করিমপুর বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থী বিমলেন্দু সিংহ রায় ১৪ রাউন্ড গণনার শেষে ২৪ হাজার ১১৯ ভােটে জয়ী হলেন। সকাল সাড়ে আটটায় শুরু হওয়া গণনা শেষ হতে বিকেল গড়িয়ে গেল। বিমলেন্দুবাবু পান ১ লক্ষ ২ হাজার ৬১১টি ভােট। বিজেপির হেভিওয়েট প্রার্থী জয়প্রকাশ মজুমদারের ঝুলিতে আসে ৭৮ হাজার ৫০২টি ভােট। একমাত্র সংখ্যালঘু প্রার্থী বাম-কংগ্রেস জোটের পক্ষে সিপিএমের গােলাম রাবি পান ১৮ হাজার ৬১৫ ভােট। করিমপুর ১ এবং ২ মিলিয়ে সংখ্যালঘু ভােট ৪২ শতাংশের উপরে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই ভেবেছিলেন জোটের প্রার্থী সংখ্যালঘু ভােট কেটে তৃণমূলের বাড়া ভাতে ছাই দিতে পারে। সুবিধা পেতে পারে বিজেপি প্রার্থী। কার্যত দেখা গেল জোট প্রার্থী কোনও চাপই ফেলতে পারেনি।
গত লােকসভা নির্বাচনে মুর্শিদাবাদ লােকসভা কেন্দ্রের অধীন করিমপুরে কংগ্রেস ২২ হাজার ভােট এবং সিপিএম ১৭ হাজারের মতাে ভােট পায়। উপনির্বাচনের ফল বলছে জোট শরিক কংগ্রেসের ভােট তাে সিপিএম প্রার্থী পায়ইনি, উপরন্তু বামেরাও তাদের ভােট ঠিকমতাে ধরে রাখতে পারেনি। এক্ষেত্রে রসায়ন হিসেবে হিন্দু, মুসলিম নির্বিশেষে সকলের মধ্যে এনআরসি আতঙ্ক কাজ করেছে বলে স্পষ্টতই বােঝা যায়। বিশেষত সংখ্যালঘুদের মধ্যে এর প্রভাব ব্যাপক।
এদিকে করিমপুর ১ নং ব্লকে বিজেপির বেশ কয়েকটি গ্রাম পঞ্চায়েত রয়েছে। এখানে মুসলিম ভােটার প্রায় ৩১ শতাংশ আর ২ নং ব্লকে সংখ্যালঘু ভােটার ৬০ শতাংশ। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে ১ নং ব্লকেও বিজেপি সুবিধা করতে পারেনি। গত লােকসভা নির্বাচনে করিমপুর বিধানসভায় তৃণমূল ১৪ হাজারের মতাে ভােটে এগিয়েছিল। তার আগে ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের মহুয়া মৈত্র ১৫ হাজার ৯৯৮ ভােটে জয়ী হয়েছিলেন। কিন্তু এবার উপনির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থীর জয় আগের সব হিসাবকে ছাপিয়ে গেল। মুসলিমরা যেমন দলবদ্ধভাবে বিজেপির বিরুদ্ধে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী তৃণমূলকে ভােট দিয়ে জিতিয়েছে, পাশাপাশি সীমান্ত সংলগ্ন তপশিলি জাতি, উপজাতি এবং মতুয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে এনআরসি ভীতিও তৃণমূল প্রার্থীকে বিপুল ভােটে জয়ী হতে সাহায্য করেছে, এমন অভিমত তথ্যাভিজ্ঞ মহলের।
একেবারে সবুজ ঝড়। এনআরসি গুরুত্বপূর্ণ ইস্য হয়ে উঠল। করিমপুর আইটিআই কলেজে গণনা যতই এগোয় সমানুপাতিক হারে তৃণমূলের মার্জিনও বাড়তে থাকে। ভােটের দিন বিজেপি প্রার্থী জয়প্রকাশ মজুমদার সংখ্যালঘু প্রধান করিমপুর ২ নং ব্লকেই বেশি ঘােরাঘুরি করেন। তুলনায় তৃণমূলের জয়ী প্রার্থী বিমলেন্দু সিংহ রায় বেশি সময় দেন ১ নং ব্লকে। সংখ্যালঘু ভােটের উপর করিমপুরের জয়ী প্রার্থীর ভাগ্য অনেকটা নির্ভর করছে, তা ২৫ নভেম্বর ভােটের দিন দৈনিক স্টেটসম্যানের প্রথম পাতায় প্রিভিউতেই প্রকাশ পায়।
ভােটের দিন পিপুল খােলার ৩২, ৩৩নং বুথে মিয়াঘাট ইসলামপুরে প্রাইমারি স্কুলে বিক্ষোভ, ধাক্কাধাক্কির মধ্যে এক ব্যক্তির সজোরে লাথি খেয়ে পাশের জঙ্গলে ডিগবাজি খেয়ে পড়েন বিজেপি প্রার্থী জয়প্রকাশ মজুমদার। কিন্তু ভােটের ফলাফল থেকে দেখা যাচ্ছে করিমপুর ২ নং ব্লকে বিজেপির কাছে অভিশপ্ত এই বুথ দুটির মধ্যে ৩২ নং বুথে তৃণমূল পেয়েছে ৭০৭টি ভােট, বিজেপি ২ ভােট এবং জোটপ্রার্থী ২৭ ভােট। আর ৩৩ নং বুথে তৃণমূল পেয়েছে ৬৩৪ ভােট, বিজেপি ৩৮ এবং জোট ১০৪টি ভােট।
প্রসঙ্গত অসম এবং পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে পার্থক্য আছে। ভােট প্রচারের প্রথম দিনেই বিজেপি প্রার্থী জয়প্রকাশ মজুমদার বলেছিলেন, অসমে যেসব জায়গায় এনআরসি লাগু হযেছে, লােকসভা নির্বাচনে সেখানে বিজেপির ফল ভালাে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে তিনটি উপনির্বাচনের ফল প্রমাণ করছে, অসম এবং পশ্চিমবঙ্গের মাটির মধ্যে আকাশ জমিন ফারাক। যে সংখ্যালঘু এবং সীমান্ত অঞ্চলে বসবাসকারী উদ্বাস্তু হয়ে আসা আমজনতা একসময় বামেদের ভােট ব্যাঙ্ক ছিল, আজ তারা তৃণমূলে। এনআরসি’র আসন্ন সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়ে আজ তারা তৃণমূলের সঙ্গে। এনআরসি’কে কেন্দ্র করে মেরুকরণের রাজনীতি হলফ করে বলা যায় মানুষকে ভীতসন্ত্রস্ত করছে। এবার কাউন্টার লড়াইয়ে জিতল তৃণমূল।
এবারের উপনির্বাচন ছিল তৃণমূলের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ। ২১-এ বিধানসভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থাকবেন কিনা, এটাই ছিল প্রধান প্রশ্ন। সামনের বছর একশােটির উপর পুরসভা নির্বাচন। সবমিলিয়ে তৃণমূল, বিজেপির মধ্যে সেয়ানে সেয়ানে লড়াইয়ে এগিয়ে গেল তৃণমূল। তৃণমূলের নদিয়া জেলা পর্যবেক্ষক মন্ত্রী রাজীব ব্যানার্জি বলেন, ‘মানুষের উন্নয়নের পক্ষে এবং রাজ্যে এনআরসি করতে দেব না- নেতৃত্বের এই বক্তব্য মানুষের কাছে নিয়ে গিয়েই সফলতা এসেছে’। বাম-কংগ্রেস জোট হয়েও বামেদের ফল খারাপ। অনেক বাম ভােটও তৃণমুলে গিয়েছে। কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে সংগ্রামী বাম জোট গড়ার দাবি আছে সিপিআই (এমএল) লিবারেশনের।
লিবারেশনের রাজ্য সম্পাদক পার্থ ঘােষ বলেন, ‘গণ-আন্দোলন ও গণ সংগঠনকে শক্তিশালী না করে কোনও দক্ষিণপন্থী দলের পিছু পিছু চলার ভ্রান্ত নীতি আরেকবার প্রতিফলিত হল, তিন বিধানসভার উপনির্বাচন সেটাই প্রমাণ করে। সিপিএমের নদিয়া জেলা সম্পাদক সুমিত দে বলেন, ‘বিভাজনের রাজনীতির প্রভাব রয়েছে। এনআরসি’র আতঙ্ক থেকে মানুষ ভেবেছে রাজ্য সরকার ভূমিকা নিতে পারে। যদিও আমরা এটা বিশ্বাস করি না। কংগ্রেসের ভােট কেন আমাদের দিকে এল না তার সমীক্ষা হবে’।