মন্দির নগরী মল্লভূম

শঙ্খ অধিকারী, সাবড়াকোন
মল্লভূম বিষ্ণুপুরে ঘুরতে আসন নি, এমন কোন বাঙালি পাওয়া দুষ্কর৷ পর্যটকদের কাছে মন্দির নগরী নামে খ্যাত এই প্র চীন রাজ্যে উৎসব গুলির মধ্যে একটি হল, রথযাত্রা৷ এসময় পর্যটকের ভীড় খুব একটা না থাকলেও স্থানীয় মানুষেরা কাতারে কাতারে যোগ দেন এই উৎসবে৷ আজকের লেখায় থাকল, মল্লভূম বিষ্ণুপুরের শতাব্দী প্রাচীন এই রথযাত্রা সম্পর্কে কিছু তথ্য৷

রথের সময় এলেই একসময় বাঙলার আনাচে কানাচে ছোটছোট ছেলেমেয়েদের রথ নিয়ে যেমন উন্মাদনা দেখা যায়, তেমনি ভক্তপ্রাণ বাঙালির ঘরে ঘরে প্রভু জগন্নাথ দেবের রথের সমারোহ শুরু হয়ে যায়৷ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রথ অবশ্য উডি়ষ্যার পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে অনুষ্ঠিত হয়৷

তবে সারা ভারতবর্ষে বিশেষ করে আমাদের এই বাঙলায় প্রচুর ছোটো বড়ো রথের অনুষ্ঠান দেখতে পাওয়া যায়৷ এই সবকটি অনুষ্ঠান আমাদের শিল্পে, সাহিত্যেও স্থান পেয়েছে৷ বাংলার হুগলি জেলার মাহেশের রথ দেখতে গিয়ে পথ হারানো রাধারানীকে বঙ্কিমচন্দ্র সাহিত্যের এক স্থায়ী আসনে অধিষ্ঠিত করে গেছেন৷ এই রথকে ঘিরে জডি়য়ে আছে হাজারো আচার আচরণ এবং ধর্মীয় প্রতীক৷ প্রতিটি রথের নামকরণ থেকে, গঠন -সর্বত্র ছডি়য়ে আছে নানা ধর্মীয় উপাখ্যান৷ মূলত, বৈষ্ণব ধর্মের এই উৎসবের শতাব্দী প্রাচীন গৌরব লুকিয়ে আছে এই রথযাত্রার মধ্যে৷ রাঢ় ভূমির মল্লরাজাদের আমলেও সেসময় প্রচলিত হয় রথযাত্রা৷


মল্লরাজা বীর হাম্বীরের পর থেকে সমগ্র মল্লভূম বিষ্ণুপুর জুডে় শুরু হয় বৈষ্ণব ধর্মের প্লাবন৷ এই প্লাবনে ধীরে ধীরে ভেসে যেতে থাকে রাজ্যের প্রশাসন, এবং নিয়মকানুন৷ রাজধানীর চতুর্দিকে গঠিত হয় কৃষ্ণ আরাধনার মন্দির৷ সন্ধ্যায় রাজপথে বের হত নগর কীর্তন৷ একসময় এই সবকিছু রাজ্য শাসনের অঙ্গ হয়ে পডে়৷ এই পরিবর্তনের পর, শুরু হয় সমস্ত বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের উৎসবগুলি পালন করার রেওয়াজ৷ এই কাজে অগ্রণী ভূমিকা নেন রাজ্যের রাজা-রানী৷

জনশ্রুতি আছে, ১৬৬৫ খ্রীঃ বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজা বীর মল্ল বিষ্ণুপুর শহরের মাধবগঞ্জে রানি শিরোমণি দেবীর ইচ্ছা অনুযায়ী, পাথরের পাঁচ চূড়া মন্দির নির্মাণ করেন৷ মন্দিরের বিগ্রহ রাধা মদন গোপাল জিউ৷ এই মন্দিরের অনুকরণের তৈরি করা হয় পিতলের রথ৷ মল্লরাজাদের সময় থেকেই এই রথ উৎসবের সূচনা হয়৷

তবে এখানে একটি পাথরের রথের স্থাপত্যও পাওয়া যায়। এটি একটি উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য নিদর্শন হওয়া সত্ত্বেও বর্তমানে চূড়ান্ত অবহেলিত অবস্থায় রয়েছে৷ হিসেব করলে দেখা যায়, এই রথযাত্রা প্রায় সাডে় তিনশো বছরের পুরনো৷ বিষ্ণুপুরের এই রথকে ঘিরে স্থানীয় মানুষের উন্মাদনা থাকে তুঙ্গে৷ করোনার সময়ে এই প্রাচীন রথ বন্ধ থাকার পর আবার নতুন উদ্যমে এই রথযাত্রায় মানুষের উন্মাদনা চোখে পড়ছে৷ তবে পুরীর জগন্নাথ দেবের রথের মতো, এই রথে জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা বিরাজ করেন না, পরিবর্তে থাকেন, রাধা মদন মোহন জিউ৷ শোনা যায়, অতীতে একাধিক মন্দির থেকে এই রথ বের হতো। কিন্ত্ত বর্তমানে, আইনশৃঙ্খলার কথা মাথায় রেখে পুরো উৎসবটি পরিকল্পনা মাফিক ও সাজানো গোছানোভাবে করা হয়৷