আগামীর কথা ভেবে দৌড় শুরু করেছেন শাসক নেতারা। এতদিন দলের শীর্ষ স্তর থেকে যে কর্মসূচি ঘােষণা করা হতাে তা বাস্তবায়িত করত শাসক নেতারা। এবারও সেই পদ্ধতিই বহাল রয়েছে। কিন্তু এবার চেনা মাঠ অনেকটাই অচেনা লাগছে তৃণমূল নেতাদের কাছে।
একশ দিনের মধ্যে এক হাজার নেতার দশ হাজার গ্রামে যাওয়ার যে কর্মসুচি নজরুল মঞ্চে তৃণমূল সুপ্রিমাে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘােষণা করেছেন তা বাস্তবায়িত করতে শাসক নেতাদের রীতিমতাে হিমশিম খাওয়ার অবস্থা।
এর আগে উত্তরবঙ্গে বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ একজনের বাড়িতে মধ্যাহ্ন ভােজ সেরেছিলেন। এবার তৃণমূল সুপ্রিমাে প্রশান্ত কিশােরের দেওয়া পরামর্শ মেনে শাসক নেতাদের গ্রামে গিয়ে সাধারণ মানুষের বাড়িতে শুধু খাওয়ার কথাই বলেননি, এক ধাপ এগিয়ে রাত্রি যাপনের কথাও বলেছেন।
এই নিয়ে শাসক ও বিরােধী দলের মধ্যে কৌতুহল যথেষ্ট রয়েছে। জনসংযােগ নিবিড় করতে পিকের দেওয়া হােমটাস্ক ভালােভাবে করার জন্য শাসক দলের বিভিন্ন স্তরের নেতাদের মধ্যে মরিয়া প্রয়াস লক্ষ্য করা গিয়েছে।
‘দিদিকে বলাে’ গেঞ্জি পরে সংবাদ মাধ্যমের মুখােমুখি হচ্ছেন শাসক দলের বিধায়ক থেকে শুরু করে জেলা সভাপতিরা। সেই সঙ্গে পাঁচজন করে বিশিষ্ট মানুষজনের সঙ্গে জনসংযােগ করার কথা বলা হয়েছে। এই হােমটাস্ক সঠিকভাবে পূরণ করার জন্য যাবতীয় দ্বিধা ভুলে শাসক নেতারা মাঠে নেমেছেন।
সবক্ষেত্রে তাঁদের অভিজ্ঞতা যে সুখকর এমনটা নয়। বিভিন্ন জেলায় এ ধরনের কর্মসুচিতে গিয়ে বিক্ষোভের মধ্যে পড়তে হচ্ছে তৃণমূল নেতাদের। তবুও ছােটখাটো সমস্যা পেছনে ফেলে রেখে শাসক নেতারা এগােচ্ছেন, দলের বেঁধে দেওয়া লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে৷
জঙ্গলমহলের শাসক দলের এক বিধায়ককে মাটির দাওয়ায় বসে দেশি মুরগির সঙ্গে গরম ভাত সহযােগে জনসংযােগ করতে দেখা গিয়েছে। কোথাও বা ‘দিদিকে বলাে’ গেঞ্জি শরীরের সাথে ঠিকমতাে না হওয়ায় দলীয় নেতা কর্মীদের মধ্যে হাসির রােল দেখা গিয়েছে।
তবে সাময়িক কিছু প্রতিবন্ধকতাকে বাদ দিলে পিকের হােমটাস্ক ঘিরে ক্রমশ কৌতুহল এবং জল্পনা বাড়ছে। এমনও খবর আসছে এই কর্মসূচি সঠিকভাবে করে ভিডিও আপলােড করতে হচ্ছে। কর্মসূচি নির্ধারিত সময়ে না হলে ফোন চলে যাচ্ছে কপোরেট সংস্থার অফিস থেকে। এভাবেই নজরদারি শুরু হয়েছে নেতাদের উপর।
শারীরিক অসুস্থতার কারণে কোনও নেতা কর্মসূচিতে অনুপস্থিত থাকলে আগেভাগে জানাতে হচ্ছে নিদিষ্ট জায়গায়। যারা কর্মসুচি রূপায়ন করছেন মাঠে নেমে তাঁদের অধিকাংশের প্রশ্ন, নিশ্চয়ই ভলাে হচ্ছে তা না হলে এমন কর্মসুচির নির্দেশ আসতাে না।
তবে জেলাস্তরে শাসক নেতাদের অনেকেই জানাচ্ছেন, এই হােমটাস্ক করতে গিয়ে শাসক নেতারা অন্যকিছু ভাবার সময় পাচ্ছেন না। কারণ একটার পর একটা কর্মসুচি চাপিয়ে দিয়ে নেতাদের ব্যস্ত রাখার এই কৌশলের পিছনে প্রশান্ত কিশােরের মস্তিষ্ক রয়েছে এমনটাই মনে করা হচ্ছে।
