গত ৪ মে খড়গপুর থেকে চন্দ্রকোণা-মেদিনীপুর সড়ক ধরে চন্দ্রকোণায় রোড শো করতে যাচ্ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। চন্দ্রকোণায় ঢোকার মুখে রাধাবল্লভপুরে রাস্তায় কয়েকজন ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দেয়।
গাড়ি থামিয়ে সটান নেমে পড়েন মমতা। তারপর সুর চড়িয়ে বলেন, ‘এই পালিয়ে যাচ্ছিস কেন? সামনে আয়।’ মুহূর্তে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল সেই মুহুর্তের ভিডিয়ো। মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রকোণা ছাড়ার আগেই তিনজনকে আটক করেছিল পুলিশ। তারপর থেকে বিজেপির প্রচারে ফিরে ফিরে এসেছে এই প্রসঙ্গ। খোদ নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহ সভা করতে এসে এই প্রসঙ্গ তুলেছিলেন।
বৃহস্পতিবার নৈহাটিতে দলীয় ‘সত্যাগ্রহ’ কর্মসূচিতে বিকেলের দিকে তিনি যখন ভাটপাড়ার রিলায়্যান্স জুটমিলের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন রাস্তার ধার থেকে ‘জয় শ্রী রাম’ স্লোগান ওঠে। মমতার অভিযোগ, একদল লোক তাঁর গাড়ির উপর হামলা করে। তাঁর উদ্দেশে ভেসে আসে গালিগালাজ।
এরপরই গাড়ি থেকে নেমে পড়েন মনতা। তেড়ে যান ওই দলটির দিকে। তাঁকে বলতে শোনা যায় ‘আমাদের খাবে, আমাদের পরবে, আবার গণ্ডগোল করবে বেঁচে আছ আমাদের জন্য।’ এরপরই তিনি পুলিশ কর্তাদের নির্দেশ দেন, ‘সবার নাম নোট করে নিন। ঘরে ঘরে নাকা চেকিং করুন। যারা গণ্ডগোল করেছে সবাইকে ধরো।’
প্রসঙ্গত, এদিন এই ঘটনায় মেজাজ হারিয়ে গাড়ি থেকে নেমে রীতিমতো হুঁশিয়ারি দিতে শোনা গেল তাঁকে। তাঁর গাড়িতে হামলার অভিযোগ তুলে মমতা পুলিশকে ঘরে ঘরে ঢুকে ‘নাকা চেকিং’- এর নির্দেশও দেন। এদিন এই ঘটনায় ফের সরগরম রাজ্য রাজনীতি। প্রকাশ, এরপর নৈহাটির সভাতে পৌঁছেও মমতা এই প্রসঙ্গ তােলেন।
তিনি বলেন কয়েকটা জুটমিলের সামনে আমার গাড়ির উপর বিজেপির ফেট্টি বাঁধা কয়েকজন হামলা চালানোর চেষ্টা করে যাদের আমরা খাওয়াই, পরাই, থাকতে দিই, ভালবাসি— তারাই এমন করছে। তিনি অভিযোগ করেন, তাঁর গাড়ির সামনে এসে হামলা চালানো হয়। এরপর তিনি বলেন, ‘গুলির বিরুদ্ধে লড়াই করে বেঁচে থাকব। আমরা মোদির দয়ায় বেচে নেই। মোদির দয়ায় বেঁচে নেই। মোদির সরকার নির্বাচিত। আমরাও নির্বাচিত সরকার। এসব মানব না’।
ভাটপাড়ার এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, ওই এলাকায় মূলত অবাঙালিদের সংখ্যাধিক্য। মমতা চিৎকার-চেঁচামেচি করে তাঁর গাড়িতে উঠতেই ফের ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান ওঠে। গাড়ি থেকে আবারও নেমে আসেন তিনি, ‘আয় সামনে আয়। বুকের পাটা থাকলে সামনে এসে বল।’ মমতার অভিযোগ, ‘স্লোগান দেবে দিক। সাহস কত, বিজেপির ফেট্টি বেঁধে আমাকে গালিগালাজ করছে, আমার গাড়িতে হামলা চালাচ্ছে! এদের আমরা যত্ন করে রেখে দিয়েছি। এরা আউটসাইডার। বাংলার স্থানীয় লোক নয়।’ মমতার এই ‘আউটসাইডার’ মন্তব্য ঘিরে সরগরম হয়ে ওঠে রাজ্য রাজনীতি। বিজেপির অভিযোগ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রাদেশিকতার রাজনীতি করছেন।
উল্লেখ্য, এদিন একই ঘটনা ঘটে নৈহাটির নদিয়া জুটমিলের সামনেও। ‘সত্যাগ্রহ’ মঞ্চে যাওয়ার পথে সেখানেও ক্ষুব্ধ মমতাকে গাড়ি থেকে নেমে আসতে দেখা যায়। গাড়ি থেকে নেমে মমতাকে বলতে শোনা যায়, ‘চামড়া গুটিয়ে ছেড়ে দেব। ডাকাত ক্রিমিনাল। সব তাড়িয়ে ছাড়ব।’
