সর্বভারতীয় রাজনীতিতে বিজেপি-বিরোধী মুখ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা মমতারই

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Photo:SNS)

পশ্চিমবঙ্গে এবার বিধানসভা নির্বাচনের আগে দিল্লি থেকে বিজেপির হেভিওয়েট নেতারা এসে যেভাবে মিটিং, মিছিল শুরু করেছিলেন, তাতে তাঁদের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছিল, বিজেপি যেন পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় এসেই গিয়েছে। নির্বাচন যতই এগিয়ে আসছিল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ও কেন্দ্রের হোমরাচোমরা মন্ত্রী থেকে উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ যোগী এবং অন্যান্য নেতা-মন্ত্রীরা ততই প্রচার চালাচ্ছিলেন খুব আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে।

শেষ পর্যন্ত তাঁদের ব্যক্তিগত আক্রমণের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে ওঠেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তৃণমুল সাংসদ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইপো, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। এমনকী, তাঁদের নামোচ্চারণ না করে শুধু ‘পিসি’ আর ‘ভাইপো’ বলে ক্রমাগত আক্রমণ করে গেছেন তাঁদের।

আর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁর ভাষণে যেভাবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্দেশে ‘দিদি’, ‘ও দিদি’ বলে প্রায় অশালীন ভঙ্গিতে মুখ্যমন্ত্রীকে ব্যঙ্গ করে গেছেন, তা শুধু নজিরবিহীনই নয়, ভারতের মতো একটি বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশের প্রধানমন্ত্রীর পদমর্যাদার একজন নেতার মুখে এরকম উচ্চারণ ওই পদের পক্ষেও চূড়ান্ত অমর্যাদাকর।


আসলে বিজেপির সর্বভারতীয় স্তরের নেতারা এভাবে নিজেদের যে রুচি ও সংস্কৃতির পরিচয় দিয়েছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ মানুষ তাকে তীব্রভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন। মুখে রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ আর নেতাজী সুভাষচন্দ্রের কথা ভুলভাল উচ্চারণে আওড়ালেই বাঙালি তাতে গলে যাবে, এরকম ভাবাটা যে তাঁদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার পরিচয় নয়, তা নির্বাচনের ফলাফলেই প্রমাণিত হয়েছে।

মমতা নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহ্ জুটির তথাকথিত বিজয় রথকে থামিয়ে দিয়েছেন বন্দ্যোপাধ্যায়। এতে মোদি-শাহের মুখ লুকোনো পর্যন্ত বেশ কঠিন হয়ে পড়ছিল। পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর তাঁদের দুজনকে বেশ কিছুদিন আর জনসমক্ষে কথা বলতে দেখা যায়নি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই কৃতিত্বকে কোনোভাবেই খাটো করে দেখার কোনো অবকাশ নেই।

সত্যি সত্যিই’ আহত বাঘিনী’র মতো একা তিনি যেভাবে মাত্র ৭৭ টি আসনে বিজেপিকে আটকে দিয়েছেন, মোদি-শাহের পক্ষে হজম করা মুশকিল। অমিত শাহ যেভাবে প্রবল প্রত্যয়ে বলে যেতেন যে, ২০০ টির বেশি আসন পেয়ে তাঁরা পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় আসবেন, তা শেষ পর্যন্ত তাঁদের নির্বাচনী’ জুমলা হয়েই থেকে গেছে।

তার পরেই যেভাবে সিবিআইকে সক্রিয় হতে দেখা গেছে, গ্রেফতার করা হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা-মন্ত্রীদের, তাতে মোদি-শাহের রাজনৈতিক প্রতিশোধ নেওয়ার বাসনা অভ্যস্ত নগ্নভাবে প্রকাশ পেয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ তা বুঝেছেন। অতি সম্প্রতি তিনটি উপনির্বাচনের তিনটিতেই তৃণমূল কংগ্রেস বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছে।

তার মধ্যে একটি আসনে, ভবানীপুর কেন্দ্রে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং প্রায় ৫৯ হাজার ভোটের ব্যবধানে জিতে নিজেরই আগের জয়ের রেকর্ড ভেঙেছেন। সামনেই ৩০ অক্টোবর, আরও চারটি বিধানসভা আসনে উপনির্বাচন আছে। এগুলোতেও যে তৃণমূল কংগ্রেসই জিতবে, এ কথা এখনই বলে দেওয়া যায়।

