নাগরিকত্ব সংশােধনী আইনের প্রতিবাদে গণআন্দোলনে বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর কথা এখন গােটা দেশের অন্যতম আলােচ্য বিষয়। নয়া নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় দিন ফের পথে নামলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সঙ্গে ছিলেন সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ। বাংলার এই নবজাগরণে মমতার পাশে এবার বাংলার সেলেব মহল। তাঁর সাথেই যাদবপুরের ৮ বি বাসস্ট্যান্ড থেকে পথে নেমে প্রতিবাদ মিছিলে পা মেলান গৌতম ঘােষ, সােহম, দুই নবাগতা সাংসদ মিমি চক্রবর্তী ও নুসরত জাহান।
এর পাশাপাশি কেন্দ্রের জনবিরােধী আইনের প্রতিবাদে মমতার সঙ্গে সুদীর্ঘ পথ হাঁটল অগনিত মানুষের মিছিল। যেভাবে শুক্রবার থেকে জেলায় জেলায় বিদ্বেষের আগুন ছড়িয়ে পড়ছিল। যা দেখে বাড়ি থেকে বেরতে ভয় পাচ্ছিলেন রাজ্যের মানুষ। তা সােমবার থেকে থেকে তৃণমূল সুপ্রিমাের শান্তিপূর্ণ পদযাত্রার পরেই বিদ্বেষের আগুন ক্রমশ প্রশমিত।
যাদবপুরে দ্বিতীয় দিনে পদযাত্রার প্রারম্ভে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী প্রতিবাদের মঞ্চ থেকেই তাঁর মায়ের মৃত্যুদিনের কথা স্মরণ করেন। লণ্ডনে যাওয়ার এক পুর্বাভিজ্ঞতার কথা সাধারণ মানুষের সঙ্গে ভাগ করে নেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর। ২০১১ সালের এই দিনেই তাঁর মা গায়ত্রী দেবী প্রয়াত হন। সে কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আজ যদি আমার মায়ের জন্মদিন জানতে চাওয়া হয়, আমি তা কোথায় পাব?’ এক নাগরিকত্ব আইন নিয়ে গােটা দেশে যখন আশঙ্কার আগুনে জ্বলছে। অসমে এনআরসি রূপায়নের বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখে ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম বাংলা থেকে শহরে সর্বত্র। সেখানে আট থেকে আশির ভবিষ্যত কি হতে চলছে তা প্রায় কারােরই জানা নেই।
সেই কথা উল্লেখ করেই মমতা কেন্দ্রের শাসক দল মােদি-শাহের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন, বর্তমানে ইনস্টিটিউশনাল ডেলিভারি হচ্ছে, কিন্তু আগে কি ছিল? মা দিদিমাদের জন্মের শংসাপত্র কোথা থেকে আনবে এ দেশের মানুষ। সেই সময় ঘরে ঘরে দাইমা প্রসবে সাহায্য করতে। নাগরিকত্ব সংশােধনী আইন তাহলে সেই সময়কার প্রবীন মানুষদের কোথায় ঠাই হবে?
বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই উত্তর এখন খুঁজছে গােটা দেশ। দেশবাসীকে ঘুনাক্ষরে কিছু বুঝতে দিয়েই রাতারাতি যে আইনের সৃষ্টি তা নিয়েও তিনি প্রশ্ন তুলেছেন এদিন। এক আইনে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সৃষ্টি হয়েছে চরম অরাজকতার পরিবেশ। সে আইন কার্যকর হলে কি হতে পারে? তাও প্রশ্ন রেখে গিয়েছেন তৃণমূল সুপ্রিমাে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
তিনি বলেন, ‘পােশাক দেখে নাকি বােঝা যায় কারা আন্দোলন করছে। আমি একটা পােশাক পরে আছি, দেখুন তাে চিনতে পারছেন কিনা। আমি জানি না পােশাক দেখে কিভাবে বােঝা যায় কারা আন্দোলন করছে’। দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মােদি থেকে শুরু করে বিজেপির একের পর এক নেতার পােশাক নিয়ে অশান্তি ছড়ানাের ইঙ্গিতকে এইভাবেই যাদবপুরে মঞ্চ থেকে কটাক্ষ করেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
টাকা দিয়ে বিজেপি হিংসার পরিবেশ সৃষ্টি করছে বলেও সরব হন তিনি। তীব্র ভাষায় তার সমালােচনা করেন দেশের চুড়ান্ত অর্থনৈতিক দুরাবস্থায় মানুষের কথা না ভেবে নয়া নাগরিত্ব আইন নিয়ে আসা মানুষের চোখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে রাখার চেষ্টা করা বলেও মনে করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
পাশাপাশি এদিন তিনি জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যেভাবে পড়ুয়া নিগ্রহ করা হয়েছে তা নিয়ে সবর হন। মানুষের মধ্যে সম্প্রতির পরিবেশ অক্ষুন্ন রাখতে রবি ঠাকুরের রাখি বন্ধন উৎসবের কথা স্মরণ করেন। শহর থেকে গ্রামে সাংস্কৃতিক জাগরণের বার্তা দেন।
জেলায় জেলায় যে ঘটনাগুলি ঘটেছে তার ভয়াবহ পরিনতি থেকে বাঁচতেই বেশ কিছু ট্রেন বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। উত্তরবঙ্গের সঙ্গে রেল যােগাযােগ ব্যবস্থা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। তাই নিয়ে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে যাদবপুরের মঞ্চ থেকে সরব হন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘দুটো ছােট ছােট ঘটনা হয়েছে। আর দুরপাল্লার ট্রেন বন্ধ করে দিয়েছে’।
এরপরেই মমতার নেতৃত্বে যাদবপুর ৮ বি বাসস্ট্যান্ড থেকে গােলপার্ক, গড়িয়াহাট হয়ে রাসবিহারি দিয়ে যদুবাবুর বাজারে পদ্যাত্রা শেষ হয়। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে এক পলক দেখতে সুদীর্ঘ পথে উপচে পড়ে মানুষ। কর্মব্যস্ত দিনেও ভিড়ে ঠাসা রাজপথ।
যদুবাবুর বাজারে মিছিল শেষের চিন্তাভাবনার কারণও তিনি সেই মঞ্চ থেকেই মানুষকে জানান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যদুবাবুর বাজার শহরের অন্যতম কসমােপলিটন এলাকা। এখানে নানা ভাষা নানা জাতির মানুষের সহাবস্থান। যেখানে নয়া নগরিকত্ব আইনে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ সৃষ্টি করতে চাইছে কেন্দ্রের বিজেপি শাসিত সরকার, তার প্রতিবাদেই এই অঞ্চলে মিছিল শেষ করার ভানা বলেও জানান তিনি।
নয়া নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ করেন বাংলা। আজ বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে একে একে ছত্তিশগড়, পাঞ্জাব, দিল্লি, কেরল, মধ্যপ্রদেশ সামিল হয়েছে। মহারাষ্ট্রও কড়া ভাষায় কেন্দ্রে জনবিরােধী আইনের সমালােচনা করেছে। এভাবে এমন একটা সময় আসবে যখন বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিও বলবে এনআরসি, ক্যাব ‘নেহি করেঙ্গে, নেহি করেঙ্গে’ বলে মন্ত্ৰব্য করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই নয়া আইনের প্রতিবাদে তিনি যেভাবে ‘নাে এনআরসি, নাে ক্যাব’ ব্যাজ পরেছেন পড়ায় পাড়ায় স্কুলে, কলেজে, সাধারণ মানুষকেও সেই ব্যাজ পরে প্রতিবাদের আহ্বান জানান তিনি।