বারাসতে কাকলির বিরুদ্ধে কে হবেন বিজেপি প্রার্থী?
অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়, নাকি মিঠুন চক্রবর্তী?
নিজস্ব সংবাদদাতা, বারাসত: বুধবার উত্তর ২৪ পরগনার জেলা সদর বারাসতে সন্দেশখালিতে ইস্যুতে গোটা রাজ্যে ঝড় তুলতে চেয়েছেন মোদী। কিন্তু, আসন্ন লোকসভা ভোটে বিজেপির অন্দরেই বারাসত কেন্দ্রের টিকিট নিয়ে ঝড় শুরু হয়েছে। কে পাবে বারাসত কেন্দ্রের টিকিট, এই নিয়ে বিজেপি-র প্রাক্তন ও বর্তমান জেলা নেতাদের মধ্যে শুরু হয়েছে দড়ি টানাটানি।
বিজেপির দলীয় সূত্রের খবর, দুই সপ্তাহ আগে পর্যন্ত বারাসত কেন্দ্রের টিকিট পাওয়ার জন্য প্রায় ৪১ জন নেতা আবেদন জমা পড়েছে। কিন্তু, কেউই তিনবারের তৃণমূল সাংসদ কাকলি ঘোষ দস্তিদারের সমকক্ষ হতে পারেননি। সংসদে কাকলির উপস্থিতি ও বিভিন্ন পরিকাঠামোগত উন্নয়নে একটা রেকর্ড রয়েছে। ইতিমধ্যে কাকলি ঘোষ দস্তিদার বারাসত জেলা সদর হাসপাতালকে মেডিক্যাল কলেজে রূপান্তর করে বারাসতবাসীর মন জয় করে নিয়েছেন।
সেই কাকলি ঘোষ দস্তিদারকে হারাতে পারবেন কিনা জানা নেই টিকিটের দাবিদার এইসব জেলা বিজেপি নেতাদের। কিন্তু, লোকসভায় এই কেন্দ্রে টিকিট পেতে প্রত্যেকে দাঁতে দাঁত কামড়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। মূলত পাঁচ বিজেপি নেতার মধ্যে লড়াই বারাসত জেলা বিজেপি-র রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি চর্চার বিষয়। এই পাঁচজন নেতা হলেন তাপস মিত্র, তরুণ ঘোষ, শঙ্কর চ্যাটার্জী, অনুপ দাস ও শঙ্কর দাস।
দলীয় সূত্রের খবর, এই পাঁচ বিজেপি নেতা টিকিট পাওয়ার জন্য দিল্লিতে দলের সদর দপ্তরে পর্যন্ত দরবার করেছেন। এবং প্রত্যেকেই কাউকে না জানিয়ে গোপনে আলাদা আলাদাভাবেই রওনা হয়েছেন। উদ্দেশ্য ছিল, টিকিট পেতে দিল্লির নেতাদের মন ভেজানো। এই পাঁচজন নেতার মধ্যে কেউই দলের বিবেচ্য বলে মনে হয়নি। দলীয় সূত্রে এমনই খবর পাওয়া যাচ্ছে।
এপ্রসঙ্গে উল্লেখ্য, গত ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে বিজেপির জাতীয় কর্ম সমিতির বৈঠকে যোগ দেওয়ার অজুহাতে এই পাঁচ নেতা দিল্লির পথে রওনা হন। সেখানে দলের জাতীয় সদর দপ্তরে জেপি নাড্ডা সহ দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে দেখা করে নিজের জন্য টিকিট পেতে দরবার করেন। এই পাঁচ নেতার মধ্যে তরুণ ঘোষ বাদে বাকি চারজনের প্রত্যেকেই প্রায় তিন দশক ধরে বারাসত বিজেপি-র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এঁদের চারজনেরই বাড়ি বারাসতে।
অন্যদিকে তরুণ ঘোষের বাড়ি উত্তর ২৪ পরগনার দেগঙ্গাতে। তিনি পেশায় মূলত একজন এলআইসি এজেন্ট। তিনি বিজেপি-র পঞ্চায়েত প্রতিনিধিও নির্বাচিত হন। আবার তাপস মিত্র ছাত্র জীবনে এসএফআই করতেন বলে সূত্রের খবর। কিন্তু পরবর্তীতে নব্বইয়ের দশকে পাকাপাকিভাবে বিজেপি-তে যুক্ত হয়ে যান। পেশায় তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ একটি এলপিজি সংস্থার কর্মী। তিনি একাধিকবার জেলা বিজেপি-র গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকেছেন। কিছুদিন আগেও তিনি জেলা বিজেপির সভাপতি ছিলেন। কিন্ত দলের রাজ্য নেতা অমিতাভ চক্রবর্তীর অঙ্গুলিহেলনে তাঁর সভাপতি পদ চলে যায়। তাঁর জায়গায় নতুন সভাপতি হন তরুণ ঘোষ।
