মহাভারতের যুদ্ধ আঠারাে দিনেই অবসান হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ১৮ দিন উত্তীর্ণ হয়ে গেলেও এই যুদ্ধ জয় যে এত সহজে কড়ায়ত্ত করা সম্ভব নয়, তা ওরাও বেশ বুঝে গিয়েছেন। তবু অনিশ্চয়তা গ্রাস করেনি তাঁদের মনে। বরং আরও সুদৃঢ় ও সংগঠিত হয়ে উঠছে ওরা। রাজনীতির রঙ এড়িয়ে এই প্রথম কোনও আন্দোলন বৃহত্তর ভাবে নিজেদের বার্তা পৌঁছে দেওয়ার ক্ষমতা ধরে রাখতে সমর্থ হল।
এক দিকে গণ অবস্থান অন্যদিকে তাদের ঘিরেই প্রায় মেলার পরিবেশ। সব মিলিয়ে ১৮ দিনে এসেও আকাশ মেঘলা থাকলেও জমজমাট পার্ক সার্কাসের বিক্ষোভ সমাবেশ। দুই শিশুকে সঙ্গে নিয়ে তােপসিয়া থেকে পার্ক সার্কাসের গণ অবস্থানে যােগ দিতে আসছেন নাসরিন সুলতানা। নয়া নাগরিকত্ব আইন বিরােধী আন্দোলনে সেও স্বেচ্ছাসেবীর কাজ করছে।
তাঁর মতে এই রকম প্রায় ২৫ থেকে ৩০ জন গৃহবধূ সেচ্ছাসেবী রয়েছে বলে জানালেন আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী ফারহাত ইসলাম। তিনি আরও জানালেন, যতদিন না পর্যন্ত তাদের দাবি বিচার বিবেচনা করে দেখা হচ্ছে তারা এই আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।
অনুষ্ঠানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিশিষ্টজনেরা যােগ দিতে এসে তাঁদের উৎসাহ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে বলেও জানালনে মধ্য বয়স্কা ফারহাত ইসলাম। আর এই সুদীর্ঘ আন্দোলন সুষ্ঠভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে তারা নিজেদের মধ্যে থেকেই বেছে নিয়েছেন স্বেচ্ছাসেবীদের। উদ্যোমী মহিলা থেকে উৎসাহী স্কুল কলেজের ছাত্রীরা যেমন রয়েছে। তেমনই তাদের সহযােগিতা করছেন ওদের পরিবারেরই পুরুষরা। ব্যবসা বানিজ্য সামলে তারাও স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করছেন। প্রায় শতাধিক মহিলা ও পুরুষ পালা করে এই আন্দোলনের জন্য নিজেদের স্বেচ্ছাশ্রম দিচ্ছেন।
এই স্বেচ্ছাসেবী মহিলারা পালা করে ২৪ ঘণ্টার জন্য আন্দোলন মঞ্চের ভিতরে হাজির থাকেন। ভিড় সামাল দেওয়া, বয়স্ক মহিলা হলে তাঁদের হাত ধরে বসার জায়গা দেখিয়ে দেওয়া, আবার কখনও বায়াে টয়লেটে নিয়ে যাওয়ার মতাে এমন সব কাজ হাসি মুখে করে যাচ্ছে নাসরিন থেকে শুরু করে ফারহা, ইয়াসমিনা, সাহিনরা।
বছর ৩০-এর নাসরিন জানালাে, পরিবারের জন্য মেয়েরা যেভাবে নিজেদের দায়িত্ব পালন করে চলে। ঠিক সেই ভাবে এই আন্দোলনও সবার সাথে মিলে সামাল দিচ্ছি আমরা। নাসরিন ছাড়াও ভিড়ের মধ্যে দেখা মিলল স্বেচ্ছাসেবী অষ্টাদশী সুহানাকে। পার্ক সার্কাস এলাকারই বাসিন্দা। চুলবুলি মেয়েটি। ওদের সকলেরই গলায় ঝুলছে একটি করে স্বেচ্ছাসেবীর কার্ড। পড়াশুনার পর সুহানাও চলে আসছে পার্ক সার্কাসের বিক্ষোভ সমাবেশে। স্লোগানে গলা মেলাতে মেলাতেই ছােট্ট শিশুদের ত্রস্ত হাতে দেখাশুনা করছে সুহানার মতাে তরুনীরা।
রাজাবাজার এলাকা থেকে নিয়মিত আন্দোলনে স্বেচ্ছাসেবীর কাজ করতে হাজির হচ্ছে মধ্য বয়স্কা আফ্রিন পারভিন। তিনি জানালেন, মহিলা স্বেচ্ছাসেবীরা থাকছেন মঞ্চ ও দড়ির মধ্যে ঘেরা জায়গায়। আর বাইরে সামাল দিচ্ছেন পুরুষ স্বেচ্ছাসেবকরা। তাদের মধ্যে কেউ পার্কিং দেখছে আবার কারাে উপর জল-খাবারদাবার তত্ত্বাবধান করার দায়িত্ব পড়েছে। প্রতিদিনই বেশ কয়েকজন করে মহিলা রােজা রেখে যাচ্ছে এই আঠারােতম দিনে এসেও। বিকেলে তাদের খাবার হাতে হাতে তুলে দেওয়া। সমাবেশে দূরবর্তি এলাকা থেকে আগত মহিলাদের সঙ্গে অনেক সময়ই তাদের ছােট্ট ছেলেমেয়েরা থাকছে। তাদের জন্য জল ও হাল্কা খাবারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
কখনও বারুইপুর, কখনও খিদিরপুর, গার্ডেনরীচ, রাজাবাজার এলাকা থেকে ছােট ছােট গাড়ি ভাড়া করে জমায়েতে যােগ দিতে আসছে বিভিন্ন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা। পার্কিং-এর বন্দোবস্ত করা হয়েছে ওই ময়দানের মধ্যেই। আগামী দিনে বৃহত্তর আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তৈরি পার্ক সার্কাসের বিক্ষোভকারীরা।
অন্যদিকে হাওড়ার পিলখানায় জিটি রােডের পাশে মঞ্চ তৈরি করে বিক্ষোভে বসেছে স্থানীয়রা। দেশের বিভিন্ন এলাকার পাশাপাশি এবার বাংলা জুড়েও বিভিন্ন জায়গায় শাহিন বাগের আদলে আরও একটি ধর্ণা শুরু হয়েছে। এজেন্ডা একটাই, নয়া নাগরিকত্ব আইন, এনআরসি, এনপিআর বন্ধ করা হােক। পিলখানাতেও পার্ক সার্কাসের মতাে মহিলা-শিশু পুরুষরা পথে নেমে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে নেমেছন।
সকালের দিকে বিক্ষোভ জোড়দার না হলেও সন্ধে থেকে যত রাতের দিকে যাচ্ছে শীতের রাতেও আন্দোলন তত উষ্ণতা বাড়াচ্ছে। হাওড়ার পিলখানা এলাকাতে একটি বস্তি রয়েছে। এই আন্দোলনে মূলত তারাই যােগ দিয়েছে বলে এলাকাবাসীরা জানিয়েছেন। দিনের বেলা ২০ থেকে ৩০ জন। থাকলেও রাতে তা শতাধিকে পৌঁছাচ্ছে। বাড়ির কাজ শেষ করে অধিকাংশ মহিলারা এখন তাদের নিয়মিত পছন্দের টিভি সিরিয়াল বাদ দিয়ে বিক্ষোভ কর্মসূচিতে যােগ দিতে এসেছেন বলে জানালেন পিলখানার বাসিন্দা আরফিন, নাজিম, আখতাররা।