গত কয়েকদিন ধরে ভারী বৃষ্টির জেরে জলমগ্ন হয়ে পড়েছে রাজ্যের একাধিক জেলার বিভিন্ন অঞ্চল। এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের জেরে একাধিক সেতু, নদীবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিচ্ছিন্ন হয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। জলমগ্ন হয়েছে একাধিক এলাকার বিস্তীর্ণ কৃষি জমি। ফসল নষ্ট হয়ে কৃষকরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাশাপাশি লোকালয় জলমগ্ন হওয়ার ফলে মানুষের স্বাভাবিক জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে একাধিক বাড়ি-ঘর। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে বহু কাঁচা বাড়ি ভেঙে গিয়ে মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে।
ইতিমধ্যে কয়েকদিন ধরে ভারী বৃষ্টির জেরে ব্যারেজগুলিতেও জলের চাপ বেড়েছে। দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলেও মুষলধারে বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে। যার জেরে দুর্গাপুর ব্যারেজেও জলের চাপ বেড়েছে। বাধ্য হয়ে জল ছাড়তে হয়েছে এই বাঁধ থেকে। এই মুহূর্তে দুর্গাপুর ব্যারেজ থেকে ৮০ হাজার ৩৫০ কিউসেক হারে জল ছাড়া হচ্ছে। যদিও সকাল ছ’টার সময় থেকে ৮৫ হাজার কিউসেক হারে জল ছাড়া হচ্ছিল। এখন সেই জল ছাড়ার পরিমাণ কিছুটা কমানো হয়েছে। এদিকে ঝাড়খণ্ডেও বৃষ্টিপাত হচ্ছে ব্যাপকভাবে। সেখানেও উদ্বেগ বেড়েছে। যার ফলে দুর্গাপুর ব্যারেজের মতো এখানেও একাধিক জলাধার থেকে জল ছাড়া হয়েছে। এখনও মাইথন, পাঞ্চেত দুটি জলধার থেকে মোট ২৬ হাজার কিউসেক হারে জল ছাড়ার খবর পাওয়া গিয়েছে। এইসব বাঁধগুলিতে প্রচুর পরিমাণে পরিমাণ জল ঢুকছে। ফলে জল ছাড়ার পরিমাণ আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মুকুটমণিপুর জলাধার থেকেও প্রায় ২০ হাজার কিউসেক জল ছাড়া হয়েছে। যেহেতু একটানা বৃষ্টি হচ্ছে, সেজন্য সেচ দপ্তরের আধিকারিকরা জানিয়েছেন, জল ছাড়ার পরিমাণ আরও বৃদ্ধি করা হতে পারে।
বৃষ্টির জলের পাশাপাশি জলাধার থেকে জল ছাড়ার ফলে এরাজ্যের একাধিক জেলাতে নদীর জলের চাপ বাড়ছে। ফলে প্লাবিত হচ্ছে একাধিক জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর, পশ্চিম বর্ধমান, বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া জেলা।
পশ্চিম বর্ধমানের আসানসোলের বারাবনির রানীগঞ্জ এলাকায় অতিবৃষ্টিতে গোয়াল ঘরের দেওয়াল ভেঙে মৃত্যু হয়েছে এক ব্যক্তির। মৃতের নাম অশোক বন্দ্যোপাধ্যায় (৫০)। এই ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে গবাদি পশুরও। জানা গিয়েছে, জরাজীর্ণ গোয়াল ঘরে গরু বাঁধা ছিল। দেয়ালগুলি পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আগে থেকেই আঁচ করতে পেরেছিলেন অশোকবাবু। সেজন্য গরুগুলিকে গোয়ালঘর থেকে বাইরে বের করে আনতে গিয়েছিলেন। সেসময়ই এই দুর্ঘটনা ঘটে। আচমকা দেওয়া চাপা পড়ে মৃত্যু হয় অশোকবাবুর। আসানসোলে প্লাবিত হয়েছে একাধিক এলাকা। মূলত এখানকার গাড়ুই নদীর জলস্তর বাড়তেই লোকালয়ে জল ঢুকতে শুরু করেছে। যার জেরে