খড়গপুরের খরিদা মন্দিরতলা এলাকায় একটি মাটির বাড়ি ভাঙার কাজ চলছিল ক’দিন ধরেই। মুখার্জি পরিবারের এই মাটির বাড়িটি সম্প্রতি কিনেছেন স্থানীয় একটি পরিবার। মুখার্জি পরিবারের কোনও সদস্যই এখন খড়গপুরে থাকেন না। দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের মাধ্যমেই বাড়ি বিক্রি করে দেন তারা। পুরনো মাটির বাড়ি ৮০ শতাংশ ভাঙা হয়ে গিয়েছে। একটি মাত্র ঘরই ভাঙা বাকি। মঙ্গলবার সকালে ভাঙার কাজ শুরু হওয়ার আগে জং ধরা তালা ভেঙে ঘরের দরজা খুলতেই টিনের তিনটি ট্রাঙ্ক নজরে পড়ে।
একটি ট্রাঙ্ক খুলতেই বেশ কিছু উত্তরীয়, বিবর্ণ হয়ে যাওয়া খাতা, জার্মান ভাষার একটি বই এবং সবশেষে সবাইকে অবাক করে দিয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বাক্ষর করা একটি চিঠি। বাংলা সাহিত্যের গবেষক কামরুজ্জামান বলেন, ‘এই চিঠি রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন খড়গপুর কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ, শান্তিনিকেতনের ছত্র ড. হিমাংশুভূষণ সরকারকে।’ ১৯৩৪ সালে কলকাতার গ্রেটার ইন্ডিয়ান সোসাইটি থেকে প্রকাশিত হয় ডা. সরকারের গবেষণালব্ধ কাজ ‘ইন্ডিয়ান ইনফ্লুয়েন্সেস অন দ্য লিটারেচার অফ জাভা অ্যান্ড বালি’। এই বইটি পাঠ করার পর উচ্ছ্বসিত রবীন্দ্রনাথ এই চিঠি লেখেন ডা. সরকারকে। ১৯৩৫ সালের ১১ মার্চ এই চিঠি লেখেন রবীন্দ্রনাথ।
গবেষক কামরুজ্জামান বলেন, ‘১৯৬১ সালে বিশ্বকবির জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে খড়গপুর কলেজ কর্তৃপক্ষ একটি বিশেষ স্মরণিকা প্রকাশ করে। সেই স্মরণিকায় অধ্যাপক সরকারকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠিটি প্রকাশিত হয়।’ কামরুজ্জামান জানান, মূল চিঠিটি কোথায় আছে তা জানা যায়নি।
খেরিদায় মন্দিরতলায় রবীন্দ্রনাথের লেখা সেই চিঠি পাওয়া যাওয়ায় এলাকায় চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয় বাসিন্দা রাজা সরকার বলেন, ‘ট্রাঙ্ক পাওয়ার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যাই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মূল চিঠি হলে এটা জাতীয় সম্পদ। একটা রবীন্দ্রনাথের গানের খাতাও পাওয়া গিয়েছে। মলাট দেওয়া ওই খাতায় লেখা জ্যোৎস্নারানি মুখার্জির নাম। এই জ্যোৎস্নারানির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ওই চিঠির কোনও সম্পর্ক আছে কিনা, মুখার্জি পরিবারের সঙ্গেই বা তাঁর কী সম্পর্ক ছিল, খোঁজ নিচ্ছি।
রবীন্দ্রনাথের এই চিঠি নিঃসন্দেহে খড়গপুরের ইতিহাসের একটি আলোকিত সম্পদ। অধ্যাপক সরকারকে কল্যাণীয়েষ সম্বোধন করে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘…অনেককাল থেকেই এইরকম বইয়ের জন্য অপেক্ষা করেছি, অবশেষে একখানি পেয়ে আমার আকাঙক্ষা তৃপ্ত হলো। এতে যে বহুবিস্তৃত গবেষণার পরিচয় পেয়েছি, তা আমাদের দেশে দুর্লভ। রবীন্দ্রনাথ চিঠিতে আশা প্রকাশ করে লিখেছেন, ‘…Ghose Travelling Fellowship- এর আনুকূল্যে যদি তুমি এই কাজে প্রবৃত্ত হতে পারো, তবে উক্ত Fel lowship- এর উদ্দেশ্য যথার্থ সিদ্ধ হবে। এ সম্বন্ধে কর্তৃপক্ষদের কাছ আবেদন করলে তোমার আবেদন ব্যর্থ হবে না বলেই আশা করি। রবীন্দ্রনাথ খেদ প্রকাশ করে লিখেছেন, দূর উপনিবেশে প্রাচীন হিন্দু সংস্কৃতির যে পরিশেষ ও পরিচয় পাওয়া যায় তাই উদ্ধার করার উদ্দেশ্যে ধনীদের কাছে অর্থ সংগ্রহ করে কাউকে পাঠাবার জন্যে একসময়ে চেষ্টা করেছিলুম, চেষ্টা সফল হয়নি।’
দুর প্রাচ্যের এই খেদ মিটিয়ে অধ্যাপক সরকার জাভা এবং বালিতে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রভাব নিয়ে গবেষণায় রত হওয়ায় উৎফুল্ল রবীন্দ্রনাথের এই চিঠি। মাটির বাড়ির টিনের তরঙ্গ থেকে এই চিঠি উদ্ধার তাই চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে এলাকায়।