তৃণমূল – ২১৫, বিজেপি – ৭৫, সংযুক্ত মাের্চা – ০১
অবশেষে জনতার ‘রায়’ তার দিকেই গেল। একুশ সালের দোসরা মে কিংবদন্তি পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের একশােতম জন্মদিনে বিধানসভায় প্রবল ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ বিজেপিকে হারিয়ে হ্যাটট্রিক করে ‘অপরাজিত’ রইল তৃণমুল। যদিও এই জয় খুব মসৃণ পথে এগােয়নি।
হাড্ডাহাডিড লড়াইয়ের পরে রবিবার নন্দীগ্রামে মমতাকে ১৬২৩ ভােটে হারতে হয়েছে বিজেপি প্রার্থী শুভেন্দু অধিকারীর কাছে। তা সত্ত্বেও ভােটের শেষে শুভেন্দু হয়ে রইলেন এক পরাজিত দলের ‘নায়ক’। তার আর মহানায়ক হয়ে ওঠা হল না।
অন্যদিকে রাজনীতির খেলায় মমতা নিজে হুইল চেয়ারে বসে ‘গােল করতে না পারলেও‘ খেলা দেখাল তার দল। আর তাতেই খেল ‘খতম’ হল বিজেপির। তবে এই ‘খেলা’ এত সহজ ছিল না। বিশেষ করে গত কয়েক মাস ধরে বিজেপি বাংলায় ‘শাখাপ্রশাখা’ বিস্তার করছিল, কেন্দ্রীয় নেতাদের এনে যেভাবে বাংলায় অভিযান চালিয়েছিল তা তৃণমূলের সমর্থকদের কাছে একটা ‘অশনি সংকেত’ হয়ে উঠেছিল।
সেই সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের বেশ কিছু সিদ্ধান্ত তৃণমূলকে ‘সীমাবদ্ধতা’য় বেঁধে রেখেছিল। কিন্তু দোসরা মে, রবিবার সেইসব আশঙ্কার ‘সমাপ্তি’ ঘটল। গত কয়েক মাস ধরে সােনার কেল্লা’র গুপ্তধনের আশায় পশ্চিমবঙ্গকে ‘সুনার বঙ্গাল’ হিসেবে গড়ে তােলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মহান হতে চেয়েছিলেন মােদি-শাহ।
কিন্তু বাংলার জনগণ তার ‘ইনার আই’ দিয়ে ‘কাপুরুষ ও মহাপুরুষ’-এর মধ্যে তফাত করতে ভুল করেনি। তাই গােটা দেশে একাধিক কর্মসুচির নিরিখে বিজেপিকে ‘গণশত্রু’ হিসেবেই হয়তাে চিহ্নিত করল বাংলার মানুষ।
উল্টো দিকে তৃণমুলের একাধিক সামাজিক পরিষেবা ও কর্মসুচিতেই মমতার ‘পরশপাথর’ খুঁজে পেল জনগণ। তাই ‘ঘরের মেয়ে’ নাম বহিরাগত তকমায় ‘ঘরে বাইরে’র ঘাের লড়াইয়ে বিজেপিকে ‘আগন্তুক’ হিসেবে মাঠের বাইরেই রাখল বাংলার মানুষ। ‘হীরক রাজার দেশে’র সেই দৃশ্যের মতােই বিজেপিকে খান খান করে দিল একশাে আসনের নীচে আটকে।
আর রাজার সেই ক্ষমতায় আসনে কি ‘দেবী’র আসন পাকা হবে বাংলার নিজের মেয়ের? নন্দীগ্রামে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হারের পরে সেই আসন পেতে হলে বেশ কিছু সাংবিধানিক বিধিবদ্ধতার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। তবে তৃণমূলের সরকার গড়াটা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে।
তাই রবিবার তৃণমূলের এই জয়ের আনন্দে গােটা রাজ্যের সঙ্গে এই ‘মহানগর’ও মেতে উঠল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে করােনার ভয়টাও বােধহয় “জনঅরণ্য’-এ মুখ লুকিয়েছিল। অর্থাৎ রবিবার সকাল থেকেই ভােটগণনাকে কেন্দ্র করে করােনার ভয়টা ছিল ব্যাকফুটে।
