রাজ্যের স্বাস্থ্য এখন স্থিতিশীল

নবান্নে জুনিয়ার ডাক্তারদের সঙ্গে আলচনায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। (Photo: IANS)

জুনিয়র ডাক্তারদের বিভিন্ন দাবি সহানুভূতির সঙ্গেই মেনে নিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর তার জেরেই সাতদিন পরে শেষ হল সরকারি হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজে জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মবিরতি। হাসপাতালে জুনিয়র ডাক্তারদের নিরাপত্তা প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দাওয়াই কিছু না ঘটুক, সেটা দেখতে হবে। কিন্তু কিছু হলে নেওয়া হবে কড়া ব্যবস্থা। মূলত এই আশ্বাসেই জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন উঠে গেল। স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিষেবায়।

সােমবারের বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, প্রতিটি হাসপাতালে এমার্জেন্সির সামনে বড় গেট লাগানাে হবে। অসুস্থ মানুষের পরিবারের দু’জনের বেশি কাউকে এমার্জেন্সির ভেতরে যেতে দেওয়া হবে না। এনআরএস-এর ঘটনায় সেদিন পুলিশের ভূমিকায় ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী। ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনা ঘটলে কর্তব্যরত পুলিশকে সাসপেন্ড করা হবে বলেও জানিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই সঙ্গে হাসপাতালে ডাক্তারদের নিরাপত্তা বাড়ানাের জন্য পুলিশের সংখ্যা ও সক্রিয়তা বাড়ানাের জন্য রাজ্য পুলিশের ডিজি বীরেন্দ্র, নগরপাল অনুজ শর্মাকে নির্দেশ দেন।

হাসপাতালে কোনও ডাক্তারের নিরাপত্তার অভাব ঘটলে অ্যালার্মের মাধ্যমে তা কর্তব্যরত পুলিশকে জানানাে যাবে। গোটা রাজ্যের জন্য একটি জরুরিভিত্তিক নম্বর এবং ইমেল আইডি চালু করার কথাও বলেন মুখ্যমন্ত্রী। এছাড়া প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে ফিয়ার গ্রিভান্স সেল তৈরি করা হবে। যেখানে পুলিশের পক্ষ থেকে তিন শিফটে নােডাল অফিসার রাখা হবে। কোনও অপ্রীতিকর ব্যবস্থা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এই বিষয়ে জিরাে টলারেন্স নীতি মেনে চলা হবে। তবে সাধারণ মানুষকেও এই বিষয়ে সচেতন করা হবে, যাতে ডাক্তারদের ওপর কেউ হামলা না করে। হাসপাতালে কোনও মৃত্যুর অন্তিম ঘটনা ঘটলে তৃতীয় কোনও ব্যক্তি এসে সেই সংবাদ দিতে পারেন।


জুনিয়র ডাক্তারদের কথার উত্তরে মুখ্যমন্ত্রী স্বীকার করে নেন রােগী কল্যাণ সমিতি থাকলেও তারা অনেক জায়গাতেই নিষ্ক্রিয়। সেখানে জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করা দাবিও মেনে নেন মমতা। এছাড়া যে সমস্ত প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ হয়েছে, সেখানে কী অগ্রগতি হয়েছে তা যাচাই করে দেখার জন্যও নির্দেশ দেন মমতা। এছাড়া রােগীদের আত্মীয়দের অভিযােগ নেওয়ার জন্য গ্রিভান্স সেল রয়েছে সেগুলিকে আরও সক্রিয় এবং সকলের নজরে আনার জন্য নির্দেশ দেন মমতা।

মূলত জুনিয়র ডাক্তারদের দাবিগুলির প্রতি সহমর্মিতা দেখিয়েই এদিন আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটায়। এই আন্দোলন সামলে ফের মমতা প্রমাণ করে দিলেন, যে কোনও আন্দোলনের রাশ তিনিই ধরতে পারেন।

মুখ্যমন্ত্রী বনাম জুনিয়র ডাক্তারদের যে বৈঠক নিয়ে গত সাতদিন ধরে টানাপােড়েন চলছিল, সােমবার নবান্নে মুখােমুখি বৈঠকে তা শেষ হল দু’পক্ষের আন্তরিক টানে। নবান্নে জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে দীর্ঘ আলােচনার পর মুখ্যমন্ত্রীর আর্জি ‘লক্ষ্মী ছেলেরা, ছােট ভাইবােনেরা, প্লিজ এবার কাজে যােগ দাও’। নবান্নে মমতার এই  স্নেহসম্ভাষের সুর দিনের শেষে ছড়িয়ে গেল এনআরএসেও। বদলে দিল আন্দোলনকারীদের স্লোগান। তবে শুধু স্নেহসম্ভাষই নয়, এদিনের বৈঠকে সরকারি হাসপাতালের জুনিয়র ডাক্তারদের নিরাপত্তার জন্য মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাস শুনেও জুনিয়র ডাক্তাররা হাততালি দিয়ে ওঠেন উল্লাসে।

আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেওয়ার পর জুনিয়র ডাক্তারদের সনির্বন্ধ অনুরােধ মতাে এদিন এনআরএস কাণ্ডে আহত ডাক্তার পরিবহ মুখােপাধ্যায়কে দিনের শেষে দেখতেও যান মুখ্যমন্ত্রী। স্নেহ আর সমীহে বিনিময়ে শেষ হওয়া এই আন্দোলন দেখে বােঝার উপায় ছিল না ক’দিন এই নিয়ে রাজ্যের উত্তাল অবস্থা। তবে নবান্নের বৈঠকের পর কর্মবিরতি উঠে যাওয়ার পর রাজনৈতিক বিরােধ সরিয়ে রেখেই অভিনন্দন জানিয়েছেন বিজেপির মুকুল রায় এবং রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী।

যদিও এদিনের বৈঠকে রাজ্যে ডাক্তারি পরিষেবার ফাঁকফোকরটুকু তুলে ধরতে ভােলেননি জুনিয়র ডাক্তাররা।

এদিনের আলােচনার বৃত্তের কেন্দ্রবিন্দুতে এনআরএস থাকলেও কথােপকথনের সূত্র ধরে তার পরিধি ছড়িয়ে রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিষেবায় মুখ্যমন্ত্রীও জুনিয়র ডাক্তারদের বক্তব্যকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে শুনে, তার ভিত্তিতে বেশকিছু নির্দেশ দেন সংশ্লিষ্ট দফতরের আধিকারিকদের। সোমবার নবান্নে এই বৈঠক নিয়ে দিনভর উত্তেজনা বজায় ছিল নবান্নে। দুপুর তিনটের সময় বৈঠকে জুনিয়র ডাক্তাররা উপস্থিত হওয়া নিয়ে দোলাচল ছিল। শেষ পর্যন্ত টেলিভিশন, সােস্যাল মিডিয়ার গােটা বৈঠক লাইভ টেলিকাস্ট করতে সম্মত হন। সরকারের পাঠানাে গাড়ি ও কনভয়ে করে জুনিয়র ডাক্তারদের নিয়ে আসেন নবান্নে । রাজ্যের ১৪ টি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল থেকে মােট ২৮ জন প্রতিনিধির পরেও আরও ২ জন প্রতিনিধিকে বৈঠকে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়।

দুপুর তিনটেয় প্রস্তাবিত বৈঠকের কিছু আগেই সুকুমার মুখােপাধ্যায়, অভিজিৎ চৌধুরীর মতাে সিনিয়র ডাক্তাররা নবান্নে উপস্থিত হন। সাড়ে তিনটে নাগাদ জুনিয়র ডাক্তারদের তিরিশজনের দলকে চোদ্দ তলায় নিয়ে যাওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত বিকেল চারটে নাগাদ বৈঠক শুরু হয়। মুখ্যমন্ত্রীর কাছে বারাে দফা দাবি পেশ করেন জুনিয়র ডাক্তাররা। দু’পক্ষই এদিন যথেষ্ট নমনীয় ছিল বৈঠকে।

প্রথমেই নবান্নে আসার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে আধিকারিদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। এরপর মমতার অভয়বাণী, যা বলবার নির্ভয়ে, নির্দ্বিধায় বল। মেডিকেল কলেজের প্রতিনিধি অর্চিষ্মন ভট্টাচার্য বলেন, আমাদের ভয়ের মধ্যে কাজ করতে হয়। তাই বাধ্য হয়ে আন্দোলনে নেমেছি। আপনার কাছে আমাদের বার্তা পৌঁছতে চেয়েছিলাম। হয়তাে পৌঁছয়নি। আমরা খুব তাড়াতাড়ি কাজে ফিরতে চাই। এই অচলাবস্থা চলুক আমরা কেউই চাই না।

