সাংগঠনিক দুর্বলতা সেই সঙ্গে এনআরসি বিরােধী প্রচার, এই দুই জোড়া ফলায় কুপােকাত হয়েছে বিজেপি। ভিটেমাটি হারানাের ভয় গ্রাস করেছিল মানুষজনকে। যারা একসময় উজাড় করে সমর্থন করেছিল বিজেপি’কে তারাই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে এই দল থেকে। অসমে এনআরসি জ্বলন্ত সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৯ লক্ষের নাম বাদ পড়েছিল এই রাজ্যে এনআরসি প্রয়ােগ হওয়ার ফলে।
যদিও অসমে বিজেপি সরকার গড়লেও এখন ব্যাকফুটে রয়েছে তারা। কারণ, জনসমর্থন কমছে। সেই সঙ্গে এনআরসি ইস্যু মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বিজেপি’র কাছেও। এনআরসি’র দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিককে সরিয়ে দিয়েও ড্যামেজ কন্ট্রোল করা সম্ভব হচ্ছে না। এনআরসি নিয়ে বিজেপি’র দীর্ঘমেয়াদী কি পরিকল্পনা রয়েছে তা নিয়েও যথেষ্ট ধোঁয়াশা। যে দলের ওপর মানুষ বিশ্বাস ও আস্থা রাখল, সেই দল ক্ষমতায় আসার পর যারাই তাকে ক্ষমতায় আসতে সাহায্য করল তারাই যদি এর শিকার হন তখন বাস্তবে কি হয় সেই আতঙ্কই তাড়া করে বেড়িয়েছে বাংলার মানুষজনকে।
বঙ্গে এনআরসি’র প্রয়ােগ আদৌ হবে কিনা, হলে কোন পদ্ধতিতে হবে এই আতঙ্কই বিজেপি-বিমুখ করেছে বাংলার সিংহভাগ ভােটারকে। তিনটি বিধানসভার উপনির্বাচনে দ্রুত বিজেপির ভােট ব্যাঙ্কের গ্রাফ কমে যাওয়ায় এই নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ শুরু হয়েছে বিজেপি’র অন্দরে। ইতিমধ্যে বিজেপি নেতা চন্দ্র বসু মুখ খুলেছে প্রকাশ্যেই। বঙ্গবিজয়ের জন্য বিজেপি’কে অন্য কৌশল অবলম্বন করতে হবে। তৈরি করতে হবে অন্য ছক। তা না হলে বাংলার মানুষজন বিজেপি’কে গ্রহণ করবে না। চন্দ্র বসু মুখে বললেও ভােটের পরিসংখ্যান বলে দিচ্ছে বিজেপি’কে এই নিয়ে আত্মসমীক্ষা করতে হবে দলের মধ্যে।
অন্যদিকে, মাত্র ছ’মাসের মধ্যে নিজেদের হারানাে জমি ফিরে পেয়ে বেজায় খুশি তৃণমূল নেতৃত্ব। দলীয় নেতা-কর্মীরা রীতিমত চাঙ্গা। কয়েক মাসের মধ্যে অন্যান্য ভােটের দিনক্ষণ ঘােষণা হলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ, বেশ কয়েকটি পুরসভার মেয়াদ পেরিয়ে গিয়েছে। ২০২০-র সুচনালগ্নেই শতাধিক পুরসভার মেয়াদ পেরিয়ে যাবে। স্বাভাবিকভাবে নির্ধারিত সময়ে ভোট করার শাসকদলের পক্ষে এটাই শুভ সময় বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহলের একাংশ। কারণ, তিনটি উপনির্বাচনের সাফল্যে টগবগ করে ফুটছে তৃণমূল স্তরের নেতা-কর্মীরা। আঁচ গরম থাকতে থাকতেই রুটি সেঁকে নেওয়ার কাজটা ভালাে, এমন কথাও শােনা যাচ্ছে বুথস্তরে। ভােটে যাওয়ার এটাই সেরা সময় বলছেন তারা।
সেই সঙ্গে বর্তমানে বিরােধীদের অবস্থাও ছন্নছাড়া। পরিসংখ্যান বলছে, এবার বামেদের ভােট আর রামেদের ঝুলিতে যায়নি। উল্টে চলে গিয়েছে শাসকশিবিরে। কারণ, সিংহভাগ মানুষ মনে করেছে বিজেপিকে রুখতে হলে নিখাদ বিরােধিতা করতে হবে। বাম-কংগ্রেস জোটকে ভােট দিলে ভােট কাটাকাটির খেলায় বিজেপি’রও জিতে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকত। সেই সম্ভাবনার শুরুতেই নির্মূল করতে দ্বিতীয় বিকল্পের কথা না ভেবে তৃণমুলকেই সরাসরি সমর্থন করেছেন মানুষজন। সেই সঙ্গে সংখ্যালঘু ভােট ব্যাঙ্কে বাম ও কংগ্রেস জোট থাবা বসাতে পারে, এমনটাই ভাবা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল সংখ্যালঘু ভােটব্যাঙ্ক তৃণমূলের সঙ্গেই রয়েছে। সেকারণে তৃতীয় শক্তি হিসেবেই সন্তুষ্ট থাকতে হল বাম-কংগ্রেস জোটকে। আগামী দিনে ঠিক কোন ফর্মুলায় বাম-কংগ্রেস চলবে তা নিয়ে যথেষ্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়ােজন আছে।
