ভালো কাজ করতেই হবে। এক্ষেত্রে কোনও আপস করা যাবে না। বৃহস্পতিবার নবান্নে প্রশাসনিক বৈঠক থেকে এ বিষয়ে স্পষ্ট করে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, নতুন বছরে সাধারণ মানুষের বাকি থাকা কাজগুলিতে আপনারা গতি আনবেন এটা প্রত্যাশা করি। যাতে মানুষ খুশি হয়। জীবনে কিছু ভালো কাজ করলে সেটাই থেকে যায়। টাকা থাকে না। ভালো কাজ করলে মানুষ তাঁকে চিরদিন মনে রাখে। জনসেবা আপনাদের সামাজিত দায়িত্ব। সরকারটাও কিন্তু আপনার পরিবার। সকলকে বলছি, কর্মে গতি আনুন। কেউ কেউ কর্ম ভেস্তে দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু কর্ম ভেস্তে দেওয়া অত সহজ নয়। আপনি না করলে অন্যরা করবে। ভালো লোক কাজ করার জন্য তৈরি আছে। এটা ভাববার কোনও প্রয়োজন নেই যে আমি ছাড়া চলবে না।
এদিন মুখ্যমন্ত্রী সমন্বয় ও পর্যবেক্ষণ এই দুই মন্ত্রে কাজ চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান। প্রত্যেকটি দপ্তরের কাজকর্ম খতিয়ে দেখেন তিনি। কেউ কোনও সমস্যার কথা তুলে ধরলে তা সমাধানের রাস্তা বলে দেন। জমি জবরদখল ইস্যুতে কড়া অবস্থান নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। দলমত নির্বিশেষে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন তিনি। আগামী ৬ মাসের মধ্যে জমি পুনরুদ্ধারের ডেডলাইনও বেঁধে দেন মমতা। সরকারি জমি জবরদখল করে তৈরি ফ্ল্যাটগুলির মিউটেশন ও পারমিশন নিয়ে আধিকারিকদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘নতুন করে জমি জবরদখল হলে আইসি, এসপি, বিডিও, জেলাশাসকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। মন্ত্রী, কাউন্সিলর, পঞ্চায়েত, পুরসভা, নগরোন্নয়ন দপ্তর– কাউকে রেয়াত করব না। আইন সবার জন্য সমান।’
এই ইস্যুতে সরকারি সম্পত্তি ক্রোক করারও হুঁশিয়ারি দেন মমতা। কোনও নেতা–মন্ত্রীদের তাঁবেদারি যে তিনি আর সহ্য করবে না তা–ও স্পষ্ট করে দেন। যারা অনুমতি দিয়েছে তাঁদের ব্ল্যাকলিস্ট করার নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। কোন কোন সরকারি জমি জবরদখল হয়েছে তা খতিয়ে দেখতে স্বরাষ্ট্রসচিব নন্দিনী চক্রবর্তীর নেতৃত্বে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে করা হয়।
এদিন রাজ্য সরকারের বাংলার বাড়ি প্রকল্প নিয়ে খোঁজখবর নেন মুখ্যমন্ত্রী। ১২ লক্ষ বাড়ির টাকা ইতিমধ্যেই রাজ্যের তরফে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেই টাকা উপভোক্তাদের কাছে ঠিকমতো পৌঁছাচ্ছে কি না তা প্রশাসনিক বৈঠক থেকে জানতে চান মমতা। পাশাপাশি তিনি ঘোষণা করেন, মে মাসের মধ্যে দ্বিতীয় কিস্তির টাকা পাবেন ১২ লক্ষ বাড়ি প্রাপকরা। ওই মাসেই বাকি ১৬ লক্ষ উপভোক্তারা প্রথম কিস্তির টাকা পাবেন। এরপর ডিসেম্বরে পাবেন দ্বিতীয় কিস্তির টাকা। তারপর মার্চের মধ্যে বাকি টাকা পেয়ে যাবেন। এদিনের বৈঠক থেকে তিনি স্পষ্ট করে দেন, বাংলার বাড়ি প্রকল্পের টাকা বণ্টনে কোনও অনিয়ম হলে কাউকে রেয়াত করা হবে না। বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘পিএইচই, পিডব্লুডি, সেচ ও পঞ্চায়েতের যত কাজ হবে আমাদের শ্রমিক দিয়ে করতে হবে। আমাদের ১০০ দিনের শ্রমিকদের দিয়ে করতে হবে। জল স্বপ্ন প্রকল্প ২০২৫ সালের ডিসেম্বর মাসের মধ্যে শেষ করতে হবে, আমি কোনও কথা শুনব না।’