আসানসোল রেলপাড়া এলাকায় যথেষ্ট উদ্বেগ বেড়েছে। বালু ময়দান এলাকায় একাধিক বাড়িতে ঢুকছে গাড়ুই নদীর জল। ফের ডুবে গেল আসানসোলের ইকড়া মহাশ্মশান ঘাট। এই ইকড়া গ্রামের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থাও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে ইকড়া স্টেশন থেকে সার্থকপুর, বালানপুর, চন্ডীপুর, মিঠাপুর, রানীগঞ্জ যাওয়ার মূল রাস্তা। এখানকার কয়েক হাজার কারখানায় শ্রমিকরা যাতায়াত করতে পারছেন না। আউশগ্রামের ভেদিয়াতেও জল জমছে, দাঁইহাট শহরেও একাধিক বাড়িতে জল ঢুকে গিয়েছে বলে খবর পাওয়া গিয়েছে।
বৃষ্টির জেরে রাস্তায় ধস নেমেছে মুর্শিদাবাদে। গত তিনদিন ধরে এক নাগাড়ে বৃষ্টি হচ্ছে। যার জেরে বাবলা নদীর ধারে একটি রাস্তায় ধস নেমেছে। ঘটনাস্থল শক্তিপুর থানার কামনগর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকা। নগরগ্রাম থেকে সাহাবাড়ি যাওয়ার রাস্তাটি ভেঙে গিয়েছে। সমস্যায় পড়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
বৃষ্টির জলের চাপে ফুলে ফেঁপে প্লাবিত হয়েছে কোপাই নদী। যার ফলে জলমগ্ন হয়ে পড়েছে গোয়ালপাড়া ব্রিজ। এই ব্রিজটি বোলপুর ও সিউড়ির মধ্যে সংযোগ রক্ষা করে। জলমগ্ন হওয়ার ফলে যোগাযোগ কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। কুয়ে নদীর জল বিপদ সীমার উপর দিয়ে বইছে। যার জেরে জলমগ্ন হয়েছে কঙ্কালীতলা। প্রায় চার ফুট জলের তলায় মন্দির প্রাঙ্গণ। ফলে এই সতীপীঠে এখন পুজো বন্ধ হয়ে গিয়েছে। দ্বারকা নদী ছাপিয়ে দুই কূলে জল উপচে পড়ছে। যার জেরে তারাপীঠের একাধিক লজের নিচের তলায় জল ঢুকে গিয়েছে। সমস্যায় পড়েছেন পর্যটক ও পুণ্যার্থীরা। জলমগ্ন হয়েছে তারাপীঠ মহা শ্মশান সহ বিস্তীর্ণ এলাকা। শ্মশানের ইলেকট্রিক চুল্লির ট্রান্সফরমার জলের তলায় ডুবে গিয়েছে। বন্ধ হয়েছে শব দাহ প্রক্রিয়া। পাশাপাশি এখানকার বিস্তীর্ণ এলাকায় কৃষিজমি জলমগ্ন হয়েছে। বহু কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
একই অবস্থা পশ্চিম মেদিনীপুরেও। জলমগ্ন কেশপুরের পঞ্চমী এলাকা। ভেঙেছে কংসাবতী নদীর উপরের বাঁশের সাঁকোও। কংসাবতী নদীর জলস্তর বেড়ে বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যার জেরে এই বাঁশের সাঁকোটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যেটি ময়না থানার প্রজাবাড়ে অবস্থিত। এটি পাঁশকুড়া ও ময়না এলাকার মধ্যে সংযোগ রক্ষা করে। বেলদাতে জলমগ্ন হয়েছে বাজার। জলমগ্ন এখানকার ডেলি মার্কেট। ক্রেতাদের জলের মধ্যে হেঁটেই বাজার করতে হচ্ছে। এছাড়া দাঁতনে প্রাচীন কালীচণ্ডী মন্দিরের গর্ভ গৃহ জলমগ্ন হয়েছে।
এদিকে পুরুলিয়া জেলাতেও অতি বৃষ্টির প্রভাব পড়েছে। এখানকার রঘুনাথপুর ২ নম্বর ব্লকে একটি মাটির বাড়ি ভেঙে পড়েছে। বাড়িটি বামড়রা গ্রামে অবস্থিত। ঘটনার পর ওই পরিবারের সদস্যরা স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। ঘটনায় হতাহতের কোনও ঘটনা ঘটেনি। এছাড়া বাঁকুড়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। বহু বাড়িতে ঢুকে পড়েছে প্লাবনের জল।