বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনে শুধুমাত্র গত ৪৮ ঘন্টাতেই ৩ লক্ষ ৪২ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকার বিনিয়োগের প্রস্তাব এসেছে। এই বিরাট অঙ্কের প্রস্তাব কার্যকর হলে প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান হবে।
শিল্প সম্মেলনে শেষ দিনে লক্ষ্মীবারে লক্ষ্মীলাভের বিরাট ঘোষণা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। এবারের বাণিজ্য সম্মেলনে মোট ১৩৭ টি মউ স্বাক্ষর করেছে রাজ্য সরকার এবারের শিল্প সম্মেলনকে সবচেয়ে সফল বলে মনে করছেন মুখ্যমন্ত্রী।
তাঁর কথায়, আমরা যেন আগামী ১০ বছরে এমন জায়গায় পৌঁছে যাই যে অন্য রাজ্যগুলি আমাদের ছুঁতেও না পারে। তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসার পরেই শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থানের ওপরেই জোর দিয়েছিল মমতা সরকার।
শিল্পই যে সরকারের মূল লক্ষ্য, দুর্দিনের বাণিজ্য সম্মেলনে তা বুঝিয়ে দিয়েছেন মমতা। তার জন্য সবরকম সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছে রাজ্য বাংলায় বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশের জন্য সমাপ্তি দিনে শিল্পপতিদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন মমতা করোনার প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে এই শিল্প সম্মেলন করা সত্যিই একটা চ্যালেঞ্জ ছিল রাজ্য সরকারের কাছে।
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘অনেকেই আমাকে বারণ করেছিল, এবছর শিল্প সম্মেলন করতে। কেউ কেউ বলেছিলেন, এখন শিল্প সম্মেলন করলে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের শিল্পদ্যোগীদের মধ্যে কারাই বা আসবে? কারাই বা বিনিয়োগ করা চাইবে?
কিন্তু আমি বলেছিলাম, মানুষের মধ্যে আত্মবিশ্বাস বাড়াতে চলুন না শিল্প সম্মেলন করে দেখি মহামারী, রোগ আসবে-যাবে। কিন্তু উন্নয়ন কাজ চালিয়ে যেতেই হবে। মুখ্যমন্ত্রীর মতে এই বিশবঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলন আসলে একটা উৎসব, শিল্পের উৎসব। তাই যেমন করে ধর্মীয় উৎসব পালন করা হয়, তেমনি করে প্রতি বছর এই শিল্পের উৎসবও পালন করা হবে।
আগামী বছর ফেব্রুয়ারি মাসের ১,২,৩ তারিখে এই শিল্প সম্মেলনের সূচিও এদিন ঘোষণা করে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
মুখ্যমন্ত্রী এদিন বলেন , এখন বিনিয়োগের আদর্শ ঠিকানা বাংলাই। লগ্নির ক্ষেত্রে অন্য সব রাজ্যের থেকে এগিয়ে বাংলা। রাজ্যে শিল্পবান্ধব পরিবেশের চিত্র তুলে ধরতে বৃহস্পতিবারও সম্প্রীতি ও ঐক্যের বার্তা দিলেন মুখ্যমন্ত্রী।
শিল্পপতিদের উদ্দেশে বললেন, বাংলা বুলডোজারে নয়, ঐক্যে বিশ্বাস রাখে। প্রসঙ্গত সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, কর্নাটক এমনকী খোদ রাজধানীতেও কোথাও কোনও সাম্প্রদায়িক অশান্তির ঘটনা ঘটলে সরকারি নির্দেশে বাড়ি ভেঙে দেওয়ার ঘটনা ঘটছে।
এই রাজ্যে যে তেমন পরিস্থিতি নেই সেকথা শিল্পপতিদের জানিয়ে নিশ্চিন্ততার বার্তা দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। শিল্প সম্মেলনের শেষ দিনে রাজ্যের উত্তর থেকে দক্ষিণে অনেকগুলি রফতানি হাব তৈরির কথা বলেন। যার মাধ্যমে দ্রুত বাংলার উৎপাদন বিদেশে পৌঁছে যাবে।
রাজ্যে বিনিয়োগ করছে ফ্লিপকার্ট, ইনফোসিস-এর মতো বহুজাতিক কোম্পানিগুলি। বিদেশ থেকে আসা বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে যেতে বলেন মুখ্যমন্ত্রী। আবার অন্যদিকে জেলার চেম্বার অফ কমার্স-এর সঙ্গেও সমন্বয় রেখে চলার কথা বলেন।
কারণ এই কোভিডের সময়ে জেলার এমএসএমই বিভাগের শিল্পোদ্যোমই বিপুল সংখ্যর মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছিল। এবারের শিল্প সম্মেলনে ৪২ টা দেশ থেকে ৪৩০০ জন আমন্ত্রিত এসেছিলেন।
অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশ, ভূটান, ফিনল্যান্ড, জার্মানি, ইতালি, জাপান, কোরিয়া, মালয়েশিয়া, নেদারল্যান্ড, নরওয়ে, পোল্যান্ড, কেনিয়া, ব্রিটেন–এই চোদ্দটি দেশ পার্টনার কান্ট্রি হিসেবে সম্মেলনে যোগ দেয় । ১৯ টি দেশের রাষ্ট্রদূতরাও এসেছিলেন এবারের শিল্প সম্মেলনে।
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, এই উপস্থিতিই প্রমাণ দেয় শিল্প সম্মেলনের সাফল্যের। বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে জেটরো জিকা, কোটরা জার্মানির ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্ট, মালয়েশিয়া এক্সটারনাল ট্রেড ডেভেলপমেন্ট করেপারেশন ইন্দো ইতালিয়ান চেম্বার অফ কমার্স, ব্রিটিশ কাউন্সিল ইত্যাদি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থা অংশ নিয়েছিল।
এছাড়া মাইক্রোসফট, আদানি গ্রুপ আইটিসি, আইবিএম টাটা হাইটেক, গেইল, গেনওয়েল ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি শিল্প সংস্থা বাংলায় বিনিয়োগে উৎসাহ দেখিয়েছে ।
এগ্রিকালচার, ফুড প্রসেসিং, পরিকাঠামো তৈরি, পর্যটন , হসপিটাল ম্যানেজমেন্ট, শিক্ষা, খনিজ পণ্যের বাণিজ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে দেশী ও বিদেশি বিনিয়োগের প্রস্তাব এসেছে। রাজ্য সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের সঙ্গে একাধিক মউ স্বাক্ষরিত হয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, গত পাঁচ বছরে ১২ লক্ষ ৩০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রস্তাব এসেছিল। সেদিক থেকে এবারের শিল্প সম্মেলনে বিনিয়োগের অংকটা তুলনামূলকভাবে বেশিই। অতীতের বহু প্রকল্পই বাস্তবায়নের পথে রয়েছে।
কারণ রাতারাতি শিল্পের হাল বদল হয় না বুধবার আদানি গোষ্ঠী ১০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আইটিসি’র সঞ্জীর পুরীও ৩ হাজার কোটি টাকা লগ্নির প্রস্তাব দিয়েছেন।
এছাড়া কলকাতার শিল্পপতি হর্ষ নেওটিয়ার সংস্থা ২৭০০ কোটি, হলদিয়া পেট্রোকেমিকেলস-এর অন্যতম কর্ণধার পূর্ণেন্দু চ্যাটার্জির এইচপিসিএল-এ ৬ হাজার কোটি বিনিয়োগের কথা ঘোষণা করেছেন।
শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য, পর্যটন, কৃষিভিত্তিক শিল্প ইত্যাদি ক্ষেত্রে যে মউ স্বাক্ষরিত হয়েছে সেখানেও সব মিলিয়ে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রস্তাব এসেছে এবারের বিশ্ব বঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনে।
মুখ্যমন্ত্রী বলেন ইজ অফ ডুয়িং বিজনেস, পরিকাঠামো উন্নয়ন, সুদক্ষ শ্রমিক, শিল্পবান্ধব পরিবেশ, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাই দেশ বিদেশের শিল্পদ্যোগীদের বাংলায় লগ্নি করতে উৎসাহী করেছে। রাজ্যের ডিজিটাইজেশন কর্মধারার সুযোগ সুবিধে উন্নততর করতে বৃহস্পতিবার রাজ্য সরকারের চারটি পোর্টালের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন মুখ্যমন্ত্রী।
এগুলি হল সর্বশেষ তথ্য নিয়ে ‘রিভ্যাম্পড শিল্পসাথী পোর্টাল’, রফতানি বাণিজ্যের তথ্য সমৃদ্ধ ‘এক্সপোর্ট ফেসিলিটেশন পোর্টাল’, বেরসরকারি সংস্থার পণ্য প্রদর্শনের সুবিধের জন্য স্টেট পোর্টাল ফর অনলাইন এগজিবিশান পোর্টাল এবং স্বনির্ভর গোষ্ঠীর উৎপাদিত পণ্যের অনলাইন বাণিজ্যের ‘নিজস্বিণী’ পোর্টাল।
এছাড়া রসগোল্লা সব ২২টি পণ্যের জন্য বাংলার জিআই ট্যাগ পাওয়ার হালহদিশ দেওয়ার কফিবুক এবং ইজ অফ ডুয়িং বিজনেস-এর দিশা দেখানোর প্রয়োজনীয় বইও বিশ্ববঙ্গ সম্মেলনের সমাপ্তি দিনে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করলেন মুখ্যমন্ত্রী।