প্রিয় নেই, চলে গেলেন সোমেনও, মন খারাপ সুব্রতর

সোমেন মিত্র (File Photo: IANS)

বঙ্গ রাজনীতিতে ডানপন্থী দলের একসঙ্গে যে তিনটি নাম উচ্চারিত হত তা হল প্রিয়-সোমেন-সুব্রত জুটি। ছয়ের দশকের শেষের দিকে ছাত্র রাজনীতি দিয়ে পথচলা শুরু করেছিলেন প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সী, সুব্রত মুখার্জি। সেই সময় যুব কংগ্রেসের প্রভাবশালী নেতা ছিলেন সোমেন মিত্র।

উত্তর কলকাতার দাপুটে সোমেনের সঙ্গে মফঃস্বল থেকে আসা প্রিয় এবং সুব্রতর অটুট বন্ধন তৈরি হল। রাজ্যে কংগ্রেসের ভিত শক্ত করতে এই ত্রয়ীর পথচলা শুরু। এরপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। রাজনীতির অনেক বিষয় নিয়ে এই তিনজনের সহমত ও ভিন্নমত হয়েছে। কিন্তু সম্পর্ক অটুট থেকেছে।

আগেই চলে গিয়েছেন প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সী। বৃহস্পতিবার চলে গেলেন সোমেন মিত্র। বাংলায় ডানপন্থী রাজনীতির দুই তারা খসে গেল। জুটিহীন অবস্থায় রইলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। সোমেন মিত্রের প্রয়াণে শোকস্তব্ধ সুব্রত মুখার্জিও। সংবাদমাধ্যমের সামনে তাঁর একাকীত্ব শেয়ার করলেন সুব্রত মুখার্জি।


জেলা থেকে কলকাতায় পড়তে এসে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন প্রিয় এবং সুব্রত। এরপর এই দু’জনই হয়ে ওঠেন ছয়ের দশকের মাঝামাঝি ছাত্র পরিষদের দুই শীর্ষ নেতা। ছাত্র রাজনীতিতে সোমেন মিত্রের সাহস এবং সাংগঠনিক শক্তিকে সবসময় ব্যবহার করছেন প্রিয়দা।

সোমেনের সেই লড়াকু মনোভাব এবং সাহস সেই সময় নকশাল আন্দোলন দমন করতে ভীষণভাবে সাহায্য করেছিল। সংবাদমাধ্যমে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সুব্রত মুখার্জি বলেন, মা’কে হরিদ্বার বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিলাম। বাবা কলকাতায়। আচমকাই বাবার মৃত্যুর খবর পাই। দিশাহারা হয়ে পড়ি। সেই সময় সোমেন মাসিহা হয়ে আমার সামনে ধরা দেয়।

কলকাতায় ফিরে না আসা পর্যন্ত মরদেহ দু’দিন ধরে সংরক্ষণ রাখা ছাড়া সবরকম সহযোগিতা করেছিলেন সোমেনা। সেদিনের কথা আজও ভুলতে পারেননি সুব্রত মুখার্জি। ১৯৮৪ সালে ৩১ অক্টোবর ইন্দিরা গান্ধি হত্যার পর সোমেন-সুব্রত জুটির রাজ্যব্যাপী আন্দোলন ছিল সুব্রত মুখার্জির কাছে একটা বড়সড় আন্দোলন।

মমতা-সোমেনের দ্বন্দ্বেই তৃণমূলের জন্ম। একথা বহু চর্চিত হলেও মানতে নারাজ সুব্রত মুখার্জি। তাঁর মতে, নয়ের দশকের শেষ দিকে কংগ্রেস যেভাবে চলছিল সেই পথকে সমর্থন করেননি মমতা ব্যানার্জি। তাই ১৯৯৮ সালে কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তৃণমূল কংগ্রেস তৈরি করেন। তৃণমূলের জন্মের পেছনে সোমেন মিত্রের কোনও ভূমিকা নেই।

মানুষ হিসেবেও খুব পরোপকারী ছিলেন সোমেন। রাজনীতির রং দেখতেন না উপকার করার সময়। বড় মাপের সংগঠক ছিলেন তিনি। রাজনীতির অন্যান্য দিকের চেয়ে সংগঠনে নতুন ছেলে তৈরি করার ক্ষেত্রে সোমেনের জুড়ি মেলা ভার। সেকারণে জেলায় গিয়ে সবার সঙ্গে মিশতেন। রাতের পর রাত কাটাতেন। একজন দক্ষ সংগঠকের যা যা গুণ দরকার তা ছিল সোমেনদার মধ্যে।

রাজনৈতিক মতাদর্শে বিভিন্ন সময় মতানৈক্য তৈরি হলেও সম্পর্ক কখনও খারাপ হয়নি। সোমেনদা ছিলেন দুর্দিনের বন্ধু। বিপদে পড়লে পাশে দাঁড়াতেন। টেলিফোনে নিয়মিত কথা হত। সোমেনদার আমহার্স্ট স্ট্রিটের কালীপুজোয় যেমন যেতাম, ঠিক তেমনি একডালিয়া পার্কের দুর্গাপুজোয়ও সোমেনদা আসতেন। বন্ধুত্ব অটুট ছিল দশকের পর দশক ধরে।

সোমেনদার মৃত্যুতে রাজ্য কংগ্রেসের সাময়িক ক্ষতি হল অবশ্য। তবে বলতে দ্বিধা নেই, এক বড় মাপের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে বাংলা হারাল। যদিও কংগ্রেস ব্যক্তিনির্ভর দল নয়। তবে, সবাই কেন সোমেন মিত্রকে ছোটদা বলে ডাকতেন তা অবশ্য জানা নেই সুব্রতর।

রাজ্য রাজনীতি শুধু নয়, কেন্দ্রীয় রাজনীতির অনেক জানা-অজানা ঘটনার সাক্ষী প্রিয়-সোমেন-সুব্রত। অনেক না বলা কথা জমে রয়েছে সুব্রতর কাছে। এই ত্রয়ীর কক্ষপথ থেকে ছিটকে গেল দু’জন। স্বাভাকিভাবে একলা হয়ে পড়লেন সুব্রত। তাই প্রিয় সোমেনদার প্রয়াণে মন খারাপ সুব্রতের।