কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে উঠল একাধিক প্রশ্ন

নির্বাচন কমিশনের দফতর (File Photo: IANS)

পশ্চিমবঙ্গে শেষ হয়ে গেল সপ্তম এবং শেষ দফার ভােটের প্রচার। স্বাভাবিকভাবে শুত্রবার বিকেল পাঁচটায় শেষ হওয়ার কথা নির্বাচনী প্রচারের। কিন্তু বুধবার রাতে এক নির্দেশনামায় নির্বাচন কমিশন জানিয়ে দেয়, সপ্তম দফা ভােটের নটি কেন্দ্রে প্রচার শেষের সময়সীমা শুক্রবার বিকেল পাঁচটার পরিবর্তে বৃহস্পতিবার রাত দশটায় এগিয়ে আনা হয়েছে।

সংবিধানের ৩২৪ ধারা প্রয়ােগ করে প্রচারের সময় ছাঁটার নজির এ রাজ্যে তাে বটেই, গােটা দেশে কোথাও আছে কিনা, মনে করতে পারছে না রাজনৈতিক মহল। কমিশন সুত্রেও বলা হচ্ছে এমন পদক্ষেপ সম্ভবত এই প্রথম।

মঙ্গলবার বিজেপি প্রেসিডেন্ট অমিত শাহের রােড শাে’য়ে নজিরবিহীন তাণ্ডব প্রত্যক্ষ করে কলকাতা, রােড শাে থেকে তাণ্ডব চালানাের অভিযােগ ওঠে বিদ্যাসাগর কলেজে, যেখানে ভাঙা পড়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দ্বিশতবর্ষে তাঁর নিজস্ব মুর্তি। বিজেপি পাল্টা অভিযােগ করে মুর্তিটি ভেঙেছে তৃণমূল।


ঘটনার পর দিল্লিতে এক সাংবাদিক বৈঠকে অমিত শাহ দাবি করেন তাঁর নাকি প্রাণ সংশয়ের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকায় এ যাত্রায় তিনি বেঁচে গেছেন। এই প্রেক্ষিতে বুধবার নির্বাচন কমিশন এক সাংবাদিক বৈঠকে জানিয়েছে, তারা পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে ভােটে প্রচারের সময় ছাঁটার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

নির্বাচন কমিশনের এই সিদ্ধান্তকে বিজেপির ষড়যন্ত্র বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর মন্তব্য বিজেপির নির্দেশেই বাংলার গণতন্ত্রকে ধ্বংস করছে নির্বাচন কমিশন। এই বক্তব্যগুলি ‘রাজনৈতিক’ বলে মনে হতে পারে কিন্তু বাংলায় প্রচারের সময় এগিয়ে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত কয়েকটি অপ্রীতিকর প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। যার ফলে মমতার রাজনৈতিক বক্তব্যও বাস্তব ঘটনাগুলির দিকে ইঙ্গিত করে। যার উত্তর না পাওয়া গেলে এই নির্বাচন কমিশন কিন্তু ভারতের গণতন্ত্রের ইতিহাসে পক্ষপাতদুষ্ট হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে থাকবে।

প্রশ্ন:১- মঙ্গলবার মথুরাপুরে অমিত শাহ তাঁর জনসভায় প্রকাশ্যেই চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে বলেছিলেন আমি ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দিচ্ছি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষমতা থাকলে আমাকে গ্রেফতার করে দেখান। তারপর সেখানে তিনি রীতিমতাে সভায় উত্তেজনা ছড়িয়ে একাধিকবার ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দিয়েছিলেন। সেখান থেকে তিনি কলকাতায় আসেন তাঁর সেই বহুচর্চিত রােড শােয়ে যােগ দিতে। তাঁর রােড শােয়ে শয়ে শয়ে রামহনুমানের সাজসজ্জায় সজ্জিত বহু বিজেপি কর্মী যােগ দিয়েছিল, যাদের মুখে ছিল ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান। নির্বাচনী প্রচারে অমিত শাহ এভাবে খােলাখুলি ধর্মীয় ভাবাবেগকে উস্কে দেওয়ার পর নির্বাচন কমিশন স্বতঃপ্রণােদিত হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি কেন?

প্রশ্ন:২- নির্বাচন কমিশন মঙ্গলবার কলকাতায় হিংসার ঘটনার জন্য পশ্চিমবঙ্গে প্রচারের সময়সীমা এগিয়ে আনল। এটা যদি তৃণমূল এবং বিজেপির বিরুদ্ধে শাক্তিমূলক ব্যবস্থা হয়, তাহলে এর ফলে অন্যান্য রাজনৈতক দল কেন সেই শাস্তি ভােগ করবে? কেন তাদের একদিন আরও প্রচারে সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হল?

প্রশ্ন:৩- নির্বাচন কমিশন যদি কলকাতায় হিংসার জন্য প্রচারের সময় এগিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিল, তাহলে সেটা অবিলম্বে বলবৎ করা হল না কেন? এই সিদ্ধান্ত বুধবার থেকেই বলবৎ করা যেত। তাহলে কমিশন কি জানত বৃহস্পতিবার কোনও হিংসা হবে না, হিংসার ঘটনা ঘটতে পারে শুক্রবার?

প্রশ্ন:৪- পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইতিমধ্যেই অভিযােগ করেছেন যে, নির্বাচন কমিশন বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ভােটের প্রচার চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে, যাতে বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মােদি রাজ্যে তাঁর দুটি জনসভায় বক্তব্য রেখে ভােটের প্রচার শেষ করতে পারেন। পশ্চিমবঙ্গে শুক্রবার নরেন্দ্র মােদির কোনও জনসভার কর্মসূচি আগে থেকেই ছিল না। এই চব্বিশ ঘণ্টার বিলম্বের যাথার্থ্যকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবে নির্বাচন কমিশন?

প্রশ্ন:৫- নির্বাচন কমিশনের এই সিদ্ধান্তের যদি ভিত্তি হয় অমিত শাহের রােড শােয়ে হিংসা, তাহলে অন্য রাজ্যে অনুরূপ হিংসার জন্য একই রকম কড়া ব্যবস্থা কেন নেয়নি কমিশন? গত এপ্রিল মাসে ওড়িশায় একজন নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ম্যাজিস্ট্রেটকে মারধর করার জন্য গ্রেফতার করা হয়েছিল এক বিজেডি’র প্রার্থীকে। সেই রাজনৈতিক হিংসায় কংগ্রেস নেতা নিরঞ্জন পট্টনায়ক সহ ১১ জন আহত হয়েছিলেন? সেখানে কি কোনও কড়া পদক্ষেপ করেছিল কমিশন, যেভাবে তারা করে দেখাল বাংলায়? উত্তর হল, না। এমনকি, পশ্চিমবাংলয়ও দ্বিতীয় দফার ভােটে ব্যাপক গণ্ডগােল এবং হিংসার খবর পাওয়া গিয়েছিল। ষষ্ঠ দফার ভােটেও হিংসার বলি হয়েছিলেন মােট চারজন তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মী ও বিজেপি কর্মী। নির্বাচন কমিশন তখন কোনও কড়া পদক্ষেপ নেয়নি কেন?

নির্বাচন কমিশন অমিত শাহের রােড শাে’তে হিংসার ঘটনার দিকে যদি অঙ্গুলি নির্দেশ করে থাকে, যে হিংসায় বড় রকমের আহত হওয়ার ঘটনার কোনও খবর নেই, তাহলেও কিন্তু সাম্প্রতিক কড়া পদক্ষেপের পেছনে কোনও যুক্তি খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তবে কি এটা কমিশনের অতিরঞ্জিত প্রতিক্রিয়া?

নির্বাচন কমিশন স্বীকার করেছে প্রথমবার ৩২৪ নং ধারার প্রয়ােগ করেছে তারা। কিন্তু তাদের এই সিদ্ধান্ত ভােট পরিচালনার ক্ষেত্রে তাদের নিরপেক্ষতা নিয়ে একাধিক প্রশ্ন তুলে দিয়েছে, যা ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে খুব সুখকর নয়।