এদিকে, তিনটি উপনির্বাচনে বিপুল জয়ে রীতিমত আত্মবিশ্বাসী তৃণমুল সুপ্রিমাে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। খুব শীঘ্রই তিনি তিন কেন্দ্রে যাচ্ছেন এখানকার মানুষজনকে ধন্যবাদ জানাতে। তবে, বসে নেই তৃণমূল সুপ্রিমাের বিশ্বস্ত সেনাপতি শুভেন্দু অধিকারী, রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়, মহুয়া মৈত্ররা। শুভেচ্ছার বন্যায় ভাসছেন তাঁরা। পরিস্থিতি এমন জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে মােবাইল হ্যাং হওয়ার উপক্রম। হােয়াটস অ্যাপ, ফোন এবং মেসেজে নেতাদের দিশেহারা অবস্থা। তবুও তার মধ্যে থেকে বেছে বেছে পাল্টা অভিনন্দন জানানাের পালা চলছে। রীতিমত ক্রেজ বেড়ে গিয়েছে শুভেন্দু অধিকারীর। একই অবস্থা রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় ও মহুয়া মৈত্রেরও।
হেরে যাওয়া ম্যাচকে শুধু জিতিয়ে দেওয়াই নয়, দলকে সম্মানজনক জায়গায় পৌছে দেওয়ার এই অসম লড়াইকে কুর্নিশ জানিয়েছেন খােদ তৃণমূল সুপ্রিমাে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আত্মতুষ্টির কোনও অবকাশ নেই। এই ভােটব্যাঙ্ককে ধরে রেখে নাগরিক পরিষেবা প্রদানকে তৃণমূল স্তরে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষে ফের মঙ্গলবার খড়গপুরে যাচ্ছেন রাজ্য মন্ত্রিসভার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার দলীয় পর্যবেক্ষক শুভেন্দু অধিকারী। খড়গপুরকে পাখির চোখ করে এগােচ্ছেন তিনি। বিজেপি যাতে আর কোনও ভাবে হারানাে জমি পুনরুদ্ধার করতে না পারে, সেকারণেই একদিকে দলীয় সংগঠনকে চাঙ্গা করে রাখা, অন্যদিকে নির্বাচনের আগে যে প্রতিশ্রুতি খড়গপুরের মানুষজনকে মন্ত্রী দিয়েছিলেন, সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ করার মাধ্যমেই বিজেপি’র কফিনে পেরেক ঠকতে চান এই নেতা।
কালিয়াগঞ্জেও এই একই কায়দায় চলতে চান শুভেন্দু। সংখ্যালঘু মানুষজনের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের ভিটেমাটি হারানাের ভয়কে মন থেকে দূর করে তাদের পাশে থাকার মাধ্যমেই কালিয়াগঞ্জের মানুষজনের সঙ্গে সখ্যতাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে চান মন্ত্রিসভার এই সদস্য। রবিবার শুভেন্দুর কালিয়াগঞ্জের সভায় উপচেপড়া ভিড় প্রমাণ করে বাংলার মন এখন তৃণমূলের সঙ্গেই রয়েছে।
অন্যদিকে, করিমপুর তার ভােটব্যাঙ্ক অটুট রেখেছে। ছ’মাসের মধ্যে দু’টি কেন্দ্রে বিজেপির ভােটব্যাঙ্কে বিপর্যয় এলেও করিমপুর কিন্তু তৃণমূলের পক্ষেই সায় দিয়েছে। স্বাভাবিকভাবে এটা বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না বাংলার সচেতন জনগণ খুব সচেতন ভাবেই ভােটাধিকার প্রয়ােগ করে তারা তৃণমূলকে বেছে নিয়েছে। তাদের মনে হয়েছে, বিজেপি’ কে রুখতে একমাত্র তৃণমূলই পারে। ফলে লড়াইটা এখন সরাসরি। মাধ্যম হিসেবে বাম-কংগ্রেস অনেকটা পিছিয়ে গিয়েছে জনগণের পছন্দের তালিকা থেকে।
