• facebook
  • twitter
Saturday, 23 November, 2024

শীতের দুপুরে শহরে টাকার বৃষ্টি

বুধবার ভরদুপুরে আকাশ থেকে টাকার বৃষ্টি হওয়ার সাক্ষী থাকল কলকাতার মানুষ। আর সেই টাকা কুড়াতে হুড়ােহুড়ি পড়ে গেল।

প্রতীকী ছবি

সত্যজিৎ রায়ের গুপী গাইন বাঘা বাইন  ছবির সেই দৃশ্যটার কথা মনে আছে? গুপী আর বাঘা’র মন্ত্রবলে আকাশ থেকে মণ্ডা মেঠাই-এর বৃষ্টি হচ্ছে। তা ধরতে ছুটে ছুটে যাচ্ছে মানুষ। মিষ্টি না হলেও বুধবার ভরদুপুরে আকাশ থেকে টাকার বৃষ্টি হওয়ার সাক্ষী থাকল কলকাতার মানুষ। আর সেই টাকা কুড়াতে হুড়ােহুড়ি পড়ে গেল স্থানীয় দোকানদার, নিরাপত্তাকর্মী এমনকী পথচলতি মানুষের মধ্যেও।

ঘড়ির কাঁটায় তখন প্রায় বেলা পৌনে তিনটে। ব্যস্ত বেন্টিক স্ট্রিটে তখন নতুন পড়া শীতটাকে উপভােগ করতে বেশ কিছু মানুষ ফুটপাতে এসে মিঠেকড়া রােদে গা সেঁকে নিচ্ছে। নিমগাছের পাতাগুলােয় খেলে যাওয়া হাওয়ায় হিমেল শিরশিরানি। ঠিক সেই সময় ২৭ নম্বর বেন্টিক স্ট্রিটের এম কে পয়েন্ট নামে বহুতল বিল্ডিং-এর সাততলা থেকে ঝরে পড়ছে টাকা। পাঁচশাে টাকা, দু’হাজার টাকা, একশাে টাকার কড়কড়ে নােট পাক খেতে খেতে নেমে আসছে মাটিতে। কয়েকটা আটকে গেল নিমগাছের ডালে। কয়েকটা আবার বহুতলের কার্নিসে। কার্নিসের টাকাগুলাে ওয়াইপার দিয়ে ঠেলে ঠেলে নিচে ফেলে দিচ্ছেন ওই বহুতলে থাকা অফিসে কর্মীরা। কয়েকটা বাণ্ডিল করা টাকা সােজা মাধ্যাকর্ষণের টানে নেমে এল মাটিতে। নীচে তখন উৎসাহী মানুষেরা হুমড়ি খেয়ে কুড়ােতে শুরু করেছে। তবে পাশের বিল্ডিংয়ে থাকা অনেকেই অবশ্য তার খবর পেয়েছে অনেক পরে। ততক্ষণে সব শেষ। প্রথমটায় টাকার বৃষ্টি দেখে হতচকিত হয়ে গেলেও পরক্ষণেই মানুষ সেই টাকা কুড়ােতে শুরু করে।

লালবাজার সূত্রের খবর, ২৭ নম্বর বেন্টিক স্ট্রিটের ৭ তলায় রয়েছে হক মার্কেটাইল প্রাইভেট লিমিটেডের অফিস। সেখানে এদিন বিকেলের দিকে ডিআরআই’র অভিযান ছিল। সেই সময়ই ওই বিল্ডিং থেকে নােট বৃষ্টি হতে দেখা যায়। সেখান থেকে এনেককেই টাকা কুড়াতে দেখা গিয়েছে। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছায় হেয়ার স্ট্রিট থানা পুলিশ। সেখান থেকে দাবিদারহীন ৩ লাখ ৭৪ হাজার টাকা বাজিয়েপ্ত করা হয়। এদিন সন্ধে পর্যন্ত স্থানীয় থানায় কোনও অভিযোগ দায়ের হয়নি। স্বাক্ষী হিসেবে ওই বহুতলের নিরাপত্তারক্ষীদের বয়ান নথিভুক্ত করে পুলিশ।

সুত্রের খবর, বুধবার ৮ সদস্যের ডিআরআই’র টিম অতর্কিত অভিযান চালায়। এদিন রাত পর্যন্ত চলে সেই অভিযান। জেরা করা হয় অফিসের কর্মচারীদের। ঘটনাস্থলে এদিন রাত পর্যন্ত উৎসুক মানুষের ভিড় ছিল রীতিমতাে চোখে পড়ার মতাে। টাকা পড়ার দুর্লভ দর্শন না পেলেও আশেপাশের বহু মানুষই এই খবর পেয়ে এবার এমকে পয়েন্ট বিল্ডিংয়ের গেটের বাইরে এসে চাক্ষুস করে যাচ্ছে।