প্রসঙ্গক্রমে, লোকসভা ভোটে শোচনীয় ফল তৃণমূল কংগ্রেসের। নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর থেকেই একের পর এক নেতা-বিধায়ক দিল্লিতে গিয়ে যোগ দিচ্ছেন বিজেপিতে। দলের সংগঠন ধরে রাখতে রাজ্যপাট ছেড়ে ফের আন্দোলনে নামলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং।
লোকসভা নির্বাচনের সময় সবচেয়ে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল ভাটপাড়া-নৈহাটি চত্বর। ষষ্ঠ দফায় লোকসভা ভোটের দিন আবার ছিল ভাটপাড়া বিধানসভার উপনির্বাচনও। সেদিন রীতিমতো অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে গোটা এলাকা। প্রাণ বাঁচাতে গা ঢাকা দিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসের বেশ কয়েকজন কর্মী-সমর্থক। আতঙ্কে কার্যত দিশেহারা দলের নীচুতলার কর্মীরা। এই পরিস্থিতিতে দিল্লিতে মোদি সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগদানের পরিকল্পনা বাতিল করে নৈহাটিতে অবস্থান বিক্ষোভ করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
এদিন নৈহাটির সভামঞ্চ থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ২০১১ সালে বাংলায় ক্ষমতায় এসে বলেছিলাম, বদলা নয়, বদল চাই। ওটা বলার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। এবার কিন্তু বদলা নেব। তবে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বদলা নেব। তিনি বলেন, ৪০০ পরিবার ঘরছাড়া। সবাই বাড়ি ফিরে যাবেন। জনগণ একসঙ্গে থাকলে গুন্ডারা ল্যাজ গুটিয়ে পালিয়ে যাবে। এদিন তিনি ৪০০ ঘরছাড়া পরিবারের নথিপত্র ডিজির হাতে তুলে দিয়ে পদক্ষেপ নিতে বলেন। তা ছাড়া ঘর ভাঙচুর, ক্লাব ভাঙচুর, সবকিছুর নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করতে বলেন। জেলা নেতৃত্বকে তিনি নির্দেশ দিলেন ঘর, ক্লাব ভাঙচুরের রিপোর্ট তিনদিনের মধ্যে জমা দিতে।
এদিন মুখ্যমন্ত্রীর এই সভায় উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী তথা জেলার সভাপতি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, তাপস রায়, সুজিত বসু, ব্রাত্য বসু, জেলা পর্যবেক্ষক নির্মল ঘোষ, বিধায়ক পার্থ ভৌমিক, সুনীল সিং প্রমুখ। মুখ্যমন্ত্রী এদিন নাম না করে সাংসদ অর্জুন সিংকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করে বলেন, নির্বাচন কমিশনের অধীনে যখন আইনশৃঙ্খলা ছিল তখন কয়েকজন গদ্দার অনেক অত্যাচার করেছে। ওরা যদি মুক্তাঞ্চল মনে করে, তাহলে ভুল করছে। বিজেপির মতো দলকে আমি ঘৃণা করি।
এদিন তিনি আরও বলেন, মোদি কিংবা বিজেপির দয়ায় এখানে আমরা ক্ষমতায় নেই। মানুষের দয়ায় এখানে আছি। বাংলা কোনইদন গুজরাত হবে না। গদ্দারদের লোকজন মেয়েদের হাত ধরে টানছে। হাসপাতাল বন্ধ করে দিয়েছে। বাস টার্মিনাস ভেঙে দিয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রী মুকুল রায়ের নাম না করেই আক্রমণ করে বলেন, জেলের ভয়ে কাঁচরাপাড়া থেকে দিল্লি পালিয়ে গেল। উনি বিজেপির বড় আবর্জনা। বিজেপিতে দলটাকে শেষ করার পক্ষে ওই গদ্দারই যথেষ্ট। মুখ্যমন্ত্রী আগামী ১৪ জুন বীজপুরে সভা করার কথাও বলেন। এদিন তিনি বলেন, মাঝে মাঝে জগদ্দল ভাটপাড়া, বারাকপুর ও নৈহাটিতে আসব। সংগঠন চাঙা করতে নতুন কমিটি তিনি ঘোষণা করেন। ব্লকে ব্লকে মহিলাদের নিয়ে বঙ্গজননী এবং ছাত্র-যুবদের নিয়ে তিনি জয়হিন্দ গড়তে বলেন।