কারণ মমতার যে অপ্রতিরোধ্য, লড়াকু ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে, তাতে সর্বভারতীয় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও তিনিই এখন নরেন্দ্র মোদি তথা বিজেপি বিরোধী মুখ হয়ে উঠেছেন। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচন এখনও অনেকটা দূরে আছে ঠিকই, কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখন থেকেই সর্বভারতীয় ক্ষেত্র তৈরির কাজে নেমে পড়েছেন।

যেখানে যেখানে বিজেপি ক্ষমতায় আছে নির্বাচনে সেখানেই তিনি তাদের বিরোধিতায় নামবেন, এরকম প্রচেষ্টা ইতিমধ্যেই শুরু করেছেন। ত্রিপুরা এবং গোয়া তাঁর প্রাথমিক লক্ষ্য। শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গে আবদ্ধ থাকলে যে সর্বভারতীয় ভাবমূর্তি গড়া যাবে না, তা মমতা খুব ভালো করেই জানেন।

তাই শিলচরের কংগ্রেস নেত্রী, দিল্লির রাজনীতিতে যিনি যথেষ্ট পরিচিত মুখ, সেই সুস্মিতা দেবকে তিনি তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ হিসেবে রাজ্যসভায় পাঠিয়েছেন। আবার গোয়ার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী লুইজিনহো ফালেইরো কলকাতায় মমতার সঙ্গে দেখা করে যোগ দিয়েছেন তাঁর দলে।

এদিকে বিজেপি সাংসদ প্রাক্তন কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় বিজেপি ছেড়ে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দেওয়ায় বিজেপি যে বড় একটা ধাক্কা খেয়েছে, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। এ রাজ্যে অনেক বিজেপি নেতা ও বিধায়ক তৃণমূল কংগ্রেসে নাম লেখাতে শুরু করেছেন, তার সংখ্যা যে ভবিষ্যতে বাড়বে, সংশয় নেই এ ব্যাপারেও।

পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি যত দুর্বল হবে, সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাবমূর্তি তত উজ্জ্বল হবে নিশ্চয়ই। কিন্তু এ কথাও মনে রাখতে হবে, সারা দেশে বিজেপি-বিরোধী যে রাজনৈতিক দলগুলি আছে, তাদের অনেকের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পর্ক ভালো হলেও, নির্বাচনী লক্ষ্যে জোট গড়ার কাজটি খুব সহজ হবে না।

তবে আন্তরিকভাবে চাইলে মমতার পক্ষে যে তা খুব কঠিন হবে না, এ প্রত্যাশা করা যেতে পারে। এনসিপি-র শরদ পাওয়ার, শিবসেনার উদ্ধব ঠাকরে বা ডিএমকে-র স্ট্যালিন প্রমুখ নেতাদের সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রাথমিক জোট গড়ার কাজ এগোতেই পারে।

তবে অনেকেই মনে করছেন, কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে শক্তিশালী বিজেপি বিরোধী জোট কি সম্ভব! ইদানীং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে অন্যান্য তৃণমূল কংগ্রেসের নেতারা তীব্রভাবেই কংগ্রেসের সমালোচনা করছেন। তাতে অনেকের মনে সংশয় জাগছে, তাহলে কি কংগ্রেসেকে বাদ দিয়ে মমতা বিজেপি-বিরোধী জোট গড়তে চাইছেন! সেক্ষেত্রে কি বিজেপিরই সুবিধে হবে না! কিন্তু এ কথাও তো ঠিক যে, সারা দেশেই জাতীয় কংগ্রেসের মতো একটি প্রাচীন রাজনৈতিক দলের সংগঠনের যা অবস্থা তাতে ওই দলের কাছ থেকে এই মুহূর্তে খুব বেশি কিছু আশা করা যায় না।

দীর্ঘদিন ধরে কংগ্রেসের স্থায়ী সভাপতি নেই। কোনো কোনো ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাহুল গান্ধী ও প্রিয়ঙ্কা গান্ধীরা পথে নামলেও, তাঁদের মধ্যে বিজেপি-বিরোধী আন্দোলনের ধারাবাহিকতার অভাব বড় প্রকট। ফলে, কংগ্রেসের মধ্যেই তৈরি হয়েছে বিভিন্ন বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠী। পাঞ্জাবে কংগ্রেস নিজেই এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করেছে, যাতে দলের ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি।

