১৬২ দিন বিচার পেল তিলোত্তমা। আরজি কর মামলার দোষী সাব্যস্ত সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়। শনিবার শিয়ালদহ আদালতের বিচারক অনির্বাণ দাস ওই রায় ঘোষণা করেন। ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ৬৪ (ধর্ষণ), ৬৬ (ধর্ষণের পর মৃত্যু) এবং ১০৩ (১) (খুন) ধারায় দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে সঞ্জয়কে। আরজি কর কাণ্ডে একমাত্র অভিযুক্ত হিসাবে সঞ্জয়ের নাম করেছিল সিবিআই।
মোবাইল টাওয়ার, ঘটনাস্থল থেকে প্রাপ্ত প্রমাণের ভিত্তিতে সঞ্জয়কে শনিবার দোষী সাব্যস্ত করেছে আদালত। যদিও এদিনও সঞ্জয় রায় নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করেছে। তার বক্তব্য, এই কাজ একার পক্ষে করার সম্ভব নয়। কিন্তু বিচারক জানিয়েছেন, সঞ্জয়ের বিরুদ্ধে সব অভিযোগের প্রমাণ রয়েছে। শনিবার নির্যাতিতার পরিবারের ৫ সদস্য আদালত কক্ষে উপস্থিত ছিলেন। তবে সাধারণ মানুষকে আদালত কক্ষে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।
বিচারক অনির্বাণ দাস বলেন, আগামী সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টায় সাজা ঘোষণা করবে আদালত। আরজি করের চিকিৎসকের ধর্ষণ এবং খুন মামলায় বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয় গত বছরের ১১ নভেম্বর। সেই হিসেবে ৫৯ দিনের মাথায় ঘটনার বিচারপর্ব শুরু হয়। ১৬২ দিনের মাথায় রায় ঘোষণা করল আদালত। আর ১৬৪ দিনের মাথায় সাজা ঘোষণা করা হবে।
শনিবার মাত্র ১২ মিনিটেই রায় ঘোষণা শেষ হয়েছে। রায় শুনে আদালতের ভিতরেই চিৎকার করতে শুরু করেন সঞ্জয়। বিচারক অনির্বাণ দাস সঞ্জয়কে বলেন, সিবিআই এবং সাক্ষীদের বয়ানের ভিত্তিতে যা মনে হয়েছে, তাতে দোষী সাব্যস্ত করব আপনাকে। আপনার সর্বোচ্চ শাস্তি হতে পারে মৃত্যুদণ্ড। আর সর্বনিম্ন শাস্তি হতে পারে যাবজ্জীবন কারাদন্ড। বিচারকের এই মন্তব্য শুনে সঞ্জয় বলেন, আমি কিছু করিনি। আমার গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। আমার কথাটা এক বার শুনুন। বিচারক বলেন, আপনার এবং আপনার আইনজীবীর কথা সোমবার শুনব।
সূত্রের খবর, শনিবার রায় ঘোষণার পর আদালতে হাত জোড় করে ‘স্যার স্যার’ বলে চিৎকার করতে থাকেন সঞ্জয়। সে বলে, আপনি তো দোষী সাব্যস্ত করে দিলেন। আমি গরিব। আমি এই কাজ করিনি। যারা করেছে, তাদের কেন ছাড়া হচ্ছে? এই মন্তব্যের পর অবশ্য আদালত থেকে একপ্রকার জোর করেই বার করে নিয়ে যাওয়া হয় সঞ্জয়কে।
শনিবার রায় ঘোষণার পর কাঁদতে কাঁদতেই বিচারককে ধন্যবাদ জানান নির্যাতিতার বাবা। নির্যাতিতার বাবা বলেন, আপনার উপর যে আস্থা রেখেছিলাম, তার পূর্ণ মর্যাদা রেখেছেন। আপনাকে ধন্যবাদ দিতে চাই। একথা শুনে বিচারক নির্যাতিতার বাবাকে জানান, তাঁদের কথা সোমবার শুনবেন। একই সঙ্গে ওইদিন সাজাও ঘোষণা করবেন তিনি।
গত বছরের ৯ অগস্ট আরজি করের সেমিনার হল থেকে তিলোত্তমার দেহ উদ্ধার হয়। অভিযোগ ওঠে, তাঁকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়কে গ্রেপ্তার করে কলকাতা পুলিশ। এরপর কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে এই মামলার তদন্তভার হাতে নেয় সিবিআই। শিয়ালদহ কোর্টে সঞ্জয়ের বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা দেয় সিবিআই।
আন্দোলনকারী জুনিয়র চিকিৎসকদের সংগঠন ‘জুনিয়র ডক্টরস ফ্রন্ট’-এর অন্যতম মুখ অনিকেত মাহাতো বলেন, এখনও অনেকে জড়িত। কারণ সিএফএসএল রিপোর্টে একাধিক ব্যক্তির দ্বারা এই কাণ্ড ঘটানোর কথা বলা হয়েছিল। কেন তাঁরা গ্রেপ্তার নন? এ কেমন বিচার? বৃহত্তর ষড়যন্ত্র ছিল। একাধিক প্রশ্ন রয়েই গেল।
রায় ঘোষণার পর কলকাতা পুলিশের ভূয়সী প্রশংসা করেন তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ। তিনি বলেন, পুলিশ সব শক্তি দিয়ে তদন্ত করছিল। সেখানেই সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে কিছু বাম, কিছু অতিবাম, কিছু অন্ধ তৃণমূল বিরোধী, একাংশের চিকিৎসক যেভাবে মানুষের আবেগকে বিপথে চালিত করছিলেন তাতে আজকের রায় প্রমাণ করল কলকাতা পুলিশের তদন্ত সঠিক পথে ছিল। মাঝপথে সিবিআইকে তদন্তভার দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাতেও কলকাতা পুলিশের তদন্ত মান্যতা পেয়েছে।
এই ঘটনার সঙ্গে সঞ্জয় একা জড়িত নয় বলে দাবি করেছেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। তিনি বলেন, শুরুটা ভালোই হলো। এ সব ক্ষেত্রে ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট হয়ে থাকে। তবে এটা আংশিক। বিচার প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করতে হবে। এই ঘটনায় সঞ্জয় রায় একা নয়, একাধিক ব্যক্তি জড়িত।
সিপিএম নেত্রী বৃন্দা কারাট বলেন, সঞ্জয় রায় দোষী, এটা কারোরই অজানা নয়। কিন্তু তার পিছনে কোন শক্তি কাজ করেছে?…এই ঘটনা ঘটেছে একটা দুর্নীতিতে ভরা প্রশাসনের জন্য। সরকার, আরজি করের প্রিন্সিপাল এবং গোটা প্রশাসন দায়ী এই ঘটনার জন্য। রায় ঘোষণার পর সিপিএমের অফিসিয়াল ফেসবুক হ্যান্ডেল থেকে প্রকাশিত একটি পোস্টে লেখা হয়েছে, দোষীদের প্রত্যেকের শাস্তি চাই।
শিয়ালদহ আদালতের বিচারক সঞ্জয় রায়কে দোষী সাব্যস্ত করার পরই কান্নায় ভেঙে পড়েন তার এক দিদি। কাঁদতে কাঁদতেই তিনি জানান, আদালত যা নির্দেশ দেবে, তা তাঁরা মেনে নেবেন। তাঁর বিয়ের পর ভাইয়ের সঙ্গে বিশেষ যোগাযোগ ছিল না। তাঁর ভাই যে এমন নৃশংস কাজ করতে পারেন, তা যেন এখনও ভাবতেও পারছেন না সঞ্জয়ের ওই দিদি।