বাড়তি কিছু আয়ের আশায় তারা পাড়ি দিয়েছিলেন মুর্শিদাবাদের বােখরা গ্রামপঞ্চায়েতের সাগরদিঘির প্রত্যন্ত গ্রাম বাহালনগর থেকে দক্ষিণ কাশ্মীরের কুলগ্রামে। যেমনটি তারা প্রতিবছরই যায়। প্রত্যেকের ফিরে আসার সময়ও হয়ে এসেছিল। কিন্তু কে জানত তাদের জন্য অপেক্ষা করছে জঙ্গিদের বন্দুকের গুলি।
মঙ্গলবার রাতে সারি দিয়ে দাঁড় করিয়ে যে পাঁচজন বাঙালি দিনমজুরকে নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছিল, বৃহস্পতিবার ভােরের আলাে ফোটার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামে ঢুকল তাঁদের নিথর শবদেহের গাড়ি। বুধবার রাতে শ্রীনগর থেকে কলকাতায় আসে তাঁদের কফিনবন্দি দেহগুলি। সঙ্গে সঙ্গে কফিনগুলি রওনা দেয় সাগরদিঘির উদ্দেশ্যে। সঙ্গে ছিলেন পুর ও নগরােন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। মৃতদেহগুলি কখন ঢুকবে গ্রামে, সে আশায় রাত জেগে বসেছিল মৃতের পরিবার, আত্মীয় ও গ্রামের মানুষ।
কাতরুসু গ্রামে জঙ্গিদের হাতে মৃত রফিক শেখ, রফিকুল শেখ, কামিরুদ্দিন শেখ, মুরসালিন শেখ, নঈমুদ্দিন শেখের শবদেহের গাড়িগুলি এক এক করে গ্রামে ঢােকা মাত্র কান্নায় ভেঙে পড়েন মানুষ। গ্রামের মধ্যেই মঞ্চ তৈরি করে সেখানে পর পর রাখা হয় দেহগুলি। মন্ত্রীর সঙ্গে গ্রামে যান মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রের সাংসদ আবু তাহের খান, জেলা পরিষদের পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ রাজীব হােসেন এবং প্রশাসনের আধিকারিকরা। তারা মরদেহগুলিতে মালা দিয়ে শেষ শ্রদ্ধা জানান। তারপর দেহগুলি তুলে দেওয়া হয় পরিবারের হাতে। এদিন ক্ষতিপূরণের চেকও তুলে দেওয়া হয় পরিবারের হাতে। তবে প্রত্যেকেই একটা কাজের দাবি তােলেন।
ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়েই ক্ষোভ উগরে দেন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। তিনি বলেন, ‘৩৭০ ধারা প্রত্যহার করে লাভটা কি হল? এতগুলাে মানুষ মারা গেল। বাইরের সাংসদদের কাশ্মীরে নিয়ে এসে চারিদিকে তাদের নিরাপত্তারক্ষীদের ঘিরে রাখা হল। তাদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হল। কিন্তু সাধারণ মানুষরা থাকল নিরাপত্তাহীনতায়। ফলে সাধারণ মানুষকে নৃশংসভাবে মারা হল। আর এখনও কেন্দ্রীয় সরকার চুপ করে বসে আছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বড়াে বড়াে কথা বলে থাকেন। আজ কেন কিছু বলছেন না? এই মানুষগুলােকে যারা গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিল, কেন তাদের টেনে নিয়ে মারা হচ্ছে না?’