এরকম বিভিন্ন কারণে প্রধান বিরোধীর ভূমিকায় কংগ্রেসকে মেনে নিতে পারছেন না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই মুহূর্তে কেন্দ্রীয় সরকার ও বিজেপির বিরুদ্ধে যৌথভাবে সবচেয়ে তীব্র আন্দোলন করে যাচ্ছেন পাঞ্জাব, রাজস্থান, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ ও অন্যান্য জায়গার কৃষকেরা।

কেন্দ্র সরকারের কৃষিবিলের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের এই আন্দোলনকে সমর্থন করছে কংগ্রেস। কিন্তু তাদের সমস্ত প্রতিবাদ অনেকটাই টুইটার-কেন্দ্রিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিরন্তর পথে নেমে আন্দোলন না করলে শেষ পর্যন্ত তা যে ফলপ্রসূ হয় না, এই মুহূর্তে মমতার চেয়ে ভালো আর কেউ তা বোঝেন না।

এক্ষেত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কৃষক আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানাতে আরও সক্রিয় হওয়ার প্রয়োজন আছে। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে কৃষিজমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর রাজনৈতিক জীবনের যে উচ্চতায় উঠে এসেছেন, তাঁকে অবশ্য এ বিষয়ে বেশি কিছু বলার অবকাশ থাকে না।

মোদী সরকারের প্রতিটি পদক্ষেপই আজ দেশের সাধারণ মানুষকে শুধুমাত্র খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার জন্যেও কঠিন পরিস্থিতির সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। পেট্রোল, ডিজেল, রান্নার গ্যাস থেকে নিত্যব্যবহার্য প্রতিটি জিনিসের দাম যে পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে, তাতে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে।

গত বছর করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত যত মানুষ কর্মসংস্থান হারিয়েছেন, যেভাবে মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্তদের আয় কমেছে, তাতে দেশের মানুষ যে ভালো নেই, এ বিষয়টিকে কোনোভাবেই গুরুত্ব দিতে রাজি নয় মোদি সরকার। নোটবন্দী থেকে এনআরসি-এক একটি ইস্যুতে মানুষ জেরবার হয়ে পড়েছে।

ব্যাঙ্কের সুদ কমিয়ে দিয়ে প্রবীণ নাগরিকদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তহীনতার মধ্যে ফেলে দিয়েছে এই কেন্দ্র সরকার। মানুষের এইসব ক্ষোভের, কষ্টের, দুর্দশার কথা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানেন। বহু ক্ষেত্রে কেন্দ্র সরকারের অমানবিক নীতির বিরোধিতাও তিনি করেছেন। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তিনি সবসময়ই সরব।

তাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই নিতে হবে বর্তমান কেন্দ্র সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের প্রধান ভূমিকা। আর তা করতে যতদূর সম্ভব অন্যান্য বিরোধী দলকেও সঙ্গে নেওয়া দরকার। আপাতত প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত মোদি সরকারকে ২০২৪ সালের নির্বাচনে পরাস্ত করা।

পশ্চিমবঙ্গের এই বিধানসভা নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে রাজনৈতিক ক্যারিশমা দেখাতে পেরেছেন, তাতে তাঁর প্রতি ভারতের অন্যান্য প্রদেশের বিজেপি-বিরোধী শক্তির সমর্থন থাকবে, এ আশা করা যায়।

এইসঙ্গে এটাও বিজেপি-বিরোধী সমস্ত শ্রেণীর মানুষের প্রত্যাশা যে, কংগ্রেস ও বামপন্থীরা সরাসরি এবংদ্ব্যর্থহীনভাবে বিজেপির বিরুদ্ধে সরব হোন। মমতার বিরোধিতা করতে গিয়ে বিজেপির সুবিধে তাঁরা যেন না করে দেন। সাধারণ মানুষের এই মনোভাব যদি তাঁরা বুঝতে না পারেন, তাহলে তাঁরা আর কোনোদিনই ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন না। আর সারা ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁদেরও অচ্ছুত করে রাখার মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসতে হবে তৃণমূল কংগ্রেসকে।