কথার ফাঁকে এক জুনিয়র ডাক্তার অনুযােগও পেশ করেন। যদি আপনি এনআরএস-এ পা রাখতেন তাহলে হয়তাে আন্দোলন এতদূর গড়াতাে না। মুখ্যমন্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে নরম সুরে পাল্টা অভিযােগ ছুঁড়ে দেন। যেদিন ঘটনা ঘটে, সেদিনই তাে তৎক্ষণাৎ স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যকে এনআরএসে পাঠিয়েছিলাম ফোনে তােমাদের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তােমরা তাতে রাজি হওনি। তখন আমি ভাবলাম তােমারা আমাকে চাও না। তাই আমি নিজে না গেলেও কলকাতার নগরপাল, স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিকর্তাকে পাঠিয়েছিলাম। আর আমি কখন কোথায়ও যাব না যাব সেটা না হয় আমার ওপরই ছেড়ে দাও।

আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারদের পক্ষ থেকে অনুরােধ আসে, আপনি একবার সময় করে আহত ডাক্তার পরিবহকে একবার দেখতে যান। মুখ্যমন্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে হাসিমুখেই শর্ত দেন। তােমাদের জন্যই তাে যেতে পারিনি। তােমরা আন্দোলন তুলে নাও, তাহলেই আমি পরিবহকে দেখতে যেতে পারি। তােমাদের জন্যই তাে যেতে পারছি না। তবে নিজে না গেলেও যে বেসরকারি হাসপাতালে পরিবহর চিকিৎসা হচ্ছে সেদিন থেকে প্রতিদিন খবর রেখেছে রাজ্য সরকার।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে এদিন একরকম নতিস্বীকারই করে নিলেন পেশাদার ডাক্তাররা। তবে এরই ফাঁকে জুনিয়র ডাক্তাররা স্বাস্থ্য পরিকাঠামাে উন্নয়নে এবং জুনিয়র ডাক্তারদের নিরাপত্তা সংক্রান্ত একাধিক দাবি বিনীতভাবে পেশ করেন। প্রত্যেকটি দাবিই মেনে নেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এবং সিদ্ধান্তগুলি কার্যকর করতে নির্দেশ দেন আধিকারিকদের।

৭ দিন জুনিয়র ডাক্তাররা সরকারি হাসপাতালে কর্মবিরতি নিয়ে রফা করতে এলেও রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিষেবার ত্রুটিগুলিও তুলে ধরেন। কল্যাণী হাসপাতালে গেট নেই। মুর্শিদাবাদ কলেজ হাসপাতালের এক জুনিয়র ডাক্তার বলেন। সেখানে বিভিন্ন যন্ত্রপাতির অভাব রয়েছে। কোথাও আবার এক বেডে পাঁচজন রােগীকে রাখতে হচ্ছে। উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজের প্রতিনিধি বলেন, সেখানে সিটি স্ক্যান মেশিন নেই। কেউ আবার অভিযােগ করেন, হাসপাতালে রক্ষীদের স্থানীয় অঞ্চল থেকে নেওয়া হয়। ফলে তারা হামলাকারীদের উপযুক্ত শাস্তি দেন না। কেউ আবার বলেন, হাসপাতালে অনেক সময় স্থানীয় নেতারাই হুমকি দিতে আসেন। অনেকেরই অভিযােগ, হাসপাতালে উপযুক্ত পরিষেবা দেওয়ার মতাে পর্যাপ্ত পরিমাণে ডাক্তারের অভাব রয়েছে। ডেন্টাল কলেজের প্রতিনিধিরাও তাদের অভাব অভিযােগের কথা পেশ করেন।

মুখ্যমন্ত্রী প্রতিটি অভিযােগই সহমর্মিতার সঙ্গে শােনেন। স্বাস্থ্য দফতরের প্রধান সচিবকে বলেন, কত মেশিন কেনা হয়ে পড়ে আছে ব্যবহার হয় না। এরপর জং ধরে নষ্ট হয়ে যাবে। এরপর মুখ্যমন্ত্রী বলেন, বাম আমলের শেষে ৬৯০ কোটি স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ ছিল। সেটা গত বছর পর্যন্ত বেড়ে হয়েছে ৯৬০০ কোটি টাকা। রাজ্যে স্বাস্থ্য পরিষেবার উন্নতি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে অনেক সময়ই কিছু ত্রুটি থেকে যাচ্ছে। তবে সবার চেষ্টাতেই এইসব সমস্যা কাটিয়ে তােলা সম্ভব হবে। এদিনের বৈঠক শেষ হয় মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি অভিবাদনের হাততালিতে।