অন্য আর এক নেতা শঙ্কর চ্যাটার্জী বিজেপি-তে একটি বিতর্কিত নাম। তাঁকে নিয়ে দলের ভিতরে বাইরে বিভিন্ন সময়ে একাধিক অভিযোগ উঠেছে। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনও দল ও এলাকাবাসীর মধ্যে বহু সমালোচিত। বিভিন্ন সময়ে সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে তাঁর মাদকাসক্তির ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। সামাজিক মাধ্যমে তাঁকে নিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন কুরুচিকর মন্তব্য করতেও ছাড়েননি। এমনকি তিনি ২০২১ সালে বারাসত বিধানসভা কেন্দ্রে প্রার্থী হয়েও ভোটের প্রচারের দলের পাঠানো টাকা খরচ করেননি বলে একাধিক নেতা ও কর্মীদের অভিযোগ। এমনকি তাঁকে ভোট পরবর্তী হিংসার সময়ে নেতা-কর্মীদের পাশে থাকতে দেখা যায়নি বলে অধিকাংশ নেতা কর্মীদের অভিযোগ।
অন্যদিকে অনুপ দাস প্রাথমিক পর্যায়ে বারাসত আদালতে মুহূরীর কাজ করেন। একইভাবে তাপস মিত্র ও অনুপ দাসদের সমসাময়িক নেতা শঙ্কর দাসও। তিনিও দীর্ঘদিন ধরে বিজেপির সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত আছেন। প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই দলের ক্ষমতাকে বিকেন্দ্রিকৃত না করে কুক্ষিগত করার অভিযোগ রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা ও মন্ডলের একাধিক নেতা কর্মী এই অভিযোগ করেছেন।
তবে এই পাঁচ নেতার মধ্যে তাপস মিত্র এবং শঙ্কর চ্যাটার্জী বারাসত বিজেপির রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ব্যক্তিদের মধ্যে পড়েন। এবং দুই জনের মধ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব প্রায় তিন দশক ধরেই চলে আসছে। প্রকাশ্যে না বললেও কেউ কাউকে সহ্য করতে পারেন না। দুইজনের মধ্যে দলের পদ নিয়ে একাধিকবার দড়ি টানাটানি হয়েছে। এই দুই নেতার একজন দলের জেলা স্তরের ক্ষমতায় আসতেই, অন্যজন পদচ্যুত হয়েছেন।
এদিকে তাপস মিত্র একসময় রাজ্য বিজেপি-র প্রাক্তন সভাপতি রাহুল সিনহার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন। পরবর্তীতে সিনহা যখন রাজ্য সভাপতি হন, তখন তাপস মিত্রের সঙ্গে চরম মতদ্বন্দ্ব শুরু হয়। সেই দ্বন্দ্বটা এতটাই চরম আকার ধারণ করে যে, রাহুল সিনহা দীর্ঘদিনের জন্য তাপস মিত্রকে দল থেকে পদচ্যুত করে দেন। মূলত তাঁর একটি স্বচ্ছ ভাবমূর্তি থাকলেও দলের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার অভিযোগ উঠেছে বারবার। সেজন্য একাধিকবার জেলার দায়িত্ব পেয়েও সংগঠনকে প্রসারিত করতে পারেননি।
এদিকে আজ, বুধবার বারাসতে নারীদের ক্ষমতায়নে মোদির জনসভায় জেলা নেতাদের এই দ্বন্দ্ব আবার দলের নেতা কর্মীদের চায়ের আসরে চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছে। দলের নেতা কর্মীরা কেউই এই পাঁচজনের কাউকে লোকসভা ভোটের প্রার্থী হিসেবে মানতে রাজি নন। তাঁরা চাইছেন বারাসত লোকসভা কেন্দ্রে কাকলি ঘোষ দস্তিদারের সঙ্গে সমানে সমানে লড়াই দেওয়ার জন্য অভিজিৎ গাঙ্গুলীর মতো কোনও প্রতিবাদী ও স্বচ্ছ ব্যক্তিত্বের মানুষকে। যদিও অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়কে তমলুক থেকে বিজেপি প্রার্থী করার একটি গুঞ্জন ইতিমধ্যে বাজারে ছড়িয়েছে।
তবে দলীয় সূত্রে পাওয়া খবরে জানা যাচ্ছে, অভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তীকে বারাসতে প্রার্থী হিসেবে চাইছে বিজেপি। কিন্তু অভিনেতা শারীরিক কারণে ভোটে প্রার্থী হতে রাজি হচ্ছেন না। তিনি শুধু প্রচারের দায়িত্বে থাকবেন বলে দলকে জানিয়ে দিয়েছেন। এখন দেখার, দল জেলার নেতাদের কাউকে টিকিট দেবে, নাকি অন্য কোনও সেলেব্রিটি মুখ এনে কাকলি ঘোষ দস্তিদারের বিরুদ্ধে লোকসভা ভোটের প্রচারে ঝাঁপাবে!