অন্যদিকে গােপনে বিজেপির সঙ্গে যে যে শাসক নেতারা বিভিন্ন স্তরে যােগাযােগ রাখার চেষ্টা করছেন তাঁদেরও তালিকা তৈরি করছে এই কর্পোরেট সংস্থা। নজরদারি চলছে ছদ্মবেশে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি ইতিমধ্যেই হয়েছে যাতে দেখা গিয়েছে এক শ্রেণির শাসক নেতারা এই প্রথম অনুপস্থিত থাকছেন। যা অতীতে কখনও দেখা যায়নি। এর নেপথ্যেও প্রশান্ত কিশােরের কৌশল রয়েছে। সম্প্রতি নানুরে যে শহীদ দিবস কর্মসুচি হল তৃণমূলের সেখানে অনুব্রত মন্ডল অনুপস্থিত ছিলেন।
এর পাশাপাশি বিভিন্ন অরাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিতে দেখা গিয়েছে তৃণমূল সুপ্রিমাে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। প্রথমে জল অপচয় রুখতে পরে সবুজায়নকে সামনে রেখে পদযাত্রা করেন মমতা। আগামীতে জেলায় জেলায় এ ধরনের অরাজনৈতিক কর্মসুচি শাসক নেতাদের দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
কলকাতা পুরসভার কাউন্সিলারদের বেশ কয়েকজন জনসংযােগ নিবিড় করতে তাঁর এলাকার মধ্যে থাকা। পিছিয়ে পড়া অংশের ছেলে মেয়েদের নিয়ে পিকনিকে যাচ্ছেন। কলকাতা পুরসভার টালিগঞ্জ এলাকার এক কাউন্সিলার তাঁদের ওয়ার্ডের মানুষজনকে নিয়ে সিনেমা হলে যাচ্ছেন সুপার থার্টি দেখতে।
সব মিলিয়ে এক অন্য ধরনের জনসংযােগে নিজেদের ব্যস্ত রাখছেন শাসক দলের জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্তরের নেতারা আগামীর কথা ভেবে। পিকের কৌশলে কিছুটা হলেও যে তৃণমূল ভালাে জায়গায় এমনই খবর আসছে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে।
বাংলার বুকে বিশেষ কোনাে একটি রাজনৈতিক দলের সংগঠনকে মজবুত করতে কর্পোরেট সংস্থার পরামর্শ প্রদান। এবারই প্রথম দিদিকে বলো- কর্মসুচি পাল্টা বামেদের দিদিকে বলছি কিংবা দিদি বাংলা ছাড়াে- এ ধরনের কর্মসূচি নিয়েছে বিজেপি। বিরােধীদের কর্মসূচির ফর্মুলা দেখে বুঝে নিতে অসুবিধা হচ্ছে না প্রশান্ত কিশােরের মস্তিষ্ক প্রসূত দিদিকে বলাে কর্মসূচি ঠেকাতে ব্যস্ত বিরােধীরা।
এভাবেই নিজের ছকে বিরােধীদের ফেলতে চাইছেন পিকে। এর ফলে তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যে যাওয়ার একটা হিড়িক দেখা গিয়েছিল তা রােখা সম্ভব হয়েছে। সেই সঙ্গে কাটমানি ইস্যুকে সামনে রেখে প্রথম শাসক দল ব্যাকফুটে গেলে এর উল্টো প্রতিক্রিয়াও রয়েছে।
কাটমানির সঙ্গে যুক্ত থাকা অসাধু নেতাদের একাংশ যেভাবে বিজেপিতে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল আপাতত তাঁরা দোলাচলে রয়েছেন। তৃণমূলের মধ্যে থাকা শ্রেয় বলে মনে করছেন তাঁরা। এই দুই কৌশল ক্রমশ তৃণমূলের পালে হাওয়া যুগিয়েছে।