তিনি আরও বলেন, ‘এখানকার পুলিশ আধিকারিকদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের কাছেও কোন সঠিক খবর নেই। তাদের মােবাইলের সিমকার্ড চলছেনা। যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব ওখানকার স্বরাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে কথা বলে, ওখানে এখনও যারা কর্মরত আছেন, তাদের কিভাবে ফিরিয়ে আনা যায়, সেই চেষ্টা করছেন’। এদিনই গ্রামের গােরস্থানে পর পর পাঁচজনকে কবরস্থ করা হয়। গ্রামের মানুষ সমবেতভাবে কবরগুলি খোঁড়েন।
এদিন বেলা বাড়তেই হেলিকপ্টারে বহরমপুরে ঢােকেন রাজ্যের সেচ ও পরিবহণমন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী। বহরমপুর স্টেডিয়ামে তিনি নামেন। সেখান থেকে সড়কপথে তিনি সােজা রওন দেন সাগরদিঘির উদ্দেশ্যে। সঙ্গে ছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসের জেলা সভাপতি সাংসদ আবু তাহের খান, জেলা সহ সভাপতি তথা মুখপাত্র অশােক দাস, জেলা পরিষদের সভাধিপতি মােশারফ হােসেন মণ্ডল, শ্ৰমপ্রতিমন্ত্রী জাকির হােসেন প্রমুখ। ততক্ষণে গ্রামে পৌঁছে গিয়েছেন কৃষ্ণনগরের সাংসদ তৃণমূল কংগ্রেসের মহুয়া মৈত্র, মুর্শিদাবাদের জেলাশাসক জগদীশপ্রসাদ মিনা, পুলিশ সুপার মুকেশ কুমার, স্থানীয় বিধায়ক সুব্রত সাহা প্রমুখ। শুভেন্দুবাবু পাঁচজনের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেন। প্রত্যেক পরিবারের হাতে পাঁচ লক্ষ টাকার চেক এবং আর্থিক অনুদান দেন। কথা বলেন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। তাদের পাশে থাকার আশ্বাস দেন। কথা বলেন আহত জহিরুদ্দিন সরকারের পরিবারের সঙ্গেও। তাদেরও আশ্বাস দেন।
গ্রামে দাঁড়িয়েই শুভেন্দু অধিকারী বলেন, আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বরাবরই এটা করে এসেছেন। এই সরকার অত্যন্ত মানবিক। মুখ্যমন্ত্রী যে যে নির্দেশ আমাদের দিয়েছেন, আমরা তা পালন করছি। প্রশাসন সেটা পালন করছে। সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণের চেক তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া তাদেরকে বিধবা ভাতা সহ যাদের যাদের কর্মসংস্থানের করে দেওয়ার সুযােগ রয়েছে, তাদের সেগুলাে করে দেব বলে কথা দিয়েছি। পরিবারের পাশে আমরা সবাই দাঁড়িয়েছি। মৃত্যুর কোন ক্ষতিপূরণ হয় না। তবুও আমাদের মুখ্যমন্ত্রী, সরকার এবং আমরা সবাই মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমাদের যা যা করণী, কর্তব্য এবং দায়িত্ব তা পালনের চেষ্টা করেছি। পরিবারগুলাে হতদরিদ্র। এই পরিবারগুলাের পাশে সকলেরই দাঁড়ানাে উচিত বলে আমরা মনে করি। জেলার সাংসদ এবং বিধায়করা তাদের এক মাসের মাইনের টাকা পরিবারগুলােকে দিয়েছে বলে এদিন মন্ত্রী জানান। সেই সঙ্গে তিনি এই ঘটনার তদন্তের দাবি করেন। ঘটনার আটচল্লিখ ঘন্টা পরেও কেন কেন্দ্রীয় সরকার এ বিষয়ে নীরব তা নিয়ে প্রশ্ন তােলেন।
এদিকে এদিন স্থানীয় দুটি মসজিদ কমিটির পক্ষ থেকে গ্রামের প্রতিটি বাড়ি থেকে একশাে করে টাকা এবং এক কেজি করে চাল তােলে। সেই টাকা এবং চাল দিয়ে প্রায় ৬ হাজার মানুষের দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করে তারা। সেই সঙ্গে সকালের টিফিনও দেয়। মসজিদ কমিটির সদস্য মুস্তাফিজুর রহমান, হায়দার আলি বলেন, সরকার মৃতদেহগুলি গ্রামে আনার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। আজ গ্রামে বহু মানুষ জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসছেন। মৃতদেহ পরিবার এবং আত্মীয়স্বজনরাও থাকবেন। তাদের মুখে ভাত, ডাল তুলে দেওয়ার জন্যই আমরা সবাই মিলে হাতে হাত লাগিয়ে এই খাবারের ব্যবস্থা করেছি। সকালে তিন হাজার মানুষকে টিফিন দিয়েছি। দুপুরে প্রায় ছয় হাজার মানুষকে ভাত, ডাল, তরকারি খাওয়ানাে হয়েছে।