়ে দিলেন বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেটের ডিসি

স্বাস্থ্যভবনের বাইরে আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তারদের ধর্ণা মঞ্চের ওপর হামলার আশঙ্কায় শুক্রবার একটি অডিও ক্লিপ প্রকাশ করেন তৃণমূল নেতা কুনাল ঘোষ। সেই অডিও ক্লিপ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে বিভিন্নরকম বিতর্কের সৃষ্টি হয়। এবার সেই অডিও ক্লিপের ঘটনা সত্য বলে জানিয়ে দিল পুলিশ। এব্যাপারে বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেটের ডিসি অনীশ সরকার একটি সাংবাদিক বৈঠক করেন। সেখানে তিনি জানান, অডিও ক্লিপের সত্যতা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। ইতিমধ্যে এই ঘটনায় দুইজন অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করেছে বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেট। ধৃতদের মধ্যে একজন ডিওয়াইএফআই-এর মুখপত্রের সম্পাদক এবং সিপিএমের কলকাতা জেলা কমিটির সদস্য কলতান দাশগুপ্ত এবং অন্যজন হলেন সঞ্জীব দাস। তিনি হালতুর বাসিন্দা। শুক্রবার রাতে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

যদিও গ্রেপ্তারের পর কলতান অভিযোগ করেন, ‘তাঁকে গ্রেপ্তারের পিছনে ষড়যন্ত্র করা হয়েছে, তা না হলে আসল ইস্যু থেকে নজর ঘোরানোর চেষ্টা করা হচ্ছে কেন?’ তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ শুক্রবার ওই অডিও প্রকাশ্যে আনার পরে রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এরপরই স্বতপ্রণোদিতভাবে মামলা দায়ের করে তদন্ত নামে পুলিশ। এই অডিও ক্লিপের সত্যতা প্রকাশ্যে আসতেই তদন্তে নেমে শুক্রবারই সন্ধেয় গড়ফা থানা এলাকা থেকে সঞ্জীব দাস, ওরফে বুবলাইকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সূত্রের খবর, ধৃতকে জেরার সূত্র ধরেই শনিবার সকালে বাড়ি থেকে ডিওয়াইএফআই নেতা কলতান দাশগুপ্তকেও গ্রেপ্তার করে। সঞ্জীব এবং কলতান দু’জনকেই শনিবার আদালতে হাজির করিয়ে হেফাজতে নেওয়ার আবেদন জানাবে পুলিশ।

কুনাল ঘোষের সেই অডিও বার্তায় একজনকে বলতে শোনা যায়, ‘সাহেব অর্ডার করেছে, সল্টলেক ওড়ানোর জন্য।’ ফোনের অপার প্রান্তে থাকা দ্বিতীয় ব্যক্তি বলেন,’অর্ডার হলে করে দে।’ এরপর ফোনের অন্য প্রান্তে থাকা প্রথম ব্যক্তি বলেন,’যারা পার্টনার আছে, সবাই প্রশ্ন করছে।’ তখন ২য় ব্যক্তি ফের বলেন,’কিছু ভেবেই তো বলেছে।’


এরপরই প্রথম ব্যক্তির গলায় ভীতি প্রকাশ পায়। তিনি বলেন,’আমি এত বছর এই কাজ করেছি, কোনওদিন ভয়ডর লাগেনি। কিন্তু এখন এটাতে বিবেকে লাগছে। করাটা কি ঠিক হবে? ওরা তো লোকের জীবন বাঁচায়।’ প্রথম ব্যক্তি উত্তরে বলেন, ‘ছেলেরা মদ খেয়ে যায়। মারতে গিয়ে বেহাত যদি কিছু হয়ে যায়, সেটা তো চিন্তার বিষয়।’
দ্বিতীয় ব্যক্তি বলেন, ‘সেটা ওকে বল, আমার এমন মনে হচ্ছে, কী করব?’ প্রথম ব্যক্তি বলেন, ‘বাপ্পাদাকে পার্সোনালি জিজ্ঞেস করেছিলাম। বাপ্পাদা বলল, জানোয়ার হয়ে যায়নি এখনও।’ দ্বিতীয় ব্যক্তি বলেন, ‘ওই মতো করেই কর।’

এরপর আবার দ্বিতীয় ব্যক্তির কণ্ঠস্বর শোনা যায়। তিনি বলেন, ‘দাদু বলছে, নবান্নে মিটিং হয়নি। ওরা তো সল্টলেকে ফেরত চলে আসছে। ভাববে শাসকরা মারটা মেরেছে।’ তারপরই দ্বিতীয় ব্যক্তি বলেন,’কী বলল কথাটা বুঝেছ? বলছে, পুরো দোষটা দিয়ে আরও অশান্তিটা পাকানো যাবে। তবে কলকাতার কাউকে দিয়ে নয়। বাইরের লোক।’ প্রথম ব্যক্তি বলেন, ‘ঠিক আছে, দেখছি। কী করব? মাথা ফাটানোটা কি ঠিক হবে?’ দ্বিতীয় ব্যক্তি বলেন, ‘দেখ, খানিকটা যদি কিছু করা যায়।’

তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ শুক্রবার এই ফোনালাপের অডিও প্রকাশ করে অভিযোগ করেন যে, জুনিয়র ডাক্তারদের ধর্নায় ভয়ঙ্কর হামলা করার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। যাতে রাজ্য সরকার এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিদ্ধ করা যায়। তিনি দাবি করেন, বৃহস্পতিবার মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে জুনিয়র ডাক্তারদের বৈঠকের সময় এই হামলার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। পুলিশ সূত্রে খবর, এই ঘটনায় আরও কয়েকজনের যুক্ত থাকার সম্ভাবনা আছে। ইতিমধ্যেই পুলিশ তাঁদের খোঁজ শুরু করেছে।

প্রসঙ্গত সাংবাদিক বৈঠকে বিধাননগরের ডিসি বলেন,’ভাইরাল অডিও-তে দুজনের মধ্যে কথোপকথন শোনা গিয়েছে। তাঁদের মধ্যে একজন সঞ্জীব দাস, হালতুর বাসিন্দা। শুক্রবার রাতে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আরেকজন কলতান দাশগুপ্ত। তিনি ডিওয়াইএফআই নেতা। ওই অডিও সংবাদমাধ্যমে সম্প্রচারিত হয়েছে। আমরা তার সত্যতা যাচাই করে দেখেছি। অডিও-র সত্যতা যাচাই করে দেখেছি। আমরা অডিও ক্লিপিং পাওয়া মাত্রই আমাদের প্রযুক্তি বিশ্লেষণ উইং এবং তদন্তকারী উইং উভয় মিলেই অডিও-র সত্যতা যাচাই করি। অডিও-র সত্যতা নিয়ে কোনও সংশয় নেই।’

এদিকে পুলিশের তরফে দাবি করা হয়েছে, ধৃত সঞ্জীব ইতিমধ্যেই এই অডিও ক্লিপের সত্যতা স্বীকার করে নিয়েছেন। তিনি নাকি স্বীকার করে নিয়েছেন, ওই ভাইরাল অডিও-তে তাঁর গলা শোনা গিয়েছে। ডিসি আরও বলেন, ‘তদন্তের সময় তাঁদের স্বরের নমুনা মিলিয়ে দেখা হবে। আইনানুগ পদ্ধতিতে তদন্ত হবে। অডিওতে আমরা আরও তিনজনের নাম পেয়েছি। সাহেব, দাদু, আর বাপ্পা। তারা কারা, এই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে তারা কীভাবে যুক্ত, তা আমরা খতিয়ে দেখছি।’ তিনি বলেন,’ভাইরাল অডিও-তে দু’জনের মধ্যে কথোপকথন শোনা গিয়েছে। তাঁদের মধ্যে একজন সঞ্জীব দাস, হালতুর বাসিন্দা। শুক্রবার রাতে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি স্বীকার করে নিয়েছেন, কণ্ঠস্বর তাঁরই ছিল।’

অন্যদিকে এই ঘটনায় নিয়ে সিপিএম নেতা মহম্মদ সেলিম বলেন, যে ঘটনাক্রমের মধ্য দিয়ে কলতানকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তাতে ‘জাস্টিস ফর আরজি কর’ দাবিতে হওয়া গণআন্দোলনকে বদনাম করার চেষ্টা হচ্ছে বলেই স্পষ্ট ইঙ্গিত মিলছে। অন্যদিকে, সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী দাবি করেছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (আর্টিফিশিয়াল ইন্টালিজেন্স) ব্যবহার করে গভীর ষড়যন্ত্র করা হয়েছে।

পুলিশের কর্তারাও মনে করছেন, কুণালের এমন আশঙ্কার পিছনে যথেষ্ট কারণ রয়েছে। ফলে ঝুঁকি না নিয়ে নিরাপত্তায় বাড়তি জোর দিয়েছে পুলিশ। শুক্রবারই জুনিয়র চিকিৎসকদের ধর্নামঞ্চের কয়েকটি জায়গায় সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছিল। শনিবার নতুন করে আরও একাধিক সিসি ক্যামেরা লাগানোর পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট এলাকার নজরদারিতেও জোর দেওয়া হয়েছে। পুলিশের তরফে জানানো হয়েছে, বৃহস্পতিবার বিকেলে জুনিয়র চিকিৎসকদের প্রতিনিধিরা যখন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করতে নবান্নে গিয়েছিলেন, সেই সময়েই এই ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল বলে জানতে পেরেছেন তদন্তকারীরা।

