• facebook
  • twitter
Sunday, 8 September, 2024

ষাট দশকের বিশিষ্ট কবি রমেন আচার্য প্রয়াত

সৈয়দ হাসমত জালাল বিগত ষাটের দশক থেকে বাংলা কবিতায় যিনি স্বতন্ত্র একটি জায়গা করে নিয়েছেন, সেই কবি রমেন আচার্য ২৪ জুন, সোমবার প্রয়াত হয়েছেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর। প্রয়াত ও প্রখ্যাত কবি কৃষ্ণ ধর রমেন আচার্যর কবিতা সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘রমেন আচার্য একজন স্বল্প আলোচিত কবি, কিন্তু কবি হিসেবে তাঁকে একজন ব্যতিক্রমী সৃজনশীল শিল্পী বলেই

সৈয়দ হাসমত জালাল
বিগত ষাটের দশক থেকে বাংলা কবিতায় যিনি স্বতন্ত্র একটি জায়গা করে নিয়েছেন, সেই কবি রমেন আচার্য ২৪ জুন, সোমবার প্রয়াত হয়েছেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর।
প্রয়াত ও প্রখ্যাত কবি কৃষ্ণ ধর রমেন আচার্যর কবিতা সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘রমেন আচার্য একজন স্বল্প আলোচিত কবি, কিন্তু কবি হিসেবে তাঁকে একজন ব্যতিক্রমী সৃজনশীল শিল্পী বলেই আমার উপলব্ধিতে সমাদরে স্থান দিয়েছি। আমার এই বয়সেও তাঁর কবিতাপাঠ আমাকে আকর্ষণ করে।… তাঁর কবিত্বের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য তার চিত্রময়তা। কবিতা আমাদের জীবন দেখতে শেখায়। রমেন আচার্য আমাদের নিয়ে যান সেই জীবন নামক এক যাত্রাপথ পরিক্রমায়।’
১৯৩৮ সালে বর্তমান বাংলাদেশের ফরিদপুরে তাঁর জন্ম। কলকাতায় এসে পড়াশোনা করেন আর্ট কলেজে। আর্ট অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্সে শিক্ষা নিয়েও শেষ পর্যন্ত তিনি থেকে গেলেন কবিতায়। তিনি মনে করতেন, ‘শব্দ দিয়েও ছবি আঁকা যায়’। কবিতা তাঁর কাছে ছিল ‘অক্ষর রচিত শিল্পকলা’। তাঁর প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‘সেই উন্মোচন’ প্রকাশিত হয়েছিল ষাটের দশকে। কবিতা জগতের কোলাহল থেকে বরাবরই তিনি দূরে থেকেছেন।
তিনি মনে করতেন, ‘হ্যালোজেন প্লাবিত মঞ্চের বিপরীতে কিছু নিম্নকণ্ঠ লাজুক কবিতা এগিয়ে চলেছে কবিতার এক উচ্চতম শৃঙ্গের দিকে’। সাধারণত তিনি মঞ্চে কবিতা পড়তে যেতেন না। কারণ তাঁর মনে হতো, সব কবিতা একবার শুনে বোঝা যায় না। তাই সভার মধ্যে এভাবে কবিতাপাঠে আসলে অনেক কবিতার প্রতিই অবিচার করা হয়। আর এজন্যেই সম্ভবত তিনি বহু সাধারণ পাঠকের দৃষ্টির অগোচরে থেকে গিয়েছেন। কবি কৃষ্ণ ধরের মতে, ‘তাতে কিন্তু তাঁর কবিতার কোনো ক্ষতি হয়নি। পাঠকই বঞ্চিত হয়েছে একজন সংবেদনশীল কবির কবিতার রসাস্বাদন থেকে।’
তাঁর ন’টি কবিতাগ্রন্থ ও দুটি গদ্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ‘কবিতার শিল্পকলা’ ও ‘কবিতার অন্দরমহল’ নামে এই দুটি গদ্যগ্রন্থ কবিতা-পাঠকদের জন্যে অবশ্যপাঠ্য বলে মনে করেন অনেকেই। কবিতার শিল্পকলা বলতে তিনি মূলত চিত্ররূপময়তাকে বুঝিয়েছেন, যা তাঁর ভাষায় ‘অনুভবচিত্র’।
রমেন আচার্য তাঁর কবিতায় গড়ে নিয়েছিলেন এক স্বতন্ত্র কাব্যভাষা। তাঁর কবিতা নির্মাণের আপাত-সারল্যের ভেতরে থেকে গেছে একধরনের ধ্রুপদিয়ানা। তাঁর ‘সর্ষক্ষেত’ শীর্ষক একটি কবিতায় দেখা যায়, ‘চাষীদের গায়ের রং ক্রমে মাটির মতন হয়ে গেছে।/ রোদ বৃষ্টি ঘামে/ ধুয়ে গেছে ওদের যৎসামান্য অহঙ্কার।/ এইসব মানুষ, ফড়িং, কাকতাড়ুয়া ও রোদ্দুরের পাশে/ সুখ দুঃখের একঝুড়ি গল্প নিয়ে বসে ওই হলুদ ক্ষেত।/ বেলা বাড়ে, ক্লান্ত হয়, হাই তোলে,/ তারপর একসময়/ ঘুমিয়ে পড়ে।’ মণীন্দ্র গুপ্ত, দেবারতি মিত্র প্রমুখ কবি তাঁর কবিতা অত্যন্ত পছন্দ করতেন।
তাঁর দু’খণ্ডের ‘কবিতাসংগ্রহ’ এবং দুটি গদ্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে ‘এবং মুশায়েরা’ থেকে। তাঁর স্ত্রী গোপা আচার্যও একজন সুপরিচিত কবি।
রমেন আচার্যর সঙ্গে আমাদের পরিবারের দীর্ঘকালের একটা সুসম্পর্ক ছিল। আমার একেবারেই শৈশবকালে তিনি এবং  ‘কিশোরভাই’ অমরেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, কবি শেখ আব্দুল জব্বার, কবি এখলাসউদ্দিন আহমদ আমাদের মুর্শিদাবাদ জেলার খোশবাসপুর গ্রামের বাড়িতেও গিয়েছিলেন। পরবর্তী কালে যখনই তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে, তাঁর স্নেহমিশ্রিত মধুর ব্যবহার পেয়েছি। তাঁর মৃত্যুতে নিঃসন্দেহে বাংলা কবিতার ক্ষতি হলো। অন্যদিকে আমিও আমার প্রিয় একজন কবি ও প্রিয়জন হারানোর বেদনা অনুভব করছি।