মমতা প্রতিটি দপ্তর ধরে ধরে কাজের সময়সীমা বেঁধে দেন। তিনি স্পষ্ট করে দেন, জনগণের জন্য টাকা খরচ করতে হবে, নিজেদের আনন্দ করার জন্য নয়। পাশাপাশি বিরোধীদের তথ্য সরবরাহ করা হচ্ছে বলেও সরব হন তিনি। তাঁর কথায়, ‘যাঁরা কম্পিউটারে কাজ করেন, তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগ বিরোধীদের ইনফরমেশন দেয়। ডিএমরা নিজেদের মতো করে লোক নেয়। এসপিরা নিজেদের মতো করে কাজ চালায়। কাঁচা রাস্তাতেও আলু লরি চলে যাচ্ছে। কোথায় গেল আপনাদের নাকা চেকিং।’ আইসিডিএস সেন্টার, মিড ডে মিল পরিদর্শন করা নিয়ে বিডিওদের ভর্ৎসনা করেন মমতা।
সরকারি কর্মীদের উদ্দেশে তাঁর বার্তা, ‘বর্ষা শুরুর আগে, পরীক্ষা করতে গিয়ে, মাঝে মধ্যে উপনির্বাচনের নামে ছুটি কাটানোটা বন্ধ করুন। জানুয়ারি থেকে জুন এটা কাজের সময়। আগামী বছরের প্ল্যান এখন করুন, যাতে এপ্রিল মাসের প্রাথমেই ওয়ার্ক অর্ডার দেওয়া যায়। ২০২৫ সালের সব স্কিমের টাকা ৩১-এ ডিসেম্বরের মধ্যে যেন হয়ে যায় সেটা দেখতে হবে।’
কিছু অফিসারকে ভরা বৈঠকে তিরস্কার করার পাশাপাশি কয়েকজনের প্রশাংসাও করেন মুখ্যমন্ত্রী। এভাবেই সকলের কাজ খতিয়ে দেখে বিভিন্ন নির্দেশ দিলেন রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান। রাজ্য গোয়েন্দা দপ্তরের ভূমিকা নিয়ে এদিন বড় প্রশ্ন তোলেন মুখ্যমন্ত্রী। ডিজি রাজীব কুমারের উদ্দেশে মমতা বলেন, ‘ডিআইবি ডিপার্টমেন্ট করছেটা কী? ওরা তো একটা ইনফরমেশনও দেয় না। অবিলম্বে তাদের বিরুদ্ধে স্টেপ নাও।’
বেআইনি বালি পাচার, সমবায়ে বেনিয়ম, পানীয় জলের পাইপলাইনের কাজ, মিড ডে মিলে অনিয়ম, আলুর কালোবাজারি, দেউচা পাচামির কয়লা খনি ইত্যাদি একাধিক বিষয়ে বিভিন্ন দপ্তরের থেকে কাজের খতিয়ান চেয়েছেন মমতা। প্রশাসনিক বৈঠকে এদিন বীরভূমের জেলাশাসককে রীতিমতো ধমক দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর দাবি, সবচেয়ে বেশি বালি পাচার বীরভূম থেকেই হচ্ছে। পাশাপাশি দেউচা পাঁচামি নিয়েও এদিন ক্ষোভপ্রকাশ করেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি জেলাশাসককে প্রশ্ন করেন, ‘দেউচা পাচামির জন্য খাপছাড়া করে জমি নেওয়া হল কেন? সরকারের রেভিনিউ কেউ নিয়ে চলে যাবে আর তোমরা আঙুল গুটিয়ে বসে থাকবে এটা চলবে না।’
স্বাস্থ্য দপ্তরের কাজকর্ম নিয়েও খোঁজ নেন মমতা। মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের কাছ থেকে স্বাস্থ্য সম্পর্কে অভিমত চান তিনি। প্রয়োজন হলে চন্দ্রিমাকে পছন্দমতো মেডিক্যাল অফিসার নেওয়ার নির্দেশ দেন মুখ্যমন্ত্রী। পাশাপাশি রেফারেল নিয়েও এদিন প্রশ্ন তোলেন মমতা। এই প্রসঙ্গে মমতাকে জানানো হয়, রেফারেল ৭ শতাংশ থেকে কমে ৩ শতাংশে নেমে গিয়েছে। কিন্তু এই ৩ শতাংশও কেন হবে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। মমতার কথায়, ‘৩ শতাংশ রেফারেলও যারা করছে তাঁদের বলুন বাড়িতে ঘুমোতে। পারফরম্যান্স রিভিউ করো।’