তবে ধৃত সঞ্জীবের পরিচয় কি? এ প্রসঙ্গে অনীশ সরকার জানিয়েছেন, সঞ্জীবের ফোনে কিছু নাম পাওয়া গিয়েছে। তার ভিত্তিতেই তদন্ত শুরু হয়েছে। কলতান নিজে অবশ্য দাবি করেছেন, তাঁকে গ্রেপ্তারির নেপথ্যে রয়েছে কোনও ষড়যন্ত্র। তবে কলতানের রাজনৈতিক পরিচয় সকলে জানলেও, সঞ্জীবের রাজনৈতিক পরিচয় জানায়নি পুলিশ। অডিও ক্লিপ প্রকাশ্যে আসতেই আন্দোলনরত জুনিয়র চিকিৎসকদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। এই পরিস্থিতিতে অনীশ সরকারের বক্তব্য, ‘আমরা স্বাস্থ্যভবনের বাইরে সিসিটিভি ক্যামেরা বসিয়েছি। ধর্ণা-মঞ্চ এবং তার সংলগ্ন অঞ্চলে আগেও পুলিশ মোতায়েন ছিল, এবার তা আরও বাড়ানো হয়েছে। আমরা প্রতিমুহূর্তে তাঁদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নজরদারি চালাচ্ছি।’

উল্লেখ্য, জুনিয়র চিকিৎসকেরা গত মঙ্গলবার থেকে স্বাস্থ্য ভবনের সামনে অবস্থান বিক্ষোভে অনড়, এবং তারা পাঁচ দফা দাবি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে আলোচনার আবেদনও জানিয়েছিলেন। ইতিমধ্যে বৃহস্পতিবার মুখ্যমন্ত্রী নবান্ন বৈঠকের জন্য ডাকলেও, জুনিয়র চিকিৎসকেরা সরাসরি সম্প্রচার নিয়ে অনড় অবস্থান নেওয়ায় বৈঠক সম্ভব হয়নি। বিষয়টি নিয়ে শুক্রবারও জট কাটেনি। অবশেষে শনিবার স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বাস্থ্যভবনে হাজির হয়ে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে দেখা করে তাঁদের দাবি বিবেচনা করে দেখার প্রতিশ্রুতি দেন।

এদিকে অডিও-ক্লিপ কাণ্ডের জল গড়িয়েছে অনেক দূর।এবার এই ঘটনায় সিপিএমকে আক্রমণ শানিয়েছেন রাজ্যের পরিবহনমন্ত্রী স্নেহাশিস চক্রবর্তী। নির্দিষ্ট ঘটনার উল্লেখ না করে বামেদের ‘নৈরাজ্য’ সৃষ্টির প্রয়াসের অভিযোগ তুলে সরব হয়েছেন পরিবহনমন্ত্রী। শনিবার তিনি সমাজমাধ্যমে লিখেছেন, ‘ক্ষমতায় আসার জন্য সিপিএম যা খুশি করতে পারে! যতটা নীচে নামা যায়। মুখোশের আড়ালে থেকে নৈরাজ্য তৈরি করার ছক। অতীতে এঁদের মূল ভাবনায় ছিল ”বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস”। এখন ”নৈরাজ্য সৃষ্টিই ক্ষমতার উৎস”-কে আঁকড়ে ধরেছে।’ স্নেহাশিসের ইঙ্গিত, জুনিয়র ডাক্তারদের টানা কর্মবিরতি এবং নবান্ন-বৈঠকে ইতিবাচক সাড়া না দেওয়ার পেছনে ”রাজনৈতিক পরামর্শ” রয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেস এ প্রসঙ্গে ”রাম-বাম”-কে একত্রে কাঠগড়ায় দাঁড় করালেও মন্ত্রী স্নেহাশিস চক্রবর্তীর আক্রমণের তীর কেবল বামেদের দিকেই।

তিনি আরও লিখেছেন, ‘একদিকে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন চালিয়ে যাবার পরামর্শ আর অন্যদিকে তাদের ওপরই হামলার ব্লুপ্রিন্ট। এরা সমাজ বিরোধী।’

বিধাননগর গোয়েন্দা প্রধান অনীশ সরকার জানিয়েছেন, ‘কলতান দাশগুপ্তের ১৪ দিনের পুলিশি হেফাজত চেয়ে আবেদন করা হয়েছে আদালতে।” এরপরই আক্রমণাত্মক হয়েছেন পরিবহনমন্ত্রী স্নেহাশিস চক্রবর্তী। মন্ত্রীর স্পষ্ট দাবি, ভোটে হার-জিত থাকেই। কিন্তু রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য অরাজকতা তৈরি করে একটি গণতান্ত্রিক সরকারকে ইচ্ছাকৃতভাবে ভেঙে দেওয়ার প্রয়াস করা নিন্দনীয়। নির্বাচনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় তথা তৃণমূলকে পরাজিত করতে পারবে না জেনেই ‘বন্দুক’-এর সাহায্য নিয়ে ‘নৈরাজ্য’ সৃষ্টি করতে উদ্যত হয়েছে সিপিএম, মত স্নেহাশিস চক্রবর্তীর। অডিও-কাণ্ডে বাম-যোগ ফাঁস হতেই এর তীব্র নিন্দা করেছেন তিনি।