ওই বহুতলের ঠিক উল্টো দিকের ফুটপাথেই রয়েছে এক শীত পােশাকের স্টল। তার মালিক বললেন, টাকা পড়া শুরু হতেই হঠাৎ করেই দেখি টাকা কুড়ানাের ভিড় জমে গিয়েছে। ততক্ষণে বিল্ডিংয়ের ছােট্ট গেটটি যেটি সব সময় খােলাই থাকে তা বন্ধ করে দেয় নিরাপত্তারক্ষীরা। বেসমেন্টে তখন টাকা কুড়ানাের হিড়িক। তার মধ্যেই ঢুকে পড়েছে বাইরের কিছু লােকও বলে জানান তিনি। খবর শুনেই বহু লােক ভিড় জমাতে শুরু করে বহুতলের গেটের বাইরে। ওর মধ্যে যাতে নিজের দোকারে জিনিসপত্র চুরি না হয়ে যায় তাই ফোন করে নিজের এক বন্ধুকে ডেকে নিয়েছিলেন বলেও জানালেন ওই হিন্দিভাষী হকার।

প্রায় একই কথা জানালাে বছর ২০-এর মােহন। পাশেই তাদের মােবাইল ফোনের দোকান। টাকা পড়ার খর পেয়েই সেও ছুটে গিয়েছিল। কিন্তু ঢুকতে পারেনি। তার কথা অনুযায়ী, বিল্ডিংয়ের ভিতরে ছিল ওদের নিজেদের লােকজন আর নিরাপত্তা রক্ষীরা। তারাই সব টাকা কুড়িয়েছে। প্রায় দশ থেকে বারােজন লােক ছিল সেই সময় বিল্ডিং কম্পাউন্ডের ভিতর।

এই ঘটনারই অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী বহুতলের এক নিরাপত্তারক্ষী পুলিশের কাছ গােটা ঘটনা জানিয়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই রক্ষী জানালেন, টাকা পড়ার আগেই হক মার্কেন্টাইল অফিসের কর্মীরা নীচে নেমে আসে। এরপরেই সাততলায় ওই অফিসের ডানদিকে ওয়াশরুমের জানালা দিয়ে নােটের বাণ্ডিল পড়তে শুরু করে। পরে সামনের দিকের কাচের জানালা খুলেও ৫০০ ও দু’হাজার টাকার বাণ্ডিল ফেলা হয়েছে। তবে পাঁচশাের বেশি দু’হাজার টাকার বান্ডিল কম ছিল। তবে অধিকাংশ নােট কুড়িয়েছে ওই অফিসের কর্মচারীরাই বলে জানিয়েছেন তিনি। বেলা তিনটের পর এই ঘটনার সূত্রপাত। চলে বড়জোড় ১০ থেকে ২০ মিনিট। ঘটনার সময় বহুতলে তিনি ছাড়াও ছিল আরও চার নিরাপত্তারক্ষী ছিল বলে জানান।

বেন্টিক স্ট্রিটের এই এলাকায় বহু চাটার্ড ফার্ম ছড়িয়ে রয়েছে। সেই চাটার্ড ফার্মগুলির আড়ালে ভুয়াে ব্যবসা চলে, এমন অভিযােগও রয়েছে। নােটবন্দির সময়েও কলকাতার বিভিন্ন অফিস থেকে বান্ডিল বান্ডিল টাকা ফেলে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছিল। বড় বাজারেও এমন ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গিয়েছে। সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল আবার। সত্যজিৎ রায়ের পরশপাথর  ছবির সংলাপে ছিল, ‘কলকাতায় টাকা ওড়ে, শুধু ধরতে পারলেই হল’। বুধবার বেন্টিক স্ট্রিটে টাকার বৃষ্টি কলকাতার রাস্তায় টাকা ওড়ার প্রবাদটাকেই সত্যি করে দিল।

ওই বেওয়ারিশ টাকার অনেকটাই উদ্ধার করা গেলেও কিছু নােট যে কিছু মানুষের পকেটস্থ হয়েছে তা নিয়ে কানাঘুষাে করছেন স্থানীয় দোকানীরাই। তাদের কথা অনুযায়ী, প্রায় বিশ ত্রিশ লাখের উপরে টাকা ফেলেছে। তবে প্রশ্ন হল এই টাকার বৃষ্টির নেপথ্যের কারণটা। হিসেব বহির্ভূত টাকা বলেই ডিআরআই’র তদন্তাকরী অফিসারদের চোখে ফাঁকি দিতে ওই টাকা থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছিল বলে মনে করা হচ্ছে। ওই আকাশ থেকে পড়া টাকাকে কালাে টাকা, পাপের টাকা যে তকমা দেওয়া হােক না কেন, ওই টাকায় মুদ্রিত গান্ধিজির গায়ে কিন্তু এতটুকু মালিন্য লাগেনি।