সারাদিন ধরে গণনার মধ্যেই বিভিন্ন প্রার্থীদের মধ্যে টানাপােড়েন চলেছে। দুপুর গড়াতেই বােঝা যায় ঘাসফুলে ঝড় উঠতে শুরু করেছে। ততক্ষণে বৈশাখী বাতাসে উড়ছে সবুজ আবির। শুনশান রাস্তায় বাজছে ‘খেলা হবে’র ডিজে। বারােটার আগেই মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে পৌছে যান অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।
বিকেল পাঁচটা নাগাদ একটি সংবাদ সংস্থার খবরে চাউর হয়ে যায় নন্দীগ্রামে হাইভােল্টেজ লড়াইতে ১২০০ ভােটে জিতে গিয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু ঘন্টাখানেক পরেই এক নাটকীয় মােড় নেয় ফলাফল। শুভেন্দু অধিকারীর তরফে পুনর্গণনার দাবি জানানাে হয়।
নতুন করে গণনার পরে দেখা যায় ১৬২৩ ভােটে শুভেন্দু অধিকারীর কাছে পরাস্ত হয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে এই খবর পেয়ে মমতা জানান, নন্দীগ্রামের মানুষ যে রায় দিয়েছে সেটা মেনে নিলাম।
তবে একটা আসনে হারা জেতা বড় কথা নয়। তবে ভােট গণনা নিয়ে যাতে রিভিউ করা হয় , সেজন্য আবেদন জানাব, প্রয়ােজনে আদালতেও যাব। এদিকে এদিন নির্বাচনী ফলাফল ঘােষণার পর পায়ে হেঁটে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসেন।
সেই সময় অভিষেক কন্যাসহ পরিবারের অনেকেই মমতাকে অভিনন্দন জানাতে এসেছিলেন। দু’শাের বেশি আসনে তৃণমূলের জয় নিয়ে নিশ্চিত হয়ে সন্ধ্যের আগে মমতা সােজা চলে যান কালীঘাট মন্দিরে। সেই সময় তার সঙ্গে ছিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ভােট কুশলী প্রশান্ত কিশাের।
এর আগে চৈত্রের শেষ দিনেই তিনি কালীঘাট মন্দিরে কথা দিয়েছিলেন দোসরা মে জিতে প্রথমেই কালীঘাট মন্দিরে পুজো দিতে আসবেন। রবিবার সেই শপথ রক্ষা করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে এদিন তিনি নিজের জন্য নয়, পুজো দিলেন তার দল মা-মাটি-মানুষের নামে।
তবে শুধু শপথই নয়, রবিবার নির্বাচনী ফলের পরে তিনি জানিয়ে দিলেন প্রতিশ্রুতি পূরণের কথাও। ভােটের আগেই তিনি ঘােষণা করেছিলেন আঠেরাে থেকে চুয়াল্লিশ বছর বয়সী রাজ্যবাসীকে বিনামূল্যে টিকা দেবেন।
রবিরারও জানালেন, টিকা যােগান দেওয়ার জন্য কেন্দ্রের কাছে আবেদন জানানে মমতা । সেই আবেদন না মানা হলে আন্দোলনের পথে নামবেন তিনি। কোভিড পরিস্থিতির জন্য পূর্ব ঘােষণামতো এবং নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ মেনে এবার কোনও বিজয় মিছিল হল না তৃণমূলের তরফে।
কোভিড পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে ব্রিগেডে এই জয়কে উদযাপন করা হবে বলে জানালেন মমতা। তবে মানুষ জয়ের আনন্দে ভাসতে না পারলেও রবিবার সন্ধ্যেয় প্রকৃতি এদিন বৃষ্টিতে ভিজিয়েছে মানুষকে। যে বৃষ্টিতে মমতার শুভযােগ রয়েছে বলেই জনশ্রুতি।