এটাই এখন বাম-কংগ্রেসের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ। তৃণমূল ঘুরে দাঁড়াতে পারলে ছ’মাসের মধ্যে বামেরা পারবে না কেন, তা নিয়েও আলােচনা কোনও অংশে কম নয়। কারণ প্রামাণ্য নথি খুজে বের করে মানুষকে সঠিকভাবে দিশা দেখাতে বাম কর্মী-নেতারা নীরবে ঝাপিয়ে পড়েছিল। দুর্গাপুজোর সময় এই নিয়ে প্রচার হয়েছিল ব্যাপকভাবে। কিন্তু ভােটব্যাঙ্কে এর পুরাে ফসলটাই তৃণমূল তুলে নিল। কংগ্রেস অবশ্য অনেকটা দ্বিধাগ্রস্ত। নির্বাচনে সংখ্যাই বড় কথা। ফলে কংগ্রেস তৃণমূলের কাছাকাছি আসে কি না তা নিয়েও জল্পনা রয়েছে। কারণ, কংগ্রেসের মধ্য থেকেই উপনির্বাচনের সময় আওয়াজ উঠেছিল, খড়গপুর আসনটি তৃণমূল কংগ্রেসকে ছেড়ে দেওয়া হােক। কংগ্রেসের বর্ষীয়ান নেতা আব্দুল মান্নান সরাসরি কংগ্রেস হাইকমান্ডকে চিঠি লিখে এই আবেদন জানিয়েছিলেন।
তৃণমূলের প্রতি নরম মনােভাব নিয়ে চলা নেতা এখনও কংগ্রেসের মধ্যে কম নয়। মাস কয়েক আগে ওম প্রকাশ মিশ্র কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে গিয়েছে। আগামী দিনে এই সংখ্যা বাড়লে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ বিধানসভা নির্বাচনের আগে অনেক নেতাই চাইবেন নিজেদের অস্তিত্ব সুনিশ্চিত করতে, সেকারণে নতুন করে কংগ্রেসে ভাঙন দেখা গেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। তবে, লােকসভা নির্বাচনে এরাজ্যে বিজেপি’র ভালাে ফলে শাসকদলের ছােটোখাটো ভাঙনের যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, এই তিনটি কেন্দ্রে উপনির্বাচনের ফলাফলে সেই সম্ভাবনা অনেকাংশেই কমে গেল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সেই সঙ্গে বিজেপি তৃণমূল কংগ্রেসের বুথ এবং অঞ্চল স্তরে যে দলীয় কার্যালয়গুলি দখল করে নিয়েছিল তার সিংহভাগ অংশই শাসকদল পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে। সেই সঙ্গে প্রায় সব পুরসভাই যেগুলি বিজেপি গণতান্ত্রিকভাবে দখল নিয়েছিল, তৃণমূলও দলবদলের সেই কৌশল প্রয়ােগ করে তা পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে।
সব মিলিয়ে বাংলার রাজনৈতিক অবস্থায় এখন তৃণমূল অনেকটাই ফ্রন্টফুটে। যদিও লােকসভা নির্বাচনের পরে পরে রাজনৈতিকভাবে বেশ খানিকটা বেকায়দায় পড়ে যায় শাসকদল। উত্তরবঙ্গে তৃণমূল কিছুটা জমি ফিরে পেয়েছে, এমনটাই বলছে পিকে’র রিপাের্ট। আগামী দিনে জনসংযােগকে আরও নিবিড় করে বিজেপি-মুক্ত পশ্চিমবঙ্গ করার দিকে তৃণমূল ঝাপাবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সেকারণে আগামী শতাধিক পুরসভার নির্বাচন তৃণমূলের কাছে নিঃসন্দেহে বড়সড় চ্যালেঞ্জ।
অন্যদিকে, বিজেপির কাছে এই পুরভােট অনেকটা বাংলার মানুষের মধ্যে নিজেদের আস্থা ও বিশ্বাস ফিরে পাওয়ার। যদিও কাজটা যথেষ্টই কঠিন। কারণ, মানুষের মধ্যে জমি কিংবা ভিটেমাটি হারানাের ভয় একবার ঢুকে গেলে তা থেকে তাদেরকে মুক্ত করা এতটা যে সহজ নয়, অতীতের ঘটনা তার বড় প্রমাণ। নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর আন্দোলন তৈরি হয়েছিল ভিটেমাটি হারানাের ভয়কে কেন্দ্র করে। যার জন্য ক্ষমতার মসনদ থেকে সরে যেতে হয়েছিল বামেদের। বিজেপি এনআরসি সেই ভিটেমাটি হারানাের ভয়কেই উসকে দিয়েছে, ফলে মানুষের মধ্যে বসত করার জন্য যে জায়গা বিজেপি’র প্রয়ােজন তা এই সীমিত সময়ের মধ্যে হবে বলে মনে হয় না।