স্যাটের রায় রীতিমতে বেকায়দায় ফেলে দিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে। একে দীর্ঘদিন ধরে যষ্ঠ বেতন কমিশন চালু করার চাপ ছিল। তার ওপরে স্যাটের রায়ে কেন্দ্রের সমহারে বছরে দু’বার মহার্ঘভাতা দিতে হবে।
শুক্রবার স্যাটের এই রায় ঘােষণার সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মধ্যমগ্রামে প্রশাসনিক বৈঠক করছিলেন। রায় শােনার পর মমতার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া, ‘দিতে তাে চাই, কিন্তু দেব কোথা থেকে? টাকা আসবে কোথা থেকে?’
সরকারি কর্মচারীদের মহার্ঘভাতা না দিতে পারাকে প্রতিষ্ঠা করতে এতাবৎকাল মমতা যে সমস্ত মন্তব্য করেছিলেন, তার মধ্যে এদিনের মন্তব্যই কিছুটা হলেও নরম সুরে ছিল। এর আগে তিনি মহার্ঘভাতা নিয়ে বলেছেন, ঘেউ ঘেউ করলে কিছু হবে না, যখন দেওয়ার সময় হবে, তখন দেব। আবার কখনও বলেছেন, সরকার যতটা পারবে ততটা দেবে। উন্নয়নের কাজ বন্ধ করে তাে আর মহার্ঘভাতা দেওয়া যাবে না।
এমনকী একুশে জুলাইয়ের মঞ্চেও মমতা বলেছেন, যারা কেন্দ্রীয় সরকারের সমহারে বেতন চাইছেন, তারা কেন্দ্রে চলে যান। রাজ্যে থাকলে, এখানকার মতােই বেতন নিতে হবে। কিন্তু শুক্রবার স্যাটের রায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যাবতীয় যুক্তির ধারকে ভোতা করে দিয়েছে।
তাই এদিন মহার্ঘভাতা না দিতে পারা নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্যে কিছুটা হলেও অনুযােগের সর ছিল। সেই সঙ্গে তিনি নিজের অক্ষমতার কথাও প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেন শুক্রবার। বললেন সরকারের টাকার অবস্থা ভালাে নয়। চাইলেই টাকা পাওয়া যায় না। প্রত্যেকটা খরচ আগে থেকে ভেবে করতে হয়। এবছর ৫৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ শোধ করতে হবে। বাম আমলে ২০০৬-০৭ সালে স্বল্প সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছিল। সেগুলি এখন ম্যাচিওর করেছে।
এরপর তিনি বাম আমলের তুলনা টেনে বলেন, গত আট বছরে রাজ্যটাকে ঘুরে দাঁড় করিয়েছি। আগে মাস পয়লা সরকারি কর্মচারীদের বেতন হত না, এখন হয়। আমার পক্ষে আর দেওয়া সম্ভব নয়। রাজ্যের বর্তমান অবস্থার কথা তুলে ধরে মমতা বলেন, সরকার কর বাড়াবে না। বিদ্যুতের মাশুল বাড়াবে না। বিনা পয়সায় স্বাস্থ্য পরিষেবা দেবে, শিক্ষার বন্দোবস্ত করে দেবে। এছাড়া সরকারি কর্মচারীদের বেতন দিতেই হাজার হাজার লক্ষ টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে।
এরপর ষষ্ঠ বেতন কমিশন আছে। সরকার চলবে কোথা থেকে? গত তিন বছরে ৫০ হাজার কোটি টাকার ওপর সুদ গুণতে হয়েছে। আজ যদি আমি আরও ঋণ করতে থাকি, তাহলে তিরিশ বছর পর সেই ঋণ কে শােধ করবে?
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এইসব যুক্তি থেকে একথা পরিষ্কার স্যাটের রায় যা-ই হােক না কেন, মহার্ঘভাতা বাড়ানাের বিষয়টি অত সহজে বাস্তবায়িত হবে না। বিশেষ করে এবারের লােকসভা নির্বাচনের আগেই মহার্ঘভাতা বাড়ানাের সিদ্ধান্ত না হওয়ায় তার প্রভাব পড়েছে ফলাফলে। শুধু তা-ই নয়, পােস্টাল ব্যালটে তৃণমূলের ভরাডুবি বুঝিয়ে দিয়েছে, সরকারি কর্মচারীরা সরকারের ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
পড়ুন । কেন্দ্রের হারে ডিএ দিতে রায় স্যাটের
বর্তমানে সরকার বকেয়া মহার্ঘভাতা মিটিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও তার রাজনৈতিক ফায়দা নিতে পারবে না। কারণ সকলেই একথা ধরে নেবে, কোর্টের রায়েই মাথা নােয়াতে হল সরকারকে। সেই সঙ্গে বিশেষ করে ইতিমধ্যেই অমিত শাহ ঘােষণা করেছেন, এই রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় এলে সপ্তম বেতন কমিশন চালু করে দেবে। ঠিক যেমন হয়েছিল ত্রিপুরার ক্ষেত্রে।
শুক্রবারের রায় ঘােষণার পর কর্মচারী মহলে প্রশ্ন উঠছে, নতুন হারে মহার্ঘভাতা কবে থেকে দেওয়া হবে? নতুন হারে মহার্ঘভাতা কি ষষ্ঠ বেতন কমিশনের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হবে? এই কোর্টের রায়ের অপেক্ষাতেই কি ষষ্ঠ বেতন কমিশনের সুপারিশ এতদিনেও নবান্নে জমা পড়ছে না? যদিও সেই রিপাের্ট ইতিমধ্যেই তৈরি হয়ে রয়েছে বলে সূত্র মারফত খবর পাওয়া গিয়েছে।
শুক্রবার স্যাট-এর রায় ঘােষণার পর অবশ্য ষষ্ঠ বেতন কমিশনের চেয়ারম্যান অভিরূপ সরকার জানিয়েছেন, স্যাটের সঙ্গে বেতন কমিশনের কোনও সম্পর্ক নেই। তবে বছরে দু’বার মহার্ঘভাতা বাড়ানাের যে নির্দেশ ট্রাইবুনাল দিয়েছে, সেটা বেতন কমিশনের সুপারিশে অন্তর্ভুক্ত করা যায় কিনা ভেবে দেখা হবে।
কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীরা যখন সপ্তম বেতন কমিশনের সুপারিশ কার্যকর হয়েছে, তখন রাজ্য সরকারি কর্মচারীরা পঞ্চম বেতন কমিশন অনুযায়ী বেতন পাচ্ছেন। অন্যদিকে কেন্দ্রের সমান হারে মহার্ঘভাতাও বৃদ্ধি করা হয়নি তাদের। তাছাড়া বেতন কাঠামাে দুর্বল হলেও মহার্ঘভাতা বাড়ালেও তাদের আখেরে খুব বেশি লাভ হবে না।
সেক্ষেত্রে ষষ্ঠ বেতন কমিশনের সুপারিশে মূল বেতনের সঙ্গে মহার্ঘভাতা মিশিয়ে রাজ্য সরকার এক ঢিলে দুই পাখি মারার চেষ্টা করতে পারে, এমন আন্দাজ করছেন অনেকে।