মমতার পুজোর লেখায় আরজি করের যন্ত্রণা আমার হৃদয়কে ছারখার করে দিয়েছে

আরজি করের ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছে সমাজের ভিত। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুজো সংখ্যার লেখাতেও আরজি করের ঘটনার যন্ত্রণার কথা উঠে এসেছে। শাসকদলের মুখপত্র ‘জাগো বাংলা’র শারদীয় সংখ্যায় কলম ধরেছেন মুখ্যমন্ত্রী। সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন, নারী সুরক্ষার স্বার্থেই কেন্দ্রীয় আইন সংশোধন করে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় ‘অপরাজিতা’ নামে যে আইন তৈরি করা হয়েছে, তা মেয়েদের সম্মান ও অধিকার রক্ষার লড়াইয়ের ক্ষেত্রে একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। এখানেই থেমে না থেকে মমতা জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীকে তিনি দু-দু’বার চিঠি দিয়েছিলেন, কেন্দ্র এমন আইন করুক, যাতে দেশের মেয়েরা সুফল পান। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী চিঠির উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি।

এমনকি, ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও, প্রধানমন্ত্রীকে ফোনে পাওয়া যায়নি। এটাই স্বাভাবিক। কারণ প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে পদক্ষেপ না করে তাঁর কাজ করেছেন বলে মনে করেন মমতা। আরজি কর হাসপাতালের মর্মান্তিক ঘটনায় তাঁর হৃদয় জ্বলে ছারখার হয়ে গিয়েছে। এমনই যন্ত্রণার কথা মুখ্যমন্ত্রী তুলে ধরেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘মনে হচ্ছিল আমার পরিবারের কেউ যেন চলে গেল। কোনও মানুষই এটা মেনে নিতে পারবেন না। আমারও বাড়িতে মেয়ে আছে, আমিও একজন অভিভাবিকা। আমি বুঝি যন্ত্রণা কোথায় বিদ্ধ করে, কেন শাস্তির দাবিতে মানুষ উদ্যত হয়।’

সারা দেশজুড়ে নারী নির্যাতনের প্রতিবাদে রীতিমতো সরব হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর লেখায় উঠে এসেছে ২০১৭ সালের উত্তরপ্রদেশের উন্নাওয়ের বিজেপি বিধায়কের এক নাবালিকাকে  ধর্ষণের কথা। ধর্ষক বিজেপি বিধায়ক ধর্ষিতা মেয়ের বাবাকে বন্দি অবস্থায় হত্যা করে, সেই নৃশংসতাও তাঁর লেখায় উঠে এসেছে। ২০২০ সালে র সেপ্টেম্বর মাসে উত্তরপ্রদেশের হাথরসে দলিত মেয়েকে গণধর্ষণ করা হয়। সেও বাঁচেনি। ঘটনার ভয়াবহতাকে সামনে রেখে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে নারীরা যে সুরক্ষিত নন, তাও বলতে চেয়েছেন মমতা।


‘ক্রাইম ইন ইন্ডিয়া-২০২২’-এর তথ্য বলছে, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ধর্ষণের ঘটনায় গড়ে ৭৬ শতাংশ ক্ষেত্রে পুলিশ তদন্ত শেষ করে  চার্জশিট জমা দিতে পেরেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও সত্যি, মাত্র ২.৫৬ শতাংশ ক্ষেত্রে অপরাধী দোষী সাব্যস্ত হয়েছে। এই পরিসংখ্যান লজ্জার। এমনটাই বলেছেন মমতা। কেন পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় তিনি আইন তৈরি করলেন, তার সপক্ষে মমতার যুক্তি, বর্ধিত শাস্তি, দ্রুত তদন্ত, দ্রুত ন্যায়বিচার। এর জন্য তিনি অনেক আগে থেকেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার তাঁর পরামর্শ উপেক্ষা করে। নির্মম ধর্ষকের এই সমাজে বেঁচে থাকার কোনও অধিকার নেই। মমতার লেখনী এমনটাই বলছে। কামদুনির ঘটনায় দোষীদের ফাঁসি চেয়েছিলেন তিনি। আরজি করের ক্ষেত্রেও প্রথম থেকেই ফাঁসির দাবিতে সওয়াল করছেন তিনি। মহারাষ্ট্রের নির্যাতিতা শিশু থেকে শুরু করে উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, মণিপুর, অসম, উত্তরাখণ্ড, যেখানে যত এমন ঘটনা ঘটেছে, সেইসব অপরাধীদের ফাঁসি হওয়া উচিত, যাতে ভবিষ্যতে কেউ যেন এই ধরনের কাজের সাহস না পায়। লেখার মাধ্যমে এই বার্তাই দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী।

কোনও নৃশংস, ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটলে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ তার অভিঘাতে সংবেদনশীল হবেন, প্রতিবাদে মুখর হবেন, এটাই স্বাভাবিক। সুস্থ গণতন্ত্রে এটাই কাম্য। একথা উল্লেখ করে মমতা লিখেছেন, ‘আন্দোলনে আমার জন্ম। তাই এটা বুঝতে আমার অসুবিধা হয় না। তবে, কিছু কিছু মানুষ তা সমাজের যত ছোট অংশই হোক না কেন, প্রতিটি ঘটনায় রাজনীতি খোঁজেন এবং রাজনীতির রং দিয়ে অমানবিক ঘটনাকে বিকৃতভাবে পল্লবিত এবং কুসুমিত করে তোলেন— এটা আমি মানতে পারি না।’ এই ধরনের ঘটনা রাজ্যে ঘটলে তাকে অতিরঞ্জিত করে সংবাদ পরিবেশন করা এদের কাজ হয়ে ওঠে। এরা ভুলে যায় রাজনীতির আগে মানুষ।

প্রধানমন্ত্রীর লোকসভা কেন্দ্র বারাণসীতে  আইআইটি-বিএইচইউ (বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের) ছাত্রীকে গণধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত বিজেপি আইটি সেলের দুই সদস্যকে গ্রেপ্তারের সাত মাসের মধ্যে জামিনের বন্দোবস্ত করে দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, জেল থেকে বেরোনোর পর তাদের ফুল-মালা দিয়ে স্বাগত জানানো হয়। বিলকিসের ধর্ষকদেরও জেল থেকে ছেড়ে দিয়ে মালা পরানো হয়, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজাপ্রাপ্ত ধর্ষণকারী বিজেপি নেতাকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হয়। মণিপুরের বর্বরতা হার মানায় মধ্যযুগের বর্বরতাকেও। পুজোর সংখ্যার লেখাতে বিগত বাম সরকারের আমলের বিভিন্ন ঘটনার উল্লেখ করেছেন মমতা। এর মধ্যে রয়েছে কোচবিহারের নার্স বর্ণালী দত্তকে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনা, বানতলায় অনিতা দেওয়ানকে ধর্ষণ করে খুন করার কথা, এর পাশাপাশি সিঙ্গুরের তাপসী মালিক এবং নন্দীগ্রামে মেয়েদের উপর নৃশংস অত্যাচারের ঘটনা। ফুলবাগান, বিরাটি, আমতা-কেন্দুয়ার সঙ্গে নদিয়ার মূকবধির মেয়ে ফেলানি বসাকের জন্য বিচার চাইতে গেলে তাঁকে কীভাবে রাইটার্স থেকে পুলিশ মেরে বের করে দিয়েছিল, তাও বিশেষভাবে তুলে ধরেছেন মমতা । নারীসুরক্ষায়  তাঁর সরকারের সময় ৪৮টি মহিলা থানা, বিচার ব্যবস্থায় গতি আনতে ৮৮টি ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট, ৬২টি পিওসিএসও ডেজিগনেটেড কোর্ট এবং ৬টি ই-পিওসিএসও কোর্ট করা হয়েছে। আরও পাঁচটি এক্সস্লুসিভ পিওসিএসও কোর্ট করা হচ্ছে। এর মধ্যে মহিলাদের জন্য যে ৫২টি ডেসিগনেটেড কোর্ট রয়েছে, তাতে মহিলাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত অপরাধের মামলাগুলির দ্রুত বিচার করা হয়, যাতে মহিলারা দ্রুত বিচার পান।

মহিলাদের উপর নির্যাতন ও অপরাধে শীর্ষে রয়েছে বিজেপির মডেল রাজ্য উত্তরপ্রদেশ। রীতিমতো কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান তুলে ধরে মমতা জানিয়েছেন, সাড়ে সাত লক্ষ নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে উত্তরপ্রদেশে। গুজরাতে এই সংখ্যাটি ৫ লক্ষেরও বেশি। বাংলায় নথিভুক্ত এ ধরনের অপরাধের সংখ্যা ২ লক্ষেরও কম। ওড়িশার তথ্য বলছে, সেখানে প্রতিদিন ৮টি করে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। বাংলায় এই হার ২.৩। রাজস্থান, হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশের মতো রাজ্যগুলিতে এই হার বাংলার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি।