• facebook
  • twitter
Saturday, 23 November, 2024

চ্যালেঞ্জ দূরঅস্ত, খড়কুটোর মতো উড়ে গেল বিরোধীরা

চা-বাগানে অতীতের তুলনায় তৃণমূলের সংগঠন আগের থেকে বেড়েছে। কারণ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নির্বাচনী প্রচারে এসে চা-বাগানগুলির বেহাল দশা কাটানোর জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার কথা বললেও বাস্তবে তার কিছুই হয়নি।

প্রতীকী চিত্র

দেবাশিস দাস

উন্নয়ন অস্ত্র এবং তৃণমূল কংগ্রেসের সাংগঠনিক ক্ষমতার উপর নির্ভর করে প্রত্যাশিত জয় পেল রাজ্যের শাসক দল। বিরোধীরা যখন আরজি করের ঘটনা এবং দুর্নীতিকে সামনে রেখে সুর চড়াচ্ছিলেন, ঠিক সেই সময় বিধানসভা কেন্দ্রগুলিতে সমীক্ষক সংস্থার প্রতিনিধিদের পাঠিয়ে জনমত যাচাইয়ের কাজটা করা হচ্ছিল তৃণমূল কংগ্রেসের তরফে। সমীক্ষক সংস্থার রিপোর্টের উপর নির্ভর করে প্রার্থী বাছাই এবং রণকৌশল গ্রহণ করা হয়েছিল সুনিপুণভাবে। আরজি করের ঘটনায় অস্বস্তি বেড়েছিল রাজ্যের শাসক দলের। তা সত্ত্বেও ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতি মোকাবিলা করা হয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেসর তরফে। রাজ্যের নেতা-মন্ত্রী থেকে শুরু করে দলের সর্বস্তরের নেতাদের সংবাদমাধ্যমের সামনে প্রতিক্রিয়া দেওয়ার ব্যাপারেও সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল। শাসক দল হিসেবে তৃণমূল চেয়েছিল বিধানসভা উপনির্বাচনের ফলাফলের মাধ্যমে বিরোধীদের কুৎসার জবাব দিতে। ফলে শাসক বিরোধীরা যতই বিভিন্ন ইস্যুকে সামনে রেখে সুর চড়িয়েছেন, শাসক দলের নেতারা সংযত আচরণ করেছেন দলের শীর্ষ নেতৃত্বের নির্দেশে। বিধানসভা উপনির্বাচনের ফলাফল রাজ্যের শাসক দলের পক্ষেই যায়। এবারেও তার অন্যথা হয়নি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ছ’টি আসনের প্রতিটিতে জয় নিঃসন্দেহে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা-কর্মীদের মনোবল অনেকখানি বাড়িয়ে দেবে।

এদিকে বিধানসভার ৬টি আসনের উপনির্বাচনে বিরোধীদের অবস্থা রীতিমতো ছন্নছাড়া। তৃণমূল কংগ্রেসের জয় ছিল শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা। সবকটি আসনেই রাজ্যের শাসক দল বিপুল ব্যবধানে জয়ী হয়েছে। মাদারিহাটের মতো আসনও বিজেপির কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে তৃণমূল। উত্তরবঙ্গে বিজেপির সাংঠনিক অবস্থার কঙ্কালসার চেহারা ক্রমশ প্রকট হচ্ছে। নিশীথ প্রামাণিক এবার সংসদে যাওয়ার ছাড়পত্র পাননি। কিন্তু সিতাই বিধানসভাতে যেভাবে বিজেপিকে পর্যুদস্ত হতে হল, তার ফলে এ রাজ্যে বিজেপির সম্ভাবনা আগামীতে কতটুকু থাকবে, তা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ শুরু হয়ে গিয়েছে। লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি যে ভোট পেয়েছিল, তার চেয়ে ৬০ হাজার ভোট কম পেয়েছে সিতাই আসনে। এখানে তৃণমূল প্রার্থীর জয়ের ব্যবধান ১ লক্ষ ৩০ হাজার। বিজেপি প্রার্থীর এখানে জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। সিতাইয়ে যে বিজেপির ফল খারাপ হবে, তা আগাম আন্দাজ করতে পেরেছিলেন বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। এ বিষয়ে তিনি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে সব জানিয়েছিলেন। নিশীথ প্রামাণিক তৃণমূলে থাকাকালীন তিনি যতটা সংগঠনে সময় দিতেন, মুকুল রায়ের হাত ধরে বিজেপিতে যোগদানের পর তিনি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হয়ে যান। এরপর থেকে তাঁকে ঘিরে ক্ষমতার একটি অন্য বৃত্ত তৈরি হয়। ক্রমশ নীচুতলার কর্মীদের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব বাড়তে থাকে। জেড ক্যাটাগরির নিরাপত্তার বলয়ে থাকা এই নেতাকে হারানোর জন্য ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলও আদাজল খেয়ে নেমে পড়ে। যার পরিণতিতে এই কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে হারতে হয়। উল্লেখ্য, ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল ৩০ হাজার ভোটে সিতাইয়ে এগিয়েছিল। এবার সেই সিতাইয়ে কার্যত মুখ থুবড়ে পড়ল বিজেপি।

এদিকে এই প্রথম মাদারিহাটে জয় পেল তৃণমূল। মনোজ টিগ্গা লোকসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হওয়ায় এই আসনে উপনির্বাচন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। এই আসনটি ধরে রাখতে পারল না বিজেপি। বিধানসভা উপনির্বাচনে বিজেপির এই শোচনীয় পরাজয়ে রীতিমতো উল্লসিত রাজ্যের শাসক দল। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের কারণে বিজেপির এই পরাজয় বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহলের একাংশ। মাদারিহাটে শাসক দলের প্রার্থী নির্বাচন থেকে শুরু করে রণকৌশল তৈরি করা, সবকিছুতেই অভিজ্ঞতার ছাপ ছিল স্পষ্ট। সে কারণে সহজ জয় ঘরে তুলতে সক্ষম হয়েছে তৃণমূল। বিজেপির গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, সেই সঙ্গে বিজেপির প্রাক্তন সাংসদ জন বার্লার ভূমিকা তৃণমূলকে অনেকখানি এগিয়ে দিয়েছে।

চা-বাগানে অতীতের তুলনায় তৃণমূলের সংগঠন আগের থেকে বেড়েছে। কারণ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নির্বাচনী প্রচারে এসে চা-বাগানগুলির বেহাল দশা কাটানোর জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার কথা বললেও বাস্তবে তার কিছুই হয়নি। অন্যদিকে উত্তরবঙ্গে হারানো জমি ফিরে পাওয়ার জন্য তৃণমূল মরিয়া ছিল। তারই ফলশ্রুতিতে উত্তরবঙ্গের দু’টি আসনে বাজিমাত করল রাজ্যের শাসক দল। চা-বাগানগুলিতে পানীয় জলের সমস্যা থেকে শুরু করে চা-শ্রমিকদের জন্য আবাস তৈরি, সবকিছুই করছে রাজ্য সরকার। মাদারিহাট একটা সময় ছিল আরএসপি’র শক্ত ঘাঁটি। ২০১৬ সালে এই আসনে বিজেপির মনোজ টিগ্গা জয়ী হয়েছিলেন প্রায় ৩০ হাজার ভোটে। সেই আসনে এবার হারতে হল বিজেপিকে।

অন্যদিকে আরজি কর’কে ঘিরে আন্দোলনের কোনও প্রভাব পড়ল না এই উপনির্বাচনে। আরজি কর’কে কেন্দ্র করে যে অসন্তোষ দানা বেঁধেছিল, তা বিরোধীদের ভোটবাক্সে বসন্ত আনতে পারেনি। কারণ, আরজি করের এই আন্দোলন ছিল শহরকেন্দ্রিক। গ্রামের দিকে এর কোনও প্রভাবই পড়েনি। কিন্তু নৈহাটির মতো এলাকায় এর প্রভাব পড়বে, এমনটাই ভাবা হয়েছিল। কিন্তু সেখানেও তৃণমূলের জয়জয়কার। আরজি করের নির্যাতিতার বাড়ির ১৫ কিলোমিটার দূরে নৈহাটি। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিরোধীরা এই বিধানসভায় নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতে ব্যর্থ। কোচবিহারে সিতাই বিধানসভায় প্রার্থী দিয়েছিল ফরওয়ার্ডব্লক। এখানে ফরওয়ার্ডব্লকের প্রার্থীর চেয়ে বেশি ভোট পেয়েছেন কংগ্রেস প্রার্থী। নৈহাটিতে লোকসভা নির্বাচনে নিরিখে বামেদের ভোট কমেছে। এই কেন্দ্রে এবার প্রার্থী দিয়েছিল সিপিআইএম (লিবারেশন)। কিন্তু বামেদের এই কৌশল কোনও কাজে আসল না। মেদিনীপুর বিধানসভা আসনে লোকসভা নির্বাচনে বামেরা যে ভোট পেয়েছিল, এবার তার চেয়েও কয়েকশো ভোট বেশি পেয়েছে। হাড়োয়ায় এবার বামেরা প্রার্থী না দিয়ে আইএসএফ’কে ছেড়ে দিয়েছিল। এখানেও আইএসএফ প্রার্থী ব্যর্থ হয়েছেন তৃণমূলকে বেগ দিতে। বাঁকুড়ার তালডাংরায় সিপিএমের ভোট কিছুটা বেড়েছে। ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনে তালডাংরায় সিপিএম পেয়েছিল প্রায় সাড়ে ১৬ হাজারেরও কিছু বেশি ভোট। এবার এই আসনে বামেরা পেয়েছে ২০ হাজার ভোট। স্বাভাবিকভাবে এই উপনির্বাচনে বিজেপি, কংগ্রেস, বামেরা চূড়ান্ত ব্যর্থ। একমাত্র হাড়োয়া আসনে বাম সমর্থিত আইএসএফ প্রার্থী পিয়ারুল ইসলাম দ্বিতীয় স্থান পান। যদিও প্রতিটি আসনে বাম এবং বাম সমর্থিত প্রার্থীদের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। একই অবস্থা কংগ্রেসেরও। এবার কংগ্রেস এককভাবে লড়াই করেছিল। হাড়োয়াতেও বিজেপির ভোটব্যাঙ্কে রক্তক্ষরণ অব্যাহত। ৮০ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোটার রয়েছে এই কেন্দ্রে। এখানেও বিজেপি প্রার্থী জামানত রক্ষা করতে পারেনি।

২০২৬ বিধানসভা নির্বাচন যতই সামনে আসছে, সাংগঠনিকভাবে বিজেপিকে আরও ক্ষয়িষ্ণু মনে হচ্ছে। উল্লেখ্য, ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি এ রাজ্যে ৭৭টি আসনে জয়ী হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বিজেপির বেশ কয়েকজন বিধায়ক দলবদল করে রাজ্যের শাসক দলে নাম লেখান। ফলে বিজেপির বিধায়ক সংখ্যা ঠিক কত, তা নিয়ে নতুন করে কৌতূহল তৈরি হয়েছে। কারণ মুকুল রায়, সুমন কাঞ্জিলাল, তন্ময় ঘোষ, হরকালী পতিহারের মতো বিধায়করা দলবদল করে এখন তৃণমূলে। মাদারিহাট হাতছাড়া হয়েছে বিজেপির। ২০২১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে রায়গঞ্জ, শান্তিপুর, রানাঘাট দক্ষিণ ও বাগদায় বিজেপি জয়ী হয়েছিল। তবে পরবর্তী সময়ে এই বিধায়করা দলবদল করায় উপনির্বাচন হয়। এই চারটি আসনেও তৃণমূল জয়ী হয়। ধূপগুড়ির বিজেপি বিধায়ক বিষ্ণুপদ রায় প্রয়াত হওয়ার পর সেখানেও উপনির্বাচন হয়েছিল। এই আসনটিতেও তৃণমূল জয়ী হয়।

তৃণমূলকে বিধানসভা উপনির্বাচনে বিজেপির চ্যালেঞ্জ জানানো তো দূরঅস্ত, সামান্য লড়াইটুকুও দিতে পারেনি। তা সত্ত্বেও কর্মীদের উজ্জীবিত করতে বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার সংবাদমাধ্যমকে প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছেন, ‘উপনির্বাচনে এমন ফলই হয়। কারণ, বহু এলাকায় ভোট দিতেই দেওয়া হয় না। তবে ২০২৬ সালে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপিই ক্ষমতায় আসবে।’ তাঁর এই দাবিকে অলীক স্বপ্ন বলে কটাক্ষ করেছেন তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ। এ বিষয়ে কুণালের কটাক্ষ, ‘উনি অলীক স্বপ্ন দেখছেন। স্বপ্ন দেখতে